শিশুর অভিভাবক হওয়ার আগে প্রশিক্ষণ নেয়া প্রয়োজন

ময়মী খোন্দকার | মঙ্গলবার , ৩ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

বলা হয়ে থাকে, একটি শিশুর প্রথম শিক্ষালয় হলো তার পরিবার। সেই শিক্ষালয়ের যাঁরা শিক্ষক তারা হলেন প্রধানত: শিশুর বাবা-মা সাথে দাদা-দাদী ও অন্যরা, তাঁরা একটি শিশুকে প্রাথমিকভাবে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্যে ঠিক কতটা সুযোগ্য? সেটি কি ভেবে দেখেছি কখনও?
আমরা বাবা-মা কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠ মানেই ভাবি তাঁরা সকল কিছু জানেন বোঝেন এবং তাঁরা, একমাত্র তাঁরাই সঠিক।

তাই এই বিষয়টি নিয়ে আমরা কোনো প্রশ্ন তুলি না। বরঞ্চ আমাদের সমাজে এ সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করা রীতিমতো অলঙ্ঘনীয় এবং খুবই স্পর্শকাতর নিষিদ্ধ একটি বিষয়।

তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কিছু কিছু শিশু প্রাথমিকভাবে ‘অ-আ’ শিখতে পারলেও অনেক ক্ষেত্রেই তাদের মানসিক বিকাশ ঘটেনা! এ অবস্থায় যখন একটি শিশু প্রথম স্কুলে যায়, তখন দেখা যায় সেই শিশুটি অন্য আর আট-দশটি শিশু থেকে নানান ক্ষেত্রে খানিকটা পিছিয়ে পড়ছে! কিছু শিশু ‘পরিবার’ নামক শিক্ষালয় থেকে আগেই মৌলিক জ্ঞান নিয়ে বিদ্যালয়ে এসেছে আর কিছু শিশু মাতাপিতার অজ্ঞানতার কারণে আগে থেকেই যেহেতু মৌলিক জ্ঞান বঞ্চিত, তাই তারাই মূলতঃ অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মেধাবী হওয়ার দরুণ পড়াশুনায় এগিয়ে গেলেও সৃষ্টিশীল চিন্তন, আচরণে সঠিক আদব-লেহাজ ধারণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে সঠিক শিক্ষা প্রাপ্ত না হওয়ার কারণে পশ্চাৎপদই রয়ে যাচ্ছে।

নিশ্চয়ই এ দায় শিশুটির নয়! তবে এই দায় কার? কেনো কিছু নিষ্পাপ-সরল শিশুদের জীবনের প্রাথমিক অবস্থাতেই এমন বিভেদের শিকার হতে হচ্ছে ? এখন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, এই বিভেদ নিরসনের সমাধান আসলে কী ?

ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হলে, বড় চাকুরে হতে হলে আমাদের পরীক্ষা দিতে হয়। অথচ ‘বাবা-মা’ হওয়ার মতন এত বড় দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের পরীক্ষা দেওয়াতো দূরের কথা, ন্যূনতম প্রস্তুতিটুকুন নেওয়ার মতন রীতিও আমাদের সমাজে প্রচলিত নেই! অথচ একটি সুসন্তান গড়ে তোলা, দশটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার থেকেও কোটিগুণ শ্রমসাধ্য-কঠিন ও ধীশক্তির একটি কাজ। তাহলে এরকম গুরুত্বপূর্ণএকটা ব্যাপারে আমরা কেনো এত উদাসীন? প্রকৃতির নিয়মে চাইলেই বাবা-মা হওয়া যায়, কিন্তু সত্যিকারের বাবা-মা হওয়ার জন্যে আসলেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন নেই কি ?

এমতাবস্থায়, যারা নতুন বাবা-মা হচ্ছেন তাদের জন্যে ‘জাতীয়ভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা’ করা হবে, নিশ্চয় এরকম কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়। তবে এই দায়িত্বটুকুন কিন্তু চাইলেই খুব সহজেই দেশের বিদ্যালয়গুলো নিতে পারে।

দেশের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার একটি নিয়মের প্রচলন রয়েছে, যেখানে শিক্ষকদের শেখানো হয় কিভাবে তাঁরা বাচ্চাদের পাঠদান করবেন, কিভাবে বাচ্চাদের সাথে বাচ্চাদের মতন করেই যোগাযোগ করবেন, দুর্বল বাচ্চাকে শ্রেণিকক্ষে কিভাবে সক্রিয় রাখবেন ইত্যাদি। ঠিক একইভাবে বিদ্যালয়গুলোর দ্বারা ‘অভিভাবক প্রশিক্ষণ’ এর ব্যবস্থা করা হলে বাচ্চারা আর আধেক নয় একটি পূর্ণাঙ্গ পরিবেশে গড়ে ওঠার সুযোগ পেতে পারে। অভিভাবকরাও বুঝতে পারবেন তাদের শিশুর সুস্থ-সুন্দর মানসিক বিকাশের জন্যে কিরকম পরিবেশ তাদের গড়ে তুলতে হবে, কিভাবে তারা পরিবারে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করবেন ইত্যাদি। গাছের আগায় পানি দেওয়ার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হলো একটা গাছকে গোড়া থেকেই শক্ত করে গড়ে তোলা। তদ্রুপ, একটি সুস্থ-শিক্ষিত ও জ্ঞানী জাতি গড়ে তোলার জন্যে প্রয়োজন একেবারে প্রাথমিক অবস্থাতেই পড়াশুনার পাশাপাশি একটি শিশুর মানসিক বিকাশের প্রতি পূর্ণ মনোযোগী ও যত্নবান হওয়া।

এক্ষেত্রে যেনো কোনো আপস নয়, তাই আমরা এমন আশা করতেই পারি যে; অদূর ভবিষ্যতে জাতির স্বার্থে পড়াশুনার সাথে সাথে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার নিয়ম প্রচলিত হবে এবং তা অচিরেই বাস্তবায়িত হবে!

পূর্ববর্তী নিবন্ধএসো গড়ি সুন্দর বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধআমাদের শিক্ষাগুরু সৈয়দ আব্দুল মান্নান