শীতের পিঠা

উৎপলকান্তি বড়য়া | বুধবার , ৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৯:২০ পূর্বাহ্ণ

দুজনেই একদম পিঠার পাগল বললে ভুল হবে না। মা বাড়িতে প্রতিদিনই প্রায় কোনো না কোনো পিঠা বানায়। সকালে কি বা বিকেলে। এটা নিত্যদিনের অন্যান্য কাজের মতোই। মিষ্টি আর অনি। দুই ভাই বোন পিঠা বলতেই পাগল। ওদের জন্য পিঠা বানানো মায়ের প্রতিদিনের কাজ। এমন কি ইশকুলে যাওয়ার সময়েও টিফিন বক্সে পিঠা দিলে তো কথাই নেই। তাতে এরা খুব বেশ খুশি।

মিষ্টির ক্লাসে নীলা তার একমার বন্ধু। ওরা টিফিন ছুটিতে নাস্তা করে। মিষ্টি চতুর্থ শ্রেণীর তার ক্লাসের বন্ধু নীলাকে পিঠার ভাগ দেয়। নীলাও তার নাস্তা থেকে মিষ্টিকে ভাগ দেয়। আর এদিকে অনি তার সম্পূর্ণ উল্টো। তৃতীয় শ্রেণীর অনি তার ক্লাসে কাউকে টিফিনের ভাগ দেয় না। সে নিজের নাস্তা নিজে খায় অন্যান্যদের মতো।

এই শীতে অনির ভাপা পিঠা খুব পছন্দ। নারকেল কুচির সাথে খেজুরের গুড় মেশানো ভাপা পিঠা। মায়ের কাছে আজ বেশ করে বায়না ধরেছে। নারকেলের ভাপা পিঠা চাইই তার। অন্যদিকে মিষ্টির পছন্দ কালো তিল মেশানো চিতই পিঠা। শীতের পিঠা বলে কথা। তাই তাদের আবদারের মাত্রাটা একটু জোরালোই বলা যায়। মা সংসারের নানা কাজে এমনিতে হাঁপিয়ে ওঠেন। তার উপর মিষ্টি আর অনির পিঠার আবদার।

মা বলেন, তাই বলে প্রতিদিন তাদের জন্য পিঠা বানাতে হবে? মা যেনো আর পেরে ওঠেন না। দাদু বলেন, দাও না বউমা বানিয়ে। ছোটো মানুষ। পিঠাই তো থেতে চায়। খারাপ তো কিছুনা। তা ছাড়া শীতের এই পিঠার মৌসুমে পিঠা তো খেতে চাইবেই বাচ্চারা। এতে দোষের কিছু নেই।

ঠিক আছে একটা শর্তে পিঠা বানাতে পাবি। আর তা হলো, আজ ইশকুল থেকে এসে পিঠা খাবে তোমরা। আমি পিঠা বানিয়ে রাখবো। আজ এমনি টিফিন নিয়ে ইশকুলে যাবে। মার শর্তে রাজি মিষ্টি আর অনি।

যথারীতি বেলা বারোটায় মিষ্টি আর অনির ইশকুল ছুটি। বাড়িতে এসেই দেখে নাস্তার টেবিলে তাদের পিঠা রেডি। দুজনেই তাদের পছন্দের পিঠা পেয়ে মহা খুশি। মনের সুখে অনি তার পছন্দের নারকেল কুচির সাথে খেজুরের গুড় মেশানো ভাপা পিঠা খেতে থাকে। মিষ্টিও তার কালো তিল মেশানো চিতই পিঠা পেয়ে বেশ খুশি।

মা ইতোমধ্যে দুপুরে রান্নার কাজে পাকঘরে ব্যস্ত। দাদু গেছে ওয়াশরুমে স্নান সারার জন্য। দুই ভাই বোন খাওয়ার টেবিলে পছন্দের পিঠা পেয়ে আনন্দে গদ গদ।

খানিকটা সময় চুপচাপ। মা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে নাস্তার টেবিলে এসে দেখে মিষ্টি আর অনি নাস্তার টেবিলে নেই। পড়ার ঘরে নেই। পাশের শোয়ার ঘরেও নেই। বাড়ির সদর খোলা দরোজায় এসে তো মায়ের চোখ দুটো কপালে ওঠার অবস্থা। একজন ফকির মহিলা। সাথে তার দুই আড়াই বছরের একটা সন্তান। সদর দরোজার পাকা দ্বিতীয় সিঁড়িতে বসে পিঠা খাচ্ছে প্লেট থেকে। মিষ্টি আর অনি তাদের পিঠা খাওয়ার দিকে নীরব চেয়ে থেকে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। মাকে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত মিষ্টি আর অনি ভড়কে যায়। অপরাধীর মতো নিজেদের মাথা নত করে থাকে। মার দিকে আড় চোখে তাকায়।

তোমরা তোমাদের পিঠা থেকে খেতে দিয়েছো ওদেরকে?

হ্যাঁ মামনিং ওর ছেলেটা কান্না করছিলো তো। তাই খেতে দিয়েছি। ওদের পেটে ক্ষুধা পায় না বুঝি মা? বলেই মার চোখের দিকে আড়চোখে মিষ্টি আবার তাকায়। মা হাসি মুখে মেয়েকে কাছে টেনে নেয়।

ভালো করেছো। ওদেরকে খেতে দিয়ে খুব ভালো করেছো মামনি। ক্ষুধার্তদেরকে খেতে দেয়া খুব ভালো কাজ। অনি এবার জড়তা ভেঙ্গে সরাসরি মার পাশ ঘেষে দাঁড়ায়।

মামনি, আমি ও আমার নারকেল ভাপা খেতে দিয়েছি তো!

খুব ভালো কাজ করেছো আমার বাপাজান। আমার কলিজার টুকরো সোনা। তোমরা খুব ভালো করেছো ওরা মা ছেলেকে খেতে দিয়ে।

এই না হলে কি ওরা আমার দাদুসোনা। এতক্ষণ পেছনে থেকে দাদু দেখছিলেন এবং শুনছিলেন সব। বলেন, অসহায়দের এভাবে সহযোগিতা করতে হয়। বিপদে সাহায্য করতে হয়। তোমরা আজ একটা খুব ভালো কাজ করেছো লক্ষ্মী দাদুসোনারা।

এরই মধ্যে বড় গ্লাসে করে মা পানি এনে খেতে দেয় ফকির মেয়ে ও তার ছেলেকে। সাথে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট গুঁজে দেয় হাতে। মায়ের হাত থেকে টাকাটা নিয়ে পরম খুশি মনে ফকির মেয়ে তার ছেলেসহ পা বাড়ায় শীতের ঝলমলে দুপুরের খোলা রাস্তার দিকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্কুলে স্কুলে পিঠা উৎসব
পরবর্তী নিবন্ধস্বপ্ন