শিক্ষার বহুমাত্রিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া একটি মহা চ্যালেঞ্জ

| মঙ্গলবার , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

১২ সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে সরকার। কিন্তু শিক্ষাটার অবস্থা কেমন! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেই শিক্ষাটা খুলে যাবে, তেমন আশা করা কঠিন। সরকারের নির্দেশনা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলেও এখন চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে এনে পাঠদান নিশ্চিত করা। মাঠপর্যায়ে সরকারের নির্দেশনাগুলো মেনে চলার পরিবেশ পরিস্থিতি আছে কি না, সেটাও দেখবার বিষয়। তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় যে বহুমাত্রিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে, তা পুষিয়ে নেওয়া দেশের জন্য একটি মহা চ্যালেঞ্জ। শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন শ্রেণিকক্ষের বাইরে থাকায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ভুলে গেছে। জ্ঞানের বড় ঘাটতি নিয়ে উপরের ক্লাসে উঠেছে। পরীক্ষা নিতে না-পারায় শেখার দক্ষতা যাচাই করাও সম্ভব হয়নি। অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ না-করেই নানা শ্রম-পেশায় যুক্ত হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রায় ৩৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থী সঠিক শিখন গ্রহণ এবং তাদের সমবয়সিদের সঙ্গে আলাপচারিতার সুযোগটি হাতছাড়া করেছে, যা তাদের শিক্ষার অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করেছে।
তথ্য মতে, কোভিড-১৯-এর কারণে যে পরিবর্তন ঘটেছে তাতে নতুন প্রজন্মের আগামীর স্বপ্নসৌধ নির্মাণের মূলকেন্দ্র শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। জুলাই পর্যন্ত ১৬০টিরও বেশি দেশের স্কুল বন্ধ ছিল। এতে ১০০ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনার কারণে দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় মোট শিক্ষার্থীর ৯৪ ভাগ কোনো-না-কোনোভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের ৯৯ ভাগই নিম্ন বা নিম্নমধ্য আয়ের দেশের শিক্ষার্থী। বর্তমান পৃথিবী এমন এক বিপর্যয়ের শিকার, যার প্রভাব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পড়বে, মানবজাতির অন্তর্গত যে সম্ভাবনা রয়েছে তা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, বিগত দশকগুলোর উন্নতির যে ধারা তা বাধাগ্রস্ত হবে। শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় ব্যাঘাতের কারণে শিশুদের পুষ্টিহীনতা, বাল্যবিয়ে ও নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়ার ব্যাপক আশংকা রয়েছে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, স্কুল বন্ধের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য বাংলাদেশ সরকার টেলিভিশন, মোবাইল ফোন, রেডিও এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে দূরবর্তী শিক্ষার সূচনা করেছিল। তবে সব শিক্ষার্থীর এ প্ল্যাটফরমগুলোতে অ্যাঙেস না-থাকায় শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য অর্জন ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, এ বিকল্প শিক্ষা পদ্ধতি এবং প্ল্যাটফরমে তাদের অ্যাক্সেস কম ছিল। জরিপ করা স্কুলশিশুদের মধ্যে ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সি যথাক্রমে ৫০ শতাংশেরও কম রেডিও, কম্পিউটার এবং টেলিভিশনে অ্যাক্সেস পেয়েছে। তাদের প্রায় সবারই মোবাইল ফোনে অ্যাক্সেস রয়েছে, তবে অনেকেরই ইন্টারনেটে অ্যাক্সেস নেই। এ সমীক্ষায় ধনী ও দরিদ্র পরিবারের মধ্যে একটি ডিজিটাল বিভাজনও পাওয়া গেছে। ধনী পরিবারের সঙ্গে তুলনা করা হলে সবচেয়ে দরিদ্রতমদের মধ্যে ৯.২ শতাংশ টেলিভিশনে অ্যাঙেস পেয়েছে। পক্ষান্তরে, সবচেয়ে ধনীদের মধ্যে পেয়েছে ৯১ শতাংশ। অন্যান্য বিকল্প শেখার মাধ্যমে একই ধরনের প্রবণতা বিদ্যমান। অন্য জরিপে দেখা গেছে, অনলাইন লার্নিং প্রোগ্রামগুলোতে অ্যাঙেস থাকা ২১ শতাংশ পরিবারের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ পরিবার এর সঠিক ব্যবহার করতে পেরেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষা এবং অর্থনীতি- একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পূর্ণভাবে যুক্ত। একটি ভিন্ন অন্যটি অর্জন এ সময়কালের বিবেচনায় কঠিন। করোনায় শিক্ষা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আবার সেই ক্ষতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটেছে, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি একই। দেশের শিল্প খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির ৮০ শতাংশই অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের। করোনা মহামারি এসএমই শিল্পে নতুন করে ভাবনাচিন্তার তাগিদ সামনে নিয়ে এসেছে। এর অনেক কারণও আছে। মানুষের আয় কমেছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ কমেছে। মধ্যবিত্তের সঞ্চয় প্রবণতাও হ্রাস পেয়েছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসামঞ্জস্য ক্রমেই বাড়ছে। কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে।
শিক্ষাবিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষাখাতে আমাদের বিরাট ক্ষতি হয়েছে। তারপরও আমরা দেখেছি, বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকেরা নিজস্ব পেজ খুলে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেছেন। তাঁরা ওপরের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেননি। এ জন্য তাঁদের কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। আমাদের লাখ লাখ শিক্ষক আছেন। প্রতিদিন একজন শিক্ষক যদি চারজন শিক্ষার্থীর কাছেও যেতেন, তাহলে বিরাটসংখ্যক শিক্ষার্থীকে শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আনা যেত। আমরা নিম্ন আয়ের মানুষকে, তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের কারখানায় পাঠালাম। কিন্তু শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হলো। শিক্ষাও যে একটি বড় শিল্প ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তৈরি করার জন্য, সেটি নীতিনির্ধারকদের ভাবনায় ছিল বলে মনে হয়নি। তারপরও দেরিতে হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে সরকার প্রশংসনীয় কাজ করেছে। আশা করি, শিক্ষার বহুমাত্রিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা মোকাবেলা করবেন মহাচ্যালেঞ্জ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে