শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে নেওয়া যায় ভাবতে হবে

| রবিবার , ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৮:০৫ পূর্বাহ্ণ

করোনার থাবা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না দেশের শিক্ষাঙ্গন। ৬ ফেব্রুয়ারির পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আরও দুই সপ্তাহ বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে বিকল্প পন্থায় শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা থাকলেও তা খুব একটা কার্যকর হচ্ছে বলে মনে হয় না। ফলে শিশু-কিশোরদের মনোদৈহিক বিকাশের সংকট নিয়ে দেশব্যাপী শিক্ষাবিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যা বাড়তে পারে বলে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, তরুণদের ক্ষেত্রেও নানারকম মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা বাড়ছে। অস্বাভাবিকতা যে কোনো মানুষই দীর্ঘদিন নিতে পারে না, শিশু-কিশোর ও তরুণদের জন্য তা আরও কঠিন এবং এর নেতিবাচক প্রভাব ও ফল অস্বীকার করা যাবে না। করোনা শুরুর পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রথমেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছিল। এবারও তাই করা হয়েছে। বিশেষ করে স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। নতুন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের পর আবারো আশঙ্কা দেখা দিয়েছে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া নিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিক্ষার্থীদের যদি শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে ধরে রাখা না যায় তাহলে অপূরণীয় ক্ষতি হবে। যা ভবিষ্যতে এগিয়ে চলার বাংলাদেশের জন্য বিরূপ প্রভাব পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
করোনার প্রথম ধাক্কার পর প্রায় দেড় বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। বেসরকারী সংস্থা ব্রাকের হিসাবে এই সময়ে দেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ বেকার হয়েছে। দরিদ্র সীমার নীচে নেমেছে সমাজের একটা বড় অংশ। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে শিক্ষাখাতে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের কাজে পাঠিয়েছে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ মেয়ে। বাল্য বিবাহের শিকার হয়ে অনেকে শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছে।
ক্ষতিকর সব দিক বিবেচনা করে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। আমাদের দেশে সব খাত খোলা রাখা হলেও কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্যঝুঁকিটা নিতে চায় নি সরকার। তাই বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। কেননা সরকার সব স্তরের শিক্ষার্থীদের কোনোরকম ঝুঁকিতে ফেলতে চায়ছে না। এবারও শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, সংক্রমণের হার ৩০ শতাংশের ওপরে রয়েছে এবং তা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে না নামলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ঝুঁকি সরকার নেবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষণা অনুযায়ী কোনো দেশ বা অঞ্চলে টানা তিন সপ্তাহ সংক্রমণ পাঁচ শতাংশের নিচে থাকলেই সে দেশ বা এলাকাকে করোনামুক্ত ঘোষণা করা যাবে।
সেভ দ্য চিলড্রেন তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ‘মহামারীর কারণে বিশ্বে ৯৭ লাখ শিশুর আর কোনো দিন হয়তো ক্লাসে ফেরা হবে না। যাদের অনেকেই বাল্যবিয়ের শিকার হবে।’ এ প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) পরিচালিত এক জরিপ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ‘২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের ২১টি জেলায় অন্তত ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এই বাল্যবিয়ের ৭৮ শতাংশই হয়েছে মা-বাবার আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে। এদের প্রায় অর্ধেকের বয়স ১৬ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। আর ৪৮ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছর এর মধ্যে। অবশিষ্ট ২ শতাংশের বয়স মাত্র ১০ থেকে ১২ বছর বলে উল্লেখ করা হয়েছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার একটি বড় কারণ হিসেবে বাল্যবিয়েকে দায়ী করা হচ্ছে। মাঠ জরিপ সে কথারই ইঙ্গিত বহন করে। বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন তাদের এক গবেষণায় বলছে, ‘করোনাকালে বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ৬৫টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। এ রকম সাত মাসে ২১ জেলার ৮৪ উপজেলায় মোট ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ের তথ্য তাদের হাতে রয়েছে।’ অন্য দিকে করোনার কারণেও অনেক ছেলে শিক্ষার্থীও শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়েছে। যার অন্যতম কারণ দারিদ্র্য। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়, ‘করোনা পরিস্থিতির আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০.৫ শতাংশ। কিন্তু করোনাকালে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। তিনগুণ বেড়ে যা এখন দাঁড়িয়েছে ২৮.৫ শতাংশে।’ যার ব্যাপক প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের জীবনে। বিশেষ করে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
আমাদের বোঝা দরকার যে, শিক্ষা ও শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অর্থ হলো দেশের ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়া। করোনার নতুন নতুন ধরন তৈরি হওয়া বন্ধ হবে কবে- তা কেউ জানে না, সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরাও বলতে পারছেন না। ফলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা বিবেচনায় নিয়েই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের কল্যাণে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে