শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির চির যৌবনের উপাদান ‘ঘুড়ি’

বাসুদেব খাস্তগীর | মঙ্গলবার , ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৩১ পূর্বাহ্ণ

ঘুড়ির উৎপত্তি এবং ঘুড়ি ওড়ানোর ইতিহাস মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাসের সাথে জড়িত। সে হিসাবে ঘুড়ি ওড়ানোর ইতিহাস অনেক প্রাচীন। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বজুড়েই ঘুড়ি ওড়ানো একটি মজার খেলা। পৃথিবীর বহু দেশে ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। আমাদের অনেকের শৈশবের একটি সময় জুড়ে ঘুড়ি ওড়ানোর স্মৃতি জ্বলজ্বলমান। গ্রামের বিস্তীর্ণ কোনো মাঠ কিংবা খোলা খালি জমির ক্ষেতে আলে বসে ঘুড়ি ওড়ানোর মনোমুগ্ধকর সময়ের কথাতো ভোলা যায় না। একসময় গ্রাম বাংলার সেই সব ঐতিহ্য শুধু অতীতই নয় একেবারে হারিয়ে যাবার দলে। তখনকার সময়ে আমরা যখন গ্রাম বাংলার বিভিন্ন মেলায় যেতাম তখন মেলায় বিভিন্ন রকমের বাহারি ঘুড়ি বিক্রয় হতো।

উৎসুক তরুণ কিশোররা কিনে এনে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসবে মেতে উঠতো। এখনো এসব মেলা এখনো বিদ্যমান, কিন্তু মেলায় এসব বাহারি ঘুড়ির এখন আর দেখা মেলে না। প্রযুক্তির কল্যাণে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে। কবি সুফিয়া কামালের লেখা ‘আজিকার শিশু’ কবিতা আমাদের মনে ঘুড়ি উড়ানোর এক আনন্দময় স্মৃতিকে জাগ্রত করে প্রতিনিয়ত। কবিতার প্রথম চারটি লাইন এ রকম ‘আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা, তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা। আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি, তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।’ গ্রামের পথে ঘাটে পড়ন্ত বিকেলে ঘুড়ি উড়ানোর সেই দৃশ্য অতীতেরই এক স্মৃতি। আমরা যখন ছোটবেলায় স্কুলে যেতাম স্কুল ছুটির পর বিকেলে মন হন্যে ছুটতো কোনো ফুটবল খেলার মাঠে কিংবা খোলা কোনো মাঠে ঘুড়ি উড়ানোর মত মনমাতানো উৎসবে। শৈশব মানে এক আনন্দময় স্মৃতি। যে স্মৃতি নগর জীবনের হাজারো স্মৃতির ভিড়ে চির অমলিন। সেই স্মৃতির ভিড়ে আকাশে চোখ মেললেই ঘৃড়ির লড়াইয়ের দৃশ্য ফিরে ফিরে আসে বারবার। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহে গ্রামের অনেক হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের মধ্যে ঘুড়ি উড়ানোর খেলা একটি।

গ্রামের মাঠে ঘাটে এখনো ফুটবল ক্রিকেটের মত খেলাগুলো দাপিয়ে বেড়ায়। কিন্তু আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর সেই দৃশ্য আর নজর কাড়ে না। নেট কিংবা স্মার্টফোনের আসক্তি ঘুড়িকে সরিয়ে দিয়েছে অনেক দূরে। গ্রাম নয় শহরের শিশুকিশোররা এক সময় ঘুড়ি উড়াতো। গ্রামে যেখানে মাঠে ঘাট কিংবা খোলা জমিতে ঘুড়ি ওড়ানো হতো সেখানে শহরের শিশুকিশোররা দালানের ছাদের ওপরে বসে ঘুড়ি ওড়াতো। দালানের ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে অনেক দুর্ঘটনার খবরও তখন আমরা জেনেছি। গ্রামের মত এখনকার শহরের শিশুকিশোরদের কাছেও ঘুড়ি বিস্মৃতপ্রায় একটি জিনিস। এখন বাসায় বসে শহুরে শিশুকিশোররা কম্পিউটার বা ভিডিও গেইম খেলে সময় কাটায়। অনেকে মাঠে যায়ফুটবল বা ক্রিকেট খেলে সময়কে উপভোগ করে। গ্রাম ও শহরের অনেক কিছুর ভিড়ের মধ্যে ঘুড়ি উড়ানো খেলা একেবারে হারিয়ে গেছে। শরৎ কিংবা হেমন্তের বিকেলের আকাশ মাতিয়ে রাখতো যে ঘুড়ি সেই আকাশে এখন এক ধরনের শূন্যতা। প্রবারণা পূর্ণিমার রাতে ফানুসের রঙিন আলোয় মেতে থাকা শৈশবের সাথে হেমন্ত কিংবা শরতের বিকেলে আকাশে রঙিন ঘুড়ির মাতোয়ারা উৎসব কোনো অংশেই কম ছিল না। আকাশ জুড়ে উড়ে বেড়ানো নানা রঙের ঘুড়িগুলো এখন শুধু দৃষ্টির অন্তরালেই নয়যেন ধীরে ধীরে জাদুঘরের কোনো উপাদান হয়ে যাচ্ছে। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, বেগুনি কত বাহারি রঙের ঘুড়িতে আকাশ ছেয়ে থাকা আকাশ দেখে মনে হতো যেন আকাশ জুড়ে বসেছে রঙের মেলা। ঘুড়ি উড়ানো আর ঘুড়ি কাটার প্রতিযোগিতার যে রেওয়াজ ছিলযা এখন বিলীন। ঘুড়ির নামকরণের মধ্যে দারুণ এক বৈচিত্র্য লক্ষ করা যেতো। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশেও নানা ধরনের নামের ঘুড়ির দেখা মেলে। যেমনআগুন পাখি, জেমিনি, প্যাঁচা, পাল তোলা জাহাজ, চারকোণা আকৃতির বাংলা ঘুড়ি, ড্রাগন, বঙ, মাছরাঙা, ঈগল, ডলফিন, অক্টোপাস, সাপ, ব্যাঙ, মৌচাক, কামরাঙা, ফিনিঙ, চরকি লেজ, চিলঘুড়ি, বেত, ডাক, মানুষ ও তারাঘুড়ি প্রভৃতি। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও নানা ধরনের নামের ঘুড়ির দেখা মেলে। যেমনডায়মন্ড কাইট, বার্ন ডোরের ঘুড়ি, রোলার ঘুড়ি, বঙ ঘুড়ি, অক্টোপাস ঘুড়ি, ডেল্টা ঘুড়ি ইত্যাদি। ভাদ্র মাসের শেষ দিনে হয় হিন্দু সমপ্রদায়ের বিশ্বকর্মা পূজা এবং পৌষ মাসের শেষ দিনকে বলা হয় পৌষ সংক্রান্তি। এই দুদিনকে কেন্দ্র করে সারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ঘুড়ি উড়ানো হয়। বাংলাদেশে কিন্তু ধর্মীয় এ দিবসে ঘুড়ি উড়ানোর সংস্কৃতির প্রচলন নেই। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা যেভাবে প্রবারণায় ফানুস উড়িয়ে থাকেন তেমনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিশ্বকর্মা পূজা ও পৌষ সংক্রান্তির দিনে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা ঘুড়ি উড়াতো। সেখানেও এ সংস্কৃতি ধীরে ধীরে অনেকটাই হারিয়ে গেছে। এদেশে ঘুড়ি উড়ানো ও তা নিয়ে প্রতিযোগিতা আবহমান বাংলার একটি চিরায়ত সর্বজনীন একটি ঐতিহ্য। এখানে ঘুড়ি উড়ানোর সাথে ধর্মীয় কোনো কিছুর সংশ্লিষ্টতা নেই। একসময় গ্রামের ছোটবড় সকলের কাছে ঘুড়ি ছিলো দুর্নিবার এক আকর্ষণের নাম। এই ঘুড়ি যতই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাক না কেন, কিন্তু ঘুড়ি আমাদের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যেন চির দেদীপ্যমান। কবি শিল্পী সাহিত্যিকরা তাদের কল্পনায় ঘুড়িকে উপজীব্য করে উপমা চিত্রকল্পে কত কবিতা গল্পই না রচনা করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। ঘুড়ি নিয়ে লেখকের লেখনী আমাদের শিল্প সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। ঘুড়ি থাকুক হারিয়ে যাবার দলে, কিন্তু ঘুড়ি আছে লেখকদের মননে চিন্তায় সৃষ্টির অবগাহনে। একসময়ের চলচ্চিত্র কিংবা নাটকে শিশুকিশোরদের ঘুড়ি উড়ানোর নানা দৃশ্যকে কত না শিল্পীতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই সেই ঘুড়ির আবেদন যেন আমাদের শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এখনো ফুরিয়ে যায়নি। বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় মাত্র পনেরো মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবি ‘টু’ নির্মাণ করেন ১৯৬৪ সালে। তাঁর প্রথম সিনেমা ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তির নয় বছর পর এই স্বপ্ল দৈর্ঘ্যের ছবি নির্মাণ করেন। সেখানে চমৎকার নিপূণতায় দরিদ্র এক শিশুর ঘুড়ি উড়ানোর দৃশ্যকে চিত্রায়িত করেছেন চমৎকার অর্থের আবহে। দরিদ্র ছেলেটির ঘুড়ি যেন সাম্রাজ্যবাদের আকাশে সাম্যবাদের মুক্তির ঘুড়ি যা সাম্রাজ্যবাদের আঘাতে ছিঁড়ে যায়, ভূপাতিত হয়। তবুও ছেঁড়া ঘুড়িটি ছেলেটি ফেলে দেয়না। তাঁর ভাবনা আবার সে এই ঘুড়ি নতুন করে তৈরি করবে। আবার আকাশে ছড়িয়ে দেবে মুক্তির বার্তা। সংলাপহীন এ ছবিতে কী অসাধারণ দক্ষতায় দরিদ্র ও ধনী পরিবারের দুটো ছেলের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় আমাদের দেখিয়েছেন বুর্জোয়া শ্রেণি, সাম্রাজ্যবাদের চেহারা এবং পরিশেষে শুনিয়েছেন শান্তির বার্তা। কিংবা সামপ্রতিক সময়ে বাল্যবিবাহ নিয়ে নাহিদা সুলতানা শুচির পরিচালনায় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ঘুড়ি’র কথাও উল্লেখ করা যায়। যেখানে একজন দুরন্ত কিশোরীর পথ, বিল ও নদীর পাড়ে ঘুড়ি উড়িয়ে বেড়ানোর সাথে বাল্য বিবাহের চিত্র গাঁথা হয়েছে তা দারুণ এক নান্দনিকতায়। এভাবে সময়ে সময়ে ঘুড়ি উঠে এসেছে শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্র ও নাটকে। টেলিভিশনের অনেক চ্যানেলে ঘুড়ি নিয়ে অনেক ধারাবাহিক নাটক লেখা হয়েছে। দেশের প্রধান প্রধান কবি সাহিত্যিকসহ নবীন প্রবীণ সকলেই ঘুড়িকে নিয়ে গল্প ছড়া, কিশোরকবিতাসহ নানামুখী লেখা লিখেছেন এবং লিখে চলেছেন। আকাশে ঘুড়ির অস্তিত্ব নেই কিন্তু কবি ও শিল্পীর মনের আকাশে ঘুড়ি প্রতিদিনই ওড়ে। বলা যায় হারিয়ে যাওয়া ঘুড়ি শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির চির যৌবনের উপাদান হয়েই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখক ও সংস্কৃতিপ্রেমীদের কাছে কল্পনায় নতুন নতুন রূপে ধরা দেয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, কলেজ শিক্ষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকমলকুমার মজুমদার : স্বাতন্ত্র্যের সন্ধানী ঔপন্যাসিক
পরবর্তী নিবন্ধভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রামের নারী নেতৃত্ব