দু’মেরুর দু’টি সমাজচিত্র

রথীন্দ্র প্রসাদ দত্ত | মঙ্গলবার , ১৫ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:৫৪ পূর্বাহ্ণ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিকারগ্রস্থ পুরুষদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। খবরটা ছিল এই। ছোট্ট এই খবরটা বেরিয়েছিলো একযুগেরও আগে। কিন্তু এই ছোট্ট খবরটা তখন অনেকের কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছিলো। তাই এ নিয়ে লেখালেখিও কম হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষদের মধ্যে মনোবিকার বেড়ে যাওয়ার খবরটি একটি সাধারণ এবং ছোট্ট খবর হলেও যে কারণে এই রোগের বর্ধিত হারে পুরুষরা আক্রান্ত হচ্ছে সে কারণটিই ছিলো অসাধারণ এবং চমকপ্রদ। যে কারণে তখন তা বিস্ময়ের আলোড়ন তুলেছিল। বলা হয়েছিল, মার্কিন মুল্লুকের তন্বী তরুণী ও গৃহিনীরা তাড়াতাড়ি মোটা হয়ে যান বলেই মার্কিন পুরুষেরা মনের দুঃখে বিমর্ষ থাকতে থাকতে মনোবিকারগ্রস্থ হয়ে পড়েন।
এতোকাল ধরে জেনে এসেছি নারীরা রূপ কিংবা সৌন্দর্য যা কেবল পুরুষ আপন মনের মাধুরী দিয়েই আপন করে তোলে কোনো বিশেষ মাপকাঠি দিয়েই এই রূপের পারিমাপ করা যায় না। ইঞ্চি ফুটের পরিমাপ করার কথা সে তো আসতেই পারে না।
কিন্তু মার্কিন মুল্লুকে তাই আসছে। সেখানে তন্বী ললনা প্রেমিকাদের মোটা হয়ে যাওয়ার জন্যই বর্ধিতহারে পুরুষদের মনোব্যথার কারণ হয়ে মাথা বিগড়ে দিচ্ছে। এবং এই সব মাথা খারাপ লোকদের নিয়ে মার্কিন কর্তাব্যক্তিদের মাথা ঘামতে শুরু হয়েছে। বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। বলা হয়েছে, সেখানে সমাজের অপেক্ষাকৃত বিত্তশালী পরিবারের চেয়ে সাধারণ পরিবারের মেয়েরাই নাকি মেদ বেড়ে মুটিয়ে যায়। এর কারণ হিসেবে যা বলা হয়েছে তা আরও বিস্ময়কর। ঘরে এমনকি বাইরেও ওরা যত পায় তত খায়। যখন তখন অতিভোজনই নাকি এইসব তন্বী ললনাদের মুটিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ।
যা হোক, মাথা বিগড়ে যাওয়া এইসব প্রেমিক পুঙ্গ পুরুষদের দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধিতে নাকি মারাত্মক সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পাগলদের চিকিৎসার জন্য প্রতি বছর যা ব্যয় হয় তা নাকি এশিয়া আফ্রিকার অনেক দেশের মোট বার্ষিক বাজেটের চেয়েও অনেক বেশি। বুঝুন ঠ্যালা! এর পরেও তাজ্জব না বলে উপায় কি! এখন আমাদের দেশের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যাক।
যে কারণে মার্কিন মুল্লুকের পুরুষরা গণ্ডায় গণ্ডায় পাগল হয়ে মার্কিন কর্তাদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে আমাদের দেশে এটা কোনো সমস্যাই নয়। নারীর রূপ কিংবা সৌন্দর্যবোধ নিয়ে এখানে কোনো বিকার দেখা দেয়নি। এখানে সরু মোটা মাঝারী প্রশ্নটাই অবান্তর বরং সাধারণের চেয়ে মোটা মহিলারা ভব্য এবং ভারিক্বি বলেই এখানে পরিগণিত হয়ে থাকেন। ভারি চেহারাকে এখানে রূপ এবং সৌন্দর্যের বিশেষ প্রকাশ বলে সর্বত্র ধরে নেওয়া হয়। আমাদের গল্পে নিতস্বিনী রমনীরা উপেক্ষিত তো ননই বরং বিশেষভাবে সমাদৃতা।
তাছাড়া আমাদের দেশের নিম্নবিত্ত সাধারণ পরিবারের মেয়েদের কথাই ধরা যাক। ধারাবাহিক অপুষ্টির শিকার হয়ে যেখানে আমাদের ঘরের মেয়েরা কঙ্কালসার হয়ে গিয়ে কুড়িতেই বুড়ি, সেখানে মার্কিন মুল্লুকের মেয়েরা মুটিয়ে গিয়ে তাদের প্রেমিকদের মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। আমাদের যেখানে ক্ষুধা মেটানো কিংবা খেতে না পাওয়াই প্রধান সমস্যা সেখানে সমস্যা হলো অতিভোজনের।
মার্কিন মুল্লুকের পুরুষ সমাজের মাথা বিগড়ে যাওয়ার খবরটির মধ্যে দিয়ে ইয়াংকি সমাজের মানসিক বোধের বিতর্কিত এবং অবক্ষয়ের যে চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের সমাজকে এ ধরণের বিড়ম্বনা স্পর্শ করতে পারে নি। বোধ এবং রুচির বিকৃতি যে মারাত্মক অবক্ষয় ডেকে আনে ইয়াংকি সমাজ অনেক আগেই তার শিকার হয়েছে। মনে আছে খবরটা বেরোবার পর পরই তখন কোনো একটা কাগজে সাহস করে নিবন্ধ লিখে ফেলেছিলাম। তা পড়ে পরিচিত দুয়েকজন বিদগ্ধ ব্যক্তি অল্প বয়সের ঐ লেখাটির বিস্তর তারিফ করেছিলেন।
কিন্তু সুদীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় পরে সেই বিশেষ খবরটার কথা টেনে নিয়ে নিজেদের ঘরের কথা বলতে হবে তা কে জানতো। খবর বেরিয়েছে, বিশেষ করে দুঃসহ দারিদ্র্যের কারণে বাংলাদেশের তিন কোটির বেশি লোক ইতিমধ্যেই ভারসাম্য হারিয়েছে। যদিও পারিবারিক এবং অন্যান্য কারণের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে তবু নিদারুণ দারিদ্র্যতাই এই মনোবিকারের মুখ্য কারণ। দেখা যাচ্ছে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ মানসিক ব্যাধিগ্রস্থ তা দারিদ্র যে আমাদের কী সর্বনাশ করে চলেছে মস্তিষ্কবিকৃতির এই বিপুল সংখ্যা তার একটি বাস্তব চিত্র। এখানে দুঃখ শোক অভাব জটিলতা যত বাড়ছে ততই তীব্র হচ্ছে জীবনের বিড়ম্বনা। দুঃসহ দারিদ্র জীবন যন্ত্রনাকে প্রতি মুহূর্তে বাড়িয়ে তুলেছে। জীবনধারণকে করে তুলেছে একরূপ অর্থহীন। অবলম্বনহারা অসহায় মানুষেরা এখানে হন্য হয়ে ফিরছে। কিন্তু নির্ভরতার সব দায় রুদ্ধ দ্বারে মাথা কুটে কুটে প্রতিদিন এখানে কত মানুষ মুক্ত হওয়ার পথ খুঁজে খুঁজে মরছে তার কতটুকু হিসেব আমরা রাখি!
হাজার সমস্যা, হাজার সংকট সহগ্রবিধ বিড়ম্বনা মানুষকে এখানে প্রতিদিন তাড়িয়ে বেড়ায়। কিন্তু এগোবার পথ নেই, পথ নেই পরিত্রাণের। দারিদ্র্যের তাড়নায় জীবন সেখানে বিড়ম্বিত উপায় বলতে যেখানে, কিছু নেই, যেখানে মানুষ এখনো বেঁচে থাকার জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারছে, প্রতি পদক্ষেপে নিদারুণ ব্যর্থতা সত্ত্বেও মানুষ এখনো পা বাড়াতে এতো দুর্বিপাকের মধ্যে আরো অনেকেই যে এখনো মাথা ঠিক রাখতে পারছে সেটাই তো পরমাশ্চার্য ব্যাপার! এটাই তো বিস্ময়কর। যেখানে প্রতি মুহূর্তে এত দারিদ্র্যের মধ্যে মাথা ঠিক রাখাই সমস্যা -সেখানে তিন কোটি লোকের পাগল হয়ে যাওয়াটা কি খুব বেশি? জীবনের সমস্যা বা জটিলতা যেভাবে বাড়ছে যদি মোট জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষই উন্মাদ হয় তাতেও অবাক হওয়ার কী থাকবে।
যদিও তিন কোটি মানুষের পাগল হওয়ার কথা বলা হয়েছে তবুও প্রকৃত অর্থে পাগল হয়নি এমন নিরুপায় মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। ধারাবাহিক অপুষ্টি এবং দারিদ্র্য জনিত ব্যাধির শিকার হয়ে অনেকেই নরকবাসে বাধ্য হচ্ছে। যদিও তারা হিসেবের বাইরে।
আবার মার্কিন মুল্লুকের কথায় ফিরে যেতে হয়। যেখানে বিকৃত মানসিকতার রোগীদের চিকিৎসার জন্য যা ব্যয় হয় তা আমাদের মতো অনেক দেশের মিলিত মোট বার্ষিক বাজেটের চেয়েও অনেক বেশি এবং এই ব্যয়ের পরিমান ক্রমেই বাড়ছে। আমাদের এখানে? তিন কোটিরও বেশি মানসিক ব্যধিগ্রস্ত রোগীর জন্য চিকিৎসক মাত্র এক হাজারের কিছু বেশি। দারিদ্র্যের নিরুপায় শিকার ক্রমবর্ধমান এই বিপুল সংখ্যক ব্যাধিগ্রস্থের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধের এই ছিলো নমুনা।
যদিও যে শোষণ বঞ্চনা সাধারণ জীবনের সকল দুর্গতির জন্য দায়ী ব্যাধিগ্রস্থ এই আর্থ সমাজ ব্যবস্থাকে সারিয়ে না তোলা পর্যন্ত এখানে ব্যক্তি কিংবা সমাজ জীবনের প্রকৃত নিরাময় আশা করা যায় না। তবু সাধারণভাবে ব্যধিগ্রস্থদের সারিয়ে তোলার ব্যবস্থা অবশ্যই থাকা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমাদের মতো এমন নির্বিকার, সকল দায় দায়িত্ব এড়িয়ে নির্বিবাদে হাই তোলার মতো মানসিকতা আর কোথাও কি আছে?
পরিশেষে বলি, মূল কারণ যেখানে দারিদ্র, ভয়াবহ দারিদ্র্য যেখানে আমাদের সব কিছু গ্রাস করে চলেছে। দারিদ্র্যের অভিশাপে গোটা সাধারণ জনজীবন আজ যখন একরূপ বিপর্যস্ত, তাই দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আমাদের এর সমাধান অর্জন করতে হবে। এবং যে সমাজব্যবস্থা অর্থনৈতিক বৈষম্যের মধ্যে দিয়ে এই দারিদ্র্যকে প্রকট করেছে তার আমুল পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে শুধু দারিদ্র্যকে নির্মূল করা সম্ভব। আমাদের সঙ্গে দুস্তর পার্থক্য সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক সমস্যার মূলও ওখানেই। বিপরীতধর্মী দুটি চিত্র হলেও ব্যাধিগ্রস্থ ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ব্যবস্থাকর অবক্ষয়েরই দুটি ভিন্নরূপ।
লেখক : সাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষক : জীবনের পাঠদান যাঁর হাতে
পরবর্তী নিবন্ধধরণীর বুকে ধ্বংসের চিহ্ন! বধিবে কে