শিক্ষক : জীবনের পাঠদান যাঁর হাতে

ফারিহা জেসমিন | মঙ্গলবার , ১৫ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:৫৪ পূর্বাহ্ণ

একজন শিক্ষক বহু মানুষ গড়ার কারিগর, যিনি সুনাগরিক তৈরি করেন। সুনাগরিকের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পায় একটি সুসমাজ, একটি আদর্শ, মানবিক রাষ্ট্র। একজন শিক্ষক একজন সমাদৃত জ্ঞানের বাতিঘর, যিনি আমৃত্যু জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রদীপ জ্বালিয়ে যান। একজন শিক্ষক একজন রোল-মডেল বা একজন অনুকরণীয় ব্যক্তি যাকে দেখে তাঁর ছাত্ররা শিখে, যার কাছে জীবনের পাঠ পায়। একজন শিক্ষক একজন শিশুর ভবিষ্যতের চিত্রকর।
আমি নিজেও একজন শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমার আজ এতদূর আসার পেছনে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তাঁরা হলেন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আমার শিক্ষকগণ, যারা আমাকে অক্ষরজ্ঞান দান করেছেন। যারা আমার মাঝে ছড়িয়েছেন পুস্তকি জ্ঞানের পাশাপাশি মানবিক জ্ঞানের আলো। দেশে-বিদেশে এতো এতো মহান শিক্ষকের সান্নিধ্য আমার শিক্ষা জীবনকে দিয়েছে জ্ঞানের উত্তাপ, করেছে স্মরণীয়, মহিমান্বিত। আমার জীবনের আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে যারা আলো দিয়ে যান তাঁরা আমার শিক্ষক। তাদের আলোয় আমি আলোকিত।
আমার মা, শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে সেরা। জীবনের প্রাথমিক পাঠ তাঁর কাছে পেয়েছি, আমাকে অক্ষরজ্ঞান দান করেছেন। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমাকে মানুষ করতে নিরলস শ্রম দিয়ে গেছেন। জীবনের বাস্তবতা শিখিয়েছেন, জয়-পরাজয় শিখিয়েছেন, জীবন যুদ্ধে আত্মমর্যাদায় লড়ে যাওয়ার পাঠটাও তাঁর কাছেই পাওয়া। আমার মাকে অতল শ্রদ্ধা, যার কাছে আমি সবচে মেধাবী। যিনি আমার মাঝে অসীম সম্ভাবনা দেখেন। তাঁর কাছে জীবনের অযুত গুরুত্বপূর্ণ পাঠ পেয়েছি এবং সচেতনভাবেই সে সব ধারণ করেছি। পাশাপাশি সারাটা জীবন বিভিন্ন ধাপে আমার শিক্ষা গুরুদের উৎসাহ, যত্ন, আন্তরিকতা, গাইডেন্স আমাকে এত দূর নিয়ে এসেছে। জীবনের প্রতিটি মোড়ে, প্রতিক্ষণে আমার জীবন বিনির্মাণ প্রকৌশলীদের প্রতি আমার অযুত কোটি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং অশেষ কৃতজ্ঞতা থাকবে।
আমার স্বজনদের প্রতি কৃতজ্ঞতা যারা আমাকে আজীবন উৎসাহ দিয়েছেন, দিয়ে যাচ্ছেন। আমার কাছে শিক্ষকতা কোন পেশা নয়। শিক্ষকতা আমার কাছে একটি মহান ব্রত, একটি পবিত্র দায়িত্ব। শিক্ষক হয়ে উঠার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এই মহান ব্রতের জয় হোক।
আজ আমি যার কথা বলব তিনি একজন ভিনদেশি শিক্ষক, মানবাধিকারের গুরু। আমাদের শিক্ষক ড. শ্রী পফা পেটচারামেশ্রি।
হলটা মোটামুটি ছোটোই বলা যায়। চারিদিকে কাঠের কারুকাজ, কেমন প্রাচীন একটা ফ্লেভার পেলাম। এর নাম থাই হাউজ। কাঠের তৈরি তেতলা বাড়ি, এখানে এত চমৎকার একটা বা একাধিক হল আছে আমার জানা ছিল না। পোস্ট কভিড প্রোগ্রাম- অল্প মানুষের আয়োজন হলেও অতিথি সংখ্যা ৫০ পেরিয়ে গেছে।
বলছি, আই এইচ আরপি,( ইন্সটিটিউট অফ হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস স্টাডিস) মাহিদল ইউনিভারসিটি, থাইল্যান্ডের কথা। আমি এখানকার স্টুডেন্ট, ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ আমার ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পূর্তি। দিনটি উদযাপনের জন্য আমার বিভাগ বেশ কিছু একাডেমিক ফিগারদের নিয়ে একটা সেমিনারের আয়োজন করেছে। সাউত্থ-ইস্ট এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানবাধিকারের স্বনামধন্য অধ্যাপকরা এসেছেন। বর্ণিল আয়োজন। এই ভূমিকা টানার উদ্দেশ্য একটাই, এই অনুষ্ঠান নিয়ে আমি কিছু বলব। বিশেষ কারো সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলতে চাই।
নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। সবার আলোচনায় আই এইচ আরপি র মানবাধিকার শিক্ষার গুরুত্ব উঠে এলো, ইন্সটিটিউটের সুনাম নিয়ে বয়ান হল, আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ফ্লোরে জায়গা পেল। সবাই একজনকেই কেন যেন খুব টেনে এনে কথা বলছিল। অবশ্যই খুবই পজিটিভ এপ্রিচিয়েশান ছিল। আমরা মুগ্ধ। রিফ্রেশমেন্ট ব্রেক দেয়া হল। এরপর যা হল সেটা একটা ইতিহাস আর আমি সেই ইতিহাসের গর্বিত অংশ হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।
সেমিনার এ কিনোট দিবেন আযারন শ্রীপফা। ইয়েস, সি ইজ অ্যা নেইম, সি ইজ অ্যা হিস্ট্রি। থাইল্যান্ডের মানবাধিকার চর্চা বা শিক্ষার ইতিহাসে আযারন শ্রীপফা একটি নাম। মানবাধিকারের একজন কালজয়ী শিক্ষক, একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে ড. শ্রীপফা পেটচারামেস্রী কে চিনবেন না, এমন কাউকে কল্পনা করা যায় না।
তখন ঘড়িতে বিকেল সোয়া চারটা, এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, আযারন শ্রীপফা ফ্লোরে আসবেন, কিনোট দিবেন। পুরো হল জুড়ে শুনশান নীরবতা। সবার উৎসুক দৃষ্টি মঞ্চের দিকে। অবশেষে আসলেন স্টেজ আলোকিত করে মানবাধিকার শিক্ষার সরস্বতী, মানবাধিকারের দেবী বলা যায় যাকে তিনি, আমাদের শ্রদ্ধেয় আজারন শ্রীপফা। শাদা শার্ট, নীল স্কার্ট, মাথায় পাকা চুল, ছোটো ছোটো করে কাটা। সে এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর পরিমিতিবোধ, তাঁর স্টাইল, তাঁর কথা! আহ! সেই বিষয় প্রকাশের শব্দ আমার নেই। মাহিদল কে বলা হয় উইজডম অফ দ্য ল্যান্ড, আমি বলি আজারন শ্রীপফা ইজ দ্য গড্ডেস অফ উইজডম। এমন জ্ঞান, এমন প্রজ্ঞা বিরল।
চারিদিকে পিন পতন নীরবতা। ৪৫ মিনিটের অধিক তিনি বলে গেলেন, নীরবে শুনে গেলেন পঞ্চাশধিক দর্শক যারা কোনো না কোনোভাবে মানবাধিকার শিক্ষা ও চর্চার সাথে জড়িত। ৪৫ মিনিট শেষ, পুরো হল করতালিতে মুখরিত। এরপর প্রশ্নোত্তর পর্ব, একজন বললেন, হোয়াই ডোন্ট ইউ রাইট উয়োর বায়োগ্রাফি? তখনো বুঝতে পারিনি এমন প্রশ্ন কেন? এরপর একে একে এলেন আই, এইচ, আরপির ডিরেক্টর, মাহিদল এর ডেপুটি প্রেসিডেন্ট। গড্ডেস অফ হিউম্যান রাইটস কে ফুলেল অভিবাদন জানানো হল। সাথে জানানো হল হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা এবং শুভকামনা।
জানতে পারলাম একটি অধ্যায় শেষ হয়েছে, আযারন শ্রিপফা অফিসিয়ালি অবসরে গেলেন। উনি কেমন বোধ করেছেন তা আমি জানতে পারিনি তবে আমার চোখ ছলছল করছিল। বিদায় আজারন, আমার প্রিয় শিক্ষক, প্রিয় ব্যক্তিত্ব, গড্ডেস অফ উইজডম ড. শ্রীপফা পেটচারামেস্রী।
জন্মসুত্রে থাই, ৬৬ বছর বয়সী আজারন শ্রীপফা ১৯৫৬ সালে থাইল্যান্ডের সুরাতথানি তে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পারিবারিক নাম পেটচারামেশ্রি। পড়াশোনা করেছেন রাজনীতি বিজ্ঞান নিয়ে, আজীবন কাজ করছেন মানবাধিকার নিয়ে। গবেষণা করেছেন রাষ্ট্রহীন মানুষের অভিবাসন, নাগরিকত্ব, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও মানবাধিকার সহ ইত্যাদি নানান বিষয়ে।
১৯৯২ সালে ফ্রান্সের প্যারিস থেকে রাজনীতি বিজ্ঞান ও সাউথ ইস্ট এশিয়ান স্টাডিজ এ পি এইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর জন্ম বা মাতৃভাষা থাই হলেও টহরাবৎংরঃু ড়ভ চধৎরং ঢ-ঘধহঃবৎৎব, থেকে ডক্টরাল করার সুবাদে ইংরেজির পাশাপাশি ফ্রেঞ্চ ভাষায়ও রয়েছে তাঁর বিশেষ দক্ষতা। ১৯৯৬ সাল থেকে থাইল্যান্ডের মাহিদলের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস স্টাডিজে পড়াচ্ছিলেন অসাধারণ এই শিক্ষাবিদ, শিক্ষক।
২০০৮ সালে কা পেপে ডীওকন হিউম্যান রাইটস এওয়ার্ড বিজয়ী এবং ২০১৭ সালে অসলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান সূচক ডক্টরাল পাওয়া এই শিক্ষকের মানবাধিকার বিষয়ক জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা আঞ্চলিক পরিমণ্ডল ছারিয়ে বহু আগেই পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আর তাই সীমানা ছাড়িয়ে ড. পেটচারামেস্রি আন্তর্জাতিক।
গত দুই দশক ধরে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের এথনিক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে গবেষণা এবং পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে লড়াই করে যাওয়া ড. শ্রীপফা থাইল্যান্ডের মানবাধিকার চর্চা এবং প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে একটি অনন্য নাম। আন্তর্জাতিক মানাবাধিকার এর টুলস এবং ম্যান্ডেট বিষয়ে তাঁর আছে অসামান্য জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা। সাথে সাথে সমান পারদর্শী আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান, পাঠদান এবং হিউম্যান রাইটসের চর্চায়ও। সাউথ – ইস্ট এশিয়া এবং এশিয়া প্যাসিফিকের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও তিনি মানবাধিকার বিষয়ে পড়িয়ে থাকেন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে মানবাধিকার এবং সুবিধা বঞ্চিতদের আইনী মর্যাদা বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন ইউনিসেফ, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা, আইওএম সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চর্চা কেন্দ্রে। মানবাধিকার পর্যবেক্ষণে কাজ করেছেন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। তাছাড়া রিসোর্স পারসন হিসেবে কাজ করেছেন থাইল্যান্ডে জাতিসংঘের বিভিন্ন সময়কার বিশেষ মানবাধিকার মিশনে। হিউম্যান রাইটস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কুড়িয়েছেন সুশীল সমাজ সহ সর্ব পর্যায়ের মানুষের সাথে কাজ করার দারুণ সব অভিজ্ঞতা।
মানবাধিকারেরে জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়া এই নারী অধ্যাপক একাই থেকেছেন আজীবন এবং সমাজের ও রাষ্ট্রের জন্য কাজ করে গেছেন। সম্প্রতি লড়ছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার চর্চার প্লাটফর্ম-কনভেনশন এগেইন্সট টর্চার এর পরিচালনা কমিটির সদস্য হতে, থাইল্যান্ডের হয়ে। তিনি শুধু একজন প্রজ্ঞাবান শিক্ষকই নন, এমন এক মানবতাবাদী কর্মী যার আজীবনের সমস্ত লড়াই মানুষের অধিকার সুরক্ষার জন্য নিবেদিত।
তাঁর ডক্টরাল স্টুডেন্টরা বলেন, তিনি একজন অসামান্য শিক্ষক। পিএইচডির মত এমন একটি কঠিন যাত্রায় আমরা হাল ছেড়ে দিই কিন্তু শেষ না হওয়া পর্যন্ত যিনি হাল ছেড়ে দেন না, তিনি আমাদের পথ প্রদর্শক। যিনি একটি দেশ বা অঞ্চলের নন, মানবাধিকার ধারণ এবং চর্চায় তিনি পুরো বিশ্বের। আর তাই তিনি পরম পূজনীয়। এমন একজন কিংবদন্তীতুল্য শিক্ষকের জন্য এই লিখনি আমার গুরু- দক্ষিণা। আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিন্দার চেয়ে গঠনমূলক সমালোচনাই শ্রেয়
পরবর্তী নিবন্ধদু’মেরুর দু’টি সমাজচিত্র