সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ছাত্র–শিক্ষকের সম্পর্কে এসেছে আমূল পরিবর্তন। বর্তমানে এই সর্ম্পকে ধরেছে বড় চিড়! কবি কাদের নেওয়াজের ‘‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতাটিতে গুরু ভক্তির যে দৃশ্যপট বর্ণিত হয়েছে সে ধরনের দৃশ্য আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। বাস্তবতা হচ্ছে ছাত্র– শিক্ষক সর্ম্পক অবনতির ফলে শিক্ষার ভিত্তি ও নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে দিনদিন।
মূলত সমাজের প্রতিটি স্তরে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার ফলে সৃষ্ট ক্ষত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়ও ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষাকেন্দ্রিক। যেকোনও প্রকারে ভালো ফলাফল অর্জনই এখানে মূখ্য বিষয়। তাই আমাদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার্থী নয়, দিনদিন পরীক্ষার্থীতে পরিণত হচ্ছে! যিনি সংক্ষিপ্ত ও সহজ পদ্ধতিতে পরীক্ষায় পাসের উপায় বাতলে দিতে পারেন তিনিই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে ভালো ও জনপ্রিয় শিক্ষক বলে পরিচিতি পান।
শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ্যবইয়ের বাইরে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান সহ অন্যান্য বিষয়ে জানার আগ্রহে দিনদিন ভাটা পরছে। অপ্রিয় হলেও সত্য শিক্ষকদের মধ্যে জ্ঞান চর্চা এবং পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য কোনও বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লাল, নীল, বেগুনি এককথায় বিভিন্ন বর্ণের আড়ালে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করে পদ–পদবী দখল করে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকাই একশ্রেণির শিক্ষকদের ধ্যান– জ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি গবেষণা কর্মের মাধ্যমে নিত্যনতুন জ্ঞান সৃষ্টির মহৎ কাজে তাঁদের নিয়োজিত থাকার কথা।
এসব কারণে সমাজের সর্বস্তরে শিক্ষকদের সম্মান ও ভাবমূর্তি দিনদিন বিনষ্ট হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে নানাবিধ কারণে শিক্ষার মান একদিকে যেমন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারছে না ঠিক তেমনি শিক্ষক–শিক্ষার্থীর সর্ম্পক ও রং হারাচ্ছে দিনদিন। মূলত শিক্ষার বাণিজ্যকরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতির অনুপ্রবেশ, শিক্ষা প্রদান ও গ্রহণে আন্তরিকতার অভাব, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর নৈতিক স্খলনসহ বিভিন্ন কারণে শিক্ষক– শিক্ষার্থীর সর্ম্পকের অবনতি ঘটছে প্রতিনিয়ত। অনেকে মনে করেন শিক্ষার সাথে শাসনের একটা যোগসূত্র রয়েছে।
শাসন না থাকায় বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মন থেকে লজ্জা– ভয় সবকিছুই উঠে গেছে। অবশ্য শাসনের নামে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীর উপর বর্বরোচিত আঘাত ও কাম্য নয়। একটি রাষ্ট্রে সবচেয়ে মেধাবী লোকদের শিক্ষকতা পেশায় আসা উচিত। অথচ অপ্রতুল বেতন–ভাতা সহ বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশে মেধাবীদের কাছে শিক্ষকতা মোটেই আকর্ষণীয় পেশা নয়।
ফলে তুলনামূলক কম মেধাসম্পন্নরা শিক্ষকতা পেশায় আসছেন যা আমাদের সার্বিক শিক্ষার উন্নয়নে অন্তরায়। আর্থিক দৈন্যদশা ঘুচাতে বাড়তি রোজগারের আশায় অনেক শিক্ষক কোচিং– প্রাইভেট, ব্যবসা কিংবা পার্টটাইম কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ছেন। ফলে শিক্ষকরা নিজ পেশা কিংবা দায়িত্বের প্রতি মনোযোগ হারাচ্ছেন যা পরোক্ষভাবে শিক্ষক–শিক্ষার্থীর সর্ম্পকে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
শিক্ষকতা মর্যদাপূর্ণ পেশা হলেও আগের সেই সম্মান ও গুরুত্ব শিক্ষকরা পাচ্ছেন না। যোগ্যতার ঘাটতি কিংবা যে কোনও কারণেই হোক শিক্ষকরা বিভিন্নভাবে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। এমনকি শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষকরা শারীরিকভাবে লাঞ্জিত ও হত্যার শিকার হচ্ছেন, যা যে কোনও সমাজে অকল্পনীয়। এককথায় পূর্বের ন্যায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সর্ম্পক পারস্পরিক শ্রদ্ধা, স্নেহ কিংবা আন্তরিকতার মধ্যে আবদ্ধ নেই।
অন্যকে সম্মান না করার সংস্কৃতি এদেশে একদিনে গড়ে ওঠেনি। পরিবারে পিতা–মাতা কিংবা বড়দের অমান্য করার মনোভাব থেকেই এ ধরনের মানসিকতার আর্বিভাব। কাউকে মান্য না করার সংস্কৃতির বলি হচ্ছে শিক্ষকরাও। কিশোর গ্যাং সংস্কৃতির বিকাশ, অপসংস্কৃতির জোয়ার, রাজনীতিতে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রবেশ ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এক শ্রেণির শিক্ষার্থী বেপরোয়াভাবে বেড়ে উঠছে যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়মশৃঙ্খলা ও শিক্ষকদের অনুশাসন মানতে চাই না।
শিক্ষক – শিক্ষার্থীর সর্ম্পক উন্নয়নে করণীয় আছে অনেক কিছুই। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে সবার আগে। শিক্ষাক্রম ও সিলেবাস হতে হবে যুগোপযোগী ও জ্ঞানভিত্তিক। পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় নিয়োগ ও সম্মানজনক বেতন– ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে শিক্ষকরা নিজ পেশার প্রতি আরো দায়িত্বশীল ও মনোযোগী হবে।
পেশাগত দক্ষতা ও গুণগত পাঠদান নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান ও গবেষণা কর্মের সাথে সম্পৃত্ততা বাড়াতে হবে। শ্রেণি কার্যক্রমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদের আচরণ হবে একইসাথে অভিভাবকতুল্য ও বন্ধুসুলভ। শিক্ষকরা যদি পাঠদানে আন্তরিক হন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে জানার আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেন তাহলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানমুখী হবে।
ফলে কোচিং ও গাইড নির্ভরতা আপনা আপনি কমে আসবে। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শিক্ষকদের শিক্ষা দিতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারে। শিক্ষক–শিক্ষার্থীর মধ্যে সর্ম্পক উন্নয়নে উভয়ের পারস্পরিক যোগাযোগ, নির্ভরশীলতা ও সহযোগিতা বৃদ্ধির কোনও বিকল্প নেই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা, সাহিত্য চর্চা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম জোরদার করা খুবই জরুরি।
এক কথায় বাস্তবমুখী বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলতে হবে শিক্ষক– শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চা, মেধা–মনন ও সৃজনশীলতা বিকাশের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে যা শিক্ষক– শিক্ষার্থীর সর্ম্পককে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, স্নেহ ও প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করবে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে পরিবার ও সমাজের রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা। কারণ পরিবার হচ্ছে শিশুর প্রাথমিক শিক্ষালয়। প্রত্যেক অভিভাবকের উচিত সন্তানের পড়ালেখার ব্যাপারে খোঁজখবর রাখা।
লেখক: কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক।