শিক্ষা ও চিকিৎসা পেলে অটিস্টিক শিশুরাও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে

কর্মশালায় আজাদী সম্পাদক

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৩ আগস্ট, ২০২২ at ৭:৩১ পূর্বাহ্ণ

নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালায় একুশে পদকপ্রাপ্ত দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেছেন, অটিজমে আক্রান্ত অটিস্টিক শিশুদের ব্যাপারে ব্যাপক জনসচেতনতা প্রয়োজন। অটিস্টিক শিশুরা যথাযথ শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ পেলে একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা সবাই যদি একটি অটিজম-বান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারি তাহলে এই শিশুরা দেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা নয়, বরং সহায়ক হবে। আমাদের যাদের ঘরে অটিজম আক্রান্ত ছেলেমেয়ে আছে তাদেরকে এক ঘরে করে ফেলা হয়। যেখানে পরিবারের সদস্যরা ভালোবাসা দিয়ে এই শিশুদের কাছে টেনে নিবে সেখানে উল্টো তাদের দূরে ঠেলে দেয়া হয়। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। গতকাল শুক্রবার সকালে আন্দরকিল্লাস্থ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কে বি আব্দুস সাত্তার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ সব কথা বলেন।
আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, আমাদের যাদের ঘরে অটিজম ছেলেমেয়ে আছে তাদেরকে আমরা সমাজ থেকে, আমাদের নিজস্ব গণ্ডি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাই।
সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্তির বিষয়ে বলতে গিয়ে আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, ৬২ বছর ধরে সাংবাদিকতায় আছি বলেই এই পদক দেয়া হয়েছে। মহান একুশের ভাষা আন্দোলনের সাথে আমাদের পরিবারের অংশগ্রহণ রয়েছে। ভাষা আন্দোলনের প্রতিরোধের প্রথম প্রহরে ১৯৫২ সালের ২২ ফ্রেরুয়ারি প্রথম প্রতিবাদী কবিতা ‘কাদঁতে আসিনি- ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে প্রকাশ করেছিলেন আমার বাবা। এটা ঐতিহাসিক ঘটনা। এটা আমাদের জন্য গৌরবের বিষয়। কিন্তু এই কাজের জন্য মূল্য দিতে হয়েছে আমাদের পরিবারকে। গ্রেফতার করা হয় প্রেসের ম্যানেজারকে। ছয় বছরের সাজা হয় তার। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তি পান তিনি।
অটিজম শিশুদের নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে-এবার অটিস্টিক শিশুর মা-বাবাদের নিয়েও গবেষণার প্রয়োজন উল্লেখ করে এম এ মালেক বলেন, কারণ যখনই একটি শিশু অটিস্টিক হিসেবে চিহিৃত হয় তখনই তার মা-বাবার উপর শুরু হয় মানসিক নির্যাতন। তারা একটি অটিজম শিশুকে নিয়ে সংসার করেন। তাদেরকে বড় করেন, শিক্ষা দেন। অনেক কষ্ট করেই মা-বাবা এই শিশুদের লালন-পালন করেন। অনেক পরিবার কিন্তু অটিস্টিক শিশুদের এক ঘরে করে ফেলে।
অটিজম, মূক কিংবা থার্ড জেন্ডার যারা; তারা কেউই সমাজের বোঝা নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি অনেক আগে ব্যাংকক গিয়েছিলাম। সেখানে অনেক জায়গা ঘুরার পর আমাকে থিয়েটার দেখার জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। হলে গিয়ে নাটক দেখছি, এতো সুন্দর-সুন্দর ছেলেমেয়েরা অভিনয় করছে, এতো সুন্দর নাটক! আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পরে আমাকে বলা হলো-এরা সবাই থার্ড জেন্ডার। এদেরকে সেই ভাবে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে এসেছে তারা। কোলকাতা নিউ মার্কেট থেকে বের হওয়ার সময় কেএফসি মার্কেটে দেখবেন-এখানে যারা সার্ভ করছেন সবাই মূক (বাক প্রতিবন্ধী)। শুধু একজন মাত্র লোক আছেন, যিনি কথা বলতে পারেন। সুতরাং আমাদের সমাজে যারা অটিস্টিক বলেন, তৃতীয় লিঙ্গ কিংবা বাক প্রতিবন্ধী বলেন, এদেরকে সমাজের মূল স্রোতধারায় যদি আমরা নিয়ে আসতে পারি এবং সেটা যদি আমরা করি তাহলে তারা আমাদের সমাজের সঙ্গে মিশতে পারবে।
শোকের মাস আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এম এ মালেক বলেন, এই শোকের মাসে আমরা জাতির পিতাকে সপরিবারে হারিয়েছি। জাতির পিতার কারণে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। বিশ্বের বুকে বাঙালি হিসেবে গর্বের সাথে পরিচয় দিতে পারি।
নিষ্পাপ অটিজম স্কুলের গরীব অসহায় শিশুদের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়ে আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, যারা গরীব-অসহায় স্কুলে বেতন দিতে পারে না-তাদের জন্য যদি কোনো সহযোগিতা লাগে আমাকে বললে আমি আমার সাধ্যটুকু দিয়ে তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করবো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যত অন্ধ শিক্ষার্থী আছে, তাদের সবাইকে আমি প্রতি মাসে দেড় হাজার টাকা করে দিই। আর আমার পিতা ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেকের নামে ১০টি স্কলারশিপ গত ২০ বছর ধরে দিয়ে আসছি।
অটিজম আক্রান্ত শিশুর মায়েদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, মানুষকে পরাজিত হওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা এই পৃথিবীতে পাঠাননি। মানুষ কখনো পরাজিত হয় না। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। আমি যখন আমার কাজটা আরম্ভ করবো-সেটা শেষ করতে পারবো না-সেটা হয় না। আপনারা যারা মায়েরা আজকে উপস্থিত আছেন আপনারা পরাজিত হবেন না। আপনারা মনোবল হারাবেন না। আপনাদের যাদের অটিজম আক্রান্ত ছেলেমেয়ে আছে তাদেরকে সুস্থধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করবেন।
নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. বাসনা মুহুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কর্মশালার উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম জেলা সমাজ সেবা কার্যালয়ের উপ পরিচালক ফরিদুল আলম। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রবর্তক সংঘ বাংলাদেশের সম্পাদক ও প্রাক্তন লায়ন্স জেলা গভর্নর ডা. শ্রীপ্রকাশ বিশ্বাস, পি এইচ পি ফ্যামিলির পরিচালক ও নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম, প্রফেসর ড. সুদীপ পাল, নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সচিব সাংবাদিক এম নাসিরুল হক, নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট লায়ন রোসাংগীর বাচ্চু, যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক টিংকু চৌধুরী, সুব্রত বিকাশ চৌধুরী।
ডা. শ্রীপ্রকাশ বিশ্বাস বলেন, নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন মানবিকতার সাথে আমাদের সমাজে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জন্য কাজ করছে। আমাদের দেশে অটিজম শিশুর উপযুক্ত মানসম্মত প্রশিক্ষণ স্কুলের সংখ্যা খুবই কম। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের খাটো করে না দেখে তাদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখা দরকার। এদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সেবা প্রয়োজন। তাদের বাবা-মাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দেয়া দরকার।
পি এইচ পি ফ্যামিলির পরিচালক ও নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম বলেন, অটিস্টিক শিশুদের সময় মতো নার্সিং করা গেলে, আপন মনে তাদের পাশে দাঁড়ালে তারাও সমাজে অবদান রাখতে পারে। অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে এক ধরনের মেধা কাজ করে। তাদেরকে প্রশিক্ষণে-যত্নে গড়ে তোলা গেলে তাদের মধ্যে যে ইচ্ছে শক্তি সেটাকে কাজে লাগানো যায়।
নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন দীর্ঘ দিন ধরে যেভাবে এই শিশুদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে আমাদের সকলের এই প্রতিষ্ঠানের পাশে থাকা উচিত।
কর্মশালায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ। দিনব্যাপী কর্মশালায় রিসোর্স পার্সন হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, ঢাকাস্থ সিএস কেয়ারের স্পিস্‌ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট জান্নাতুল ফেরদৌস ঝুমা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজেলিফিশে সম্ভাবনা দেখছেন বিজ্ঞানীরা
পরবর্তী নিবন্ধএক মাসের মধ্যে ছাড়া হবে বাঘসহ নানা প্রাণী