ধরণীর বুকে ধ্বংসের চিহ্ন! বধিবে কে

অনুপ দাশগুপ্ত | মঙ্গলবার , ১৫ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:৫৫ পূর্বাহ্ণ

আকাশ থেকে তোলা আমাজন অরণ্যের একটি আলোকচিত্র বিশ্বব্যাপি আলোড়ন তুলেছিল, এ বছরের জুলাই’ মাসে। ছবিটি তুলেছিলেন রয়টার্সের এক ফটো সাংবাদিক। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, আমাজন অরণ্যের বিস্তীর্ণ ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। অজগ্র গাছ-গাছালি মনুষ্য সৃষ্ট অত্যাচারের কারণে পুড়ে ছাই হযে গেছে। ওই বিস্তীর্ণ জঙ্গলে এখন দেখা যাচ্ছে গভীর ছাইচাপা ক্ষত। ধু-ধু মরুভূমি ও ছাইভস্ম। মানবকূলের বন্ধু এই প্রাকৃতিক অরণ্যের আজ এই বেহাল দশা কেন? অকৃতজ্ঞ মানবজাতি প্রকৃতির এই বোকা কান্না কি শুনতে পায়! এই উপমহাদেশের বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু তাঁর বিখ্যাত গবেষেণা গ্রন্থ ‘অব্যক্ত’-তে প্রায় একশত বছর আগে বলেছেন -‘গাছের যেহেতু প্রাণ আছে, তাই তাদেরও ব্যথা বেদনা, হাসি কান্না আছে। যা মানব জাতি হয়তো শুনতে ও দেখতে পায় না। গাছের জীবন ও জীবিকা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জলবায়ুর সাথে নিবিড় ভাবে জড়িত’।
আজ থেকে দেড় দশক আগে আইপিসিসি এবং আল গোর যৌথ ভাবে শান্তিতে নোবেল পাওয়ার পর থেকেই কি জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসাত্নক রূপরেখা পশ্চিম বিশ্বের সাধারণ মানুষের কাছে বেশি স্পষ্ট হলো ? তার কিছু বছর পর সুদূর স্টকহোমের কোনও এক আশ্চর্য মেয়ে (গ্রেটা থুনবার্গ) জাতিসংঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিশ্বের তাবৎ রাজনৈতিক নেতাদের ভর্ৎসনা করলেন তাঁদের যুগান্তরের নিষ্ক্রিয়তার জন্য, বললেন, ‘কী সাহস তোমাদের!’ পরিবেশ নিয়ে আলোচনা আর সিরিয়াস বৈঠকে আটকে থাকল না, ড্রয়িংরুমে নেমে এল। এই প্রথম।
জাতিসংঘের জলবায়ু সংক্রান্ত ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ’ বা সংক্ষেপে সিওপি(কপ) তো হয়ে আসছে সেই ১৯৯৫-এর বার্লিন সম্মেলন থেকেই। পরিকল্পনা হয়েছে বিস্তর। দড়ি-টানাটানি হয়েছে আরও বেশি। অতিমারি কোভিডের জন্য বছরখানেক থমকে থাকার পর যখন ২০২১-এ সিওপি-২৬ সংগঠিত হল গ্লাসগোতে, অবাক বিস্ময়ে পৃথিবী দেখল একটা জলবায়ু সম্মেলন নিয়েও মিডিয়া, এমনকি সাধারণ জনতারও কতটা মাতামাতি সম্ভব।
এবছর ৬-১৮ নভেম্বর’২২ মিশরের অবকাশ শহর শার্ল আল-শেখ শহরে ‘সিওপি-২৭’ শুরু হওয়ার আগেই আমাজনের অরণ্য নিয়ে জলবায়ু কর্মীদের উৎফুল্ল হওয়ার কারণ ঘটেছে বিলক্ষণ। সদ্যসমাপ্ত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী লুলা দা সিলভা ভোটের আগেই নির্বিচারে আমাজন উজাড় বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এমনিতেই বৃষ্টিচ্ছায় অরণ্য ধ্বংসের প্রেক্ষিতে তৈরি হওয়া দুনিয়ার উষ্ণায়নের ফলে উদ্ভুত হয়েছে প্রলয়কালের পরিস্থিতি। মানুষ যেন এক বিপন্ন প্রজাতি। যে আমাজনের অরণ্য ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ নামে পরিচিত, তা আজ যতটা কার্বন ডাই অঙাইড তৈরি করে, শুষে নেয় তার চাইতে কম। আগের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর আমলে নির্বিচারে ধ্বংস করা হয়েছে আমাজন, প্রধানত কৃষিজমি, মাংস উৎপাদন এবং খননের প্রয়োজনে। গত বছরই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি। আপাতত নতুন প্রেসিডেন্ট লুলা আসার ফলে আমাজন নিয়ে উদ্বিগ্নতা শেষ হলেও, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয় ক্ষতির চরম মূল্য দিতে হচ্ছে বাংলাদেশ সহ আফ্রিকার মতো অনেকে দেশকে। ঐতিহাসিকভাবে আফ্রিকা বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের মাত্র ৪ শতাংশের জন্য দায়ী। অথচ আফ্রিকা ও বাংলাদেশের মানুষ জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে বেশি ভুগছে। এবারের জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৭ এমন এক সময়ে শুরু হয়েছে, যখন ইউক্রেন যুদ্ধ-সৃষ্ট জ্বালানি সংকটে বিশ্ব আবার জীবাশ্ম জ্বালানিতে ফিরছে। এতে বৈশ্বিক উষ্ণতা আরো বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তর ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় ধরিত্রীকে সুরক্ষার জন্য এ সম্মেলনকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন জলবায়ুকর্মীরা। তবে প্রশ্ন উঠেছে, আফ্রিকার জলবায়ু সংকট নিরসনে এ সম্মেলন সহায়ক হবে কি? নভেম্বর মাসের প্রথমে এক সভায় জাতিসংঘের মহা সচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ‘ঐতিহাসিক চুক্তিতে’ পৌঁছার সময়, যাতে ধনী দেশগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তর বেগবান করতে দরিদ্র দেশগুলোকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা জোগাতে পারে’। তিনি আরও বলেন,‘এ চুক্তি না হলে আমাদের সর্বনাশ হবে। কারণ উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় অর্থনীতির জন্য আমাদের কার্বন নিঃসরণ কমানো প্রয়োজন’ (দৈ:আজকের পত্রিকা, ৫ নভেম্বর’২২)।
জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত এক দেশের নাম হলো বাংলাদেশ। যদিও বাংলাদেশ বন্যা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনেক অগ্রগতি করেছে এবং স্থানীয়ভাবে পরিচালিত অভিযোজন বিশ্বে নেতৃত্বও দিচ্ছে, তবে তা যথেষ্ট নয়। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতি বছর বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশ। সম্প্রতি প্রকাশিত স্টকহোম এনভায়রনমেন্ট ইনস্টিটিউশনের প্রতিবেদনে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সংঘটিত ক্ষতি মোকাবেলায় ও মেরামতে বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবারগুলো বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে। উল্লেখ্য,এ ব্যয় বার্ষিক সরকারি ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ এবং বহুপক্ষীয় সংস্থা গুলোর আবেদনের ১২ গুণ বেশি (বণিকবার্তা, ১১ নভেম্বর’২২)। এ থেকে সহজে অনুমেয়, আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলো এবং জলবায়ু অর্থায়ন বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
২০০৯ সালে বৃটিশ তথ্যচিত্র ‘দ্য এজ অব স্টুপিড’ ছবিটি বড় ধরনের হইচই ফেলে দিয়েছিল। ছবিটি যেন এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের আলেখ্য ২০৫৫ সালে জলবায়ুর পরিবর্তন বিপর্যয় এনেছে বিশ্ব জুড়ে; বন্যায় ভেসে গিয়েছে লন্ডন, সিডনি জ্বলছে, মরুভূমি গ্রাস করে নিয়েছে লাস ভেগাস-কে; বর্ষণ-স্নাত আমাজনের নিবিড় অরণ্য পুড়ে খাক, আল্পাস পর্বত থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে তুষারের স্নিগ্ধ স্পর্শ; পরমাণু যুদ্ধ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে ভারতকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে এক সংরক্ষণ বিদকে দায়িত্ব দেওয়া হয় মানুষের বহু যুগ ধরে সঞ্চিত জ্ঞান এবং শিল্পের রক্ষনাবেক্ষণের। প্রায় বরফ-শূন্য সুমেরু ভূখণ্ডের উপান্তে বিশাল সংরক্ষণাগারে একক মানুষটি দেখে আধ শতক আগেকার দুনিয়ার ছবি-২০০৮-এর আর্কাইভাল ফুটেজ। বিস্মিত হয় সে। প্রশ্ন করে, সুযোগ থাকতে কেন মানবজাতি জলবায়ুর পরিবর্তন আটকায়নি? তথ্যচিত্রটি যেন ভবিষ্যতের কল্পিত পটভূমিতে দাঁড়িয়ে অতীতের, অর্থাৎ আজকের নীতি এবং কাজকর্মের পর্যালোচনা। ‘দ্য টাইমস’ ছবিটিকে বলেছে জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক আত্নতুষ্ঠির উপর সব চাইতে বড় নাটকীয় আক্রমণ। ছবিটির শক্তির জায়গা হল তা সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে দিনের অন্তিমকালের, সেই সঙ্গে অন্বেষণ করেছে বিকল্প পথের, তুলে ধরেছে অপরাধীদের নামও। এই তথ্যচিত্রটির সমকাল সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে ২০১৫-র প্যারিসের সিওপি-২১ সম্মেলনটা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিস্তর আলাপ আলোচনায় তৈরি হয় ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তি, স্বাক্ষর করে ১৯২ টি ’পার্টি’। এই শতকের মাঝামাঝি নাগাদই অর্জন করতে হবে ‘নেট জিরোর’ লক্ষ্যমাত্রা। অর্থাৎ, প্রতিনিয়ত তৈরি হয়ে থাকা বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই -অক্সাইডের পুরোটাই দূর করতে হবে যে কোনো ভাবে। প্যারিস চুক্তির সার্থকতার লক্ষ্যে গ্রিনহাউস গ্যাসের নি:সরণ কমাতে বিভিন্ন দেশ কী পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল গত ২০২১ এর গ্লাসগো কপ-২৬ সম্মেলনে। কিন্তু দৃশ্যমান কোনও কার্যকর পদক্ষেপ ২০২২ এসেও দেখেনি বিশ্ব।
প্যারিস থেকে গ্লাসগোর সম্মেলন, এর মধ্যেই সাতটি বছরের ব্যবধানে পরিবেশ নিয়ে মানুষের সচেতনতায় চোখে পড়ার মতো বদল ঘটেছে।এই সচেতনতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ অবশ্যই উপরে বর্ণিত সুইডিশ অষ্টাদশী গ্রেটা-থুনবার্গ যিনি ভয় পেয়েছেন মর্তলোকের মহাকালের নতুন খাতার পাতা জুড়ে একটা শূন্য নামার। এই ভয় চিত্রিত হয়েছে ‘ দি এজ অব স্টুপিড’ তথ্য চিত্রেও।
গ্রেটা থুনবার্গ তাঁর ভয়টাকে সঞ্চারিত করেছেন পৃথিবী জুড়ে নাড়া দিতে চেয়েছেন আজকের‘স্টুপিড’দের। বস্তুত, পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়ন, মাত্রাতিরিক্ত বায়ু ও পানি দূষণের মতো বিষয়গুলোকে স্কুলপাঠ্য রচনা আর টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের বাইরে সাধারণ মানুষের আলোচনায় নিয়ে আসার পুরো কৃতিত্ব এই সুইডিশ তরুণীর। গত বছরের নভেম্বরে কপ-২৬ জলবায়ু সম্মলেন শেষে গ্লাসগো ঘোষণায় ধনী দেশগুলোর ওপর কার্বন কর বসানোসহ আরও বিভিন্ন বিষয়ে চূড়ান্ত মতৈক্যে আসতে পারলেও তা বাস্তবায়ন সুদূরপরাহত থেকে যায়। এবারও মিশরে গত ৬ নভেম্বর শুরু হওয়া কপ-২৭ সম্মেলন ১৮ নভেম্বর শেষ হওয়ার পথে, দিন শেষে পরিবেশের প্রাপ্তির ঝুলিতে কী থাকবে? তা যেমন প্রশ্ন সাপেক্ষ এবং কতটা বাস্তবায়িত হবে ‘নেট জিরো’র লক্ষ্যমাত্রা, তাও প্রশ্ন বোধক হয়ে থাকবে।
এ পৃথিবীর ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে ঘুরতেই থাকে, হতে থাকে সম্মেলনের পর সম্মেলন। দুনিয়ার কার্বন নি:সরণ বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে। বাড়তে থাকে তাপমাত্রাও। ২০৫৫ হোক বা ২০৬৫, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মেঘ ভবিষ্যতের ঈশান কোণে পুঞ্জীভূত হতেই থাকে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদু’মেরুর দু’টি সমাজচিত্র
পরবর্তী নিবন্ধউদয়ন সংঘে শিক্ষা সামগ্রী বিতরণ