শিক্ষকদের সম্মান যেন হুমকির মুখে না পড়ে

ববি বড়ুয়া | শুক্রবার , ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ১০:২৯ পূর্বাহ্ণ

কতোদিন আগে সকালে ঘুম ভাঙা চোখে মুঠোফোনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ বুলাতে গিয়ে চোখে পড়ে আমাদের শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যরিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী এমপি মহোদয়ের একটি লেখা। লেখাটি ছিলো তাঁর শৈশবের একজন শিক্ষক যিনি তাঁর আদর্শ হয়ে আছেন বয়সের এই সময়েও।

 

লেখাটি পড়ে অন্য রকম এক মুগ্ধতা ছেয়ে গিয়েছিল মনের অগোচরে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় একজন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষ, যাঁর সময়ের পইপই হিসেব রেখে চলতে হয় ঘড়ির কাঁটা হিসেব করে; তাঁর মতো মানুষের এমন স্মৃতিকাতর লেখা তাও আবার শৈশবে ফেলে আসা শিক্ষককে নিয়ে। যা আমাকে বিশেষ ভাবে মনের দরজায় আলোড়ন সৃষ্টি করে।

যেখানে তিনি তাঁর চমৎকার সহজ সরল ভাষায় বর্ণনা করেছেন তাঁর ছোট্ট বালক নওফেল হতে আজকের উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান এমপি মহোদয় হয়ে ওঠার গল্প। তিনি তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন বাংলা মাধ্যম হতে আসা অমনোযোগী, দুষ্টমিষ্টি বালক হতে একজন শিক্ষকের ভালোবাসা আর স্নেহে ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হয়ে লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিকস, কলেজ অফ লপড়তে পারার যোগ্য হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর প্রিয় শিক্ষক সাফিয়া রহমানের ভূমিকার কথা।

সানশাইন গ্রামার স্কুলের কথা। সেখানে তিনি এটাও উল্লেখ করেছেন, ‘নাসিরাবাদ স্কুল, কলেজিয়েটের রাজকীয় অবকাঠামো ছেড়ে সানশাইনের অবস্থা দেখে আমি রীতিমতো হতাশ ছিলাম প্রথমে! কিন্তু আমার ভ্রম ভাঙতে শুরু করে কিছুদিনের মধ্যেই। স্কুল মানে শুধুই সুন্দর বিল্ডিং না!’ সবার শেষ লাইনটা মনটাকে অন্যভাবে ছুঁয়ে গেলো। কতোখানি কোমল আর পারিবারিক শিক্ষায় পরিপুষ্ট হলে একজন ছাত্রের এমন মনোভাব হতে পারে তা ভাবার বিষয়।

সব মিলিয়ে লেখাটির মূল বিষয়বস্তু ছিলো একজন ছাত্রের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে একজন শিক্ষকের ভূমিকাই প্রধান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো যেখানে তুচ্ছ। এটা নিয়ে লিখবো লিখবো করেও লেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি জীবনের কঠিন বাস্তবতায়। কিন্তু আজ নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এই লেখাটা নিয়ে লেখা সময় ও মনের স্বস্তি প্রাপ্তির দাবি হয়ে উঠলো।

ওমর গণি এম ই এস কলেজে আমার শিক্ষকতা জীবনের বয়স ১৩ বছর। পেশার শুরু থেকেই আজ অবধি লক্ষ্য একটাই, পড়াশোনার চেয়ে আচরণে পরিবর্তন এনে একটি সুস্থ প্রজন্ম উপহার দেয়া। সেই ইচ্ছে পূরণে ৪৫ মিনিটের ক্লাসে ৫/৮ মিনিট কখনো গল্পে, কখনো শাসনে আলোচনা করেছি।

কিংবা যখন যেখানে আমার শিক্ষার্থীদের অসুন্দর আচরণ দেখেছি তখনই আদরে, স্নেহে কিংবা কঠোর চোখে তাদের শুধরে দেয়ার চেষ্টা করেছি নিজের সন্তান জ্ঞান করে। তাই হয়তো আমার হাতে অর্থাৎ দীর্ঘ ১৩ বছরের শিক্ষকতার সময়ে পাশ করা ছাত্র আমার সামনে এমন কোনো অসদাচরণ করেনি যার কারণে আমি অসম্মানিতবোধ করতে হয়।

আর ঠিক এই কথাটিই যখন যেখানে গিয়েছি গল্প আড্ডায় কিংবা বিভিন্ন সভা সেমিনারে উল্লেখ করেছি সদর্পে। কিন্তু আজকের একটি ঘটনা আমার সমস্ত অহংকার ভেঙে খানখান হয়ে গেলো।

এই প্রতিষ্ঠানে ১২ থেকে ১৩ হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষা লাভে প্রতিষ্ঠানে আসে। আর প্রতি বছর একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয় ২৫০০শিক্ষার্থী । যেহেতু এই প্রতিষ্ঠান গৌরবময় ছাত্র রাজনীতির সূতিকাগার। তাই ক্লাস শেষে ছাত্র নেতারা ছাত্রদের রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত করতে ছাত্রদের আহ্বান জানায়।

যদিও অন্য সকল শ্রেণি কক্ষে শিক্ষকদের অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করলেও আমার ক্লাসে কখনো প্রবেশের চেষ্টা কোনো ছাত্র করেনি। তা হয়তো আমাকে সম্মান কিংবা সমীহ করে। এমনও হয় ক্লাসে আমাকে দেখেই যত দ্রুত সম্ভব আড়াল হওয়ার চেষ্টা করেছে।

কিন্তু এই প্রথম বারের মতো একজন ছাত্র যাকে আমি কখনো দেখিনি, বলা চলে বহিরাগত, ক্লাসে আসে এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে প্রবেশের চেষ্টা করে। বাধা দিলে হঠাৎ এমন একটি বিশৃঙ্খল ও অশোভন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যা কখনোই কাম্য ছিলো না। সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীর আর কিছু না হোক শিক্ষকের চোখে চোখ রেখে কথা বলবে তাও একজন শিক্ষকের জন্য মৃত্যুসামিল।

চরম গ্লানি আর অপমানে হৃদয়ের ক্ষত যেন আর সারতেই চায় না। আমার সন্তান আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলবে কোনো পিতামাতাই তা মেনে নিতে পারে না। আমার বেলাতেও তার ভিন্ন হয়নি।

খারাপ হয়তো এজন্য বেশি লেগেছে যে সন্তানদের শুধুমাত্র শিক্ষার্থী নয়, নিজের সন্তান মনে করে ভালোবেসেছি, শাসন করেছি , তাদের জীবন পরিবর্তনের চেষ্টা করেছি তাদের এমন আচরণ মুহূর্তে হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করছিল বারংবার। অবশ্য আমার শিক্ষার্থীরা তাকে এনে বুঝিয়ে তাদের প্রিয় শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চাইয়েছে। এবং সেও নিজের ভুল বুঝতে পেরে মা ডেকে পা ছুঁয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে।

আমিও তাকে বুকে নিয়ে বললাম, বাবারে, এ তো তোদের দোষ নেই রে। সব দোষতো আমার। আমিই তোদের মা রূপে শিক্ষক হয়ে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারিনি। এ যে আমারই ব্যর্থতা। সব দায়ভার যে আমার। আজ আমরা শিক্ষক সমাজ ব্যর্থ আমাদের সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দানে। আজ সমগ্র বাংলাদেশে চালচিত্র বিশ্লেষণ করলে লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। বারেবারে শিক্ষক সমাজ লাঞ্ছিত, অপদস্ত হতে হচ্ছে নিজের সন্তানদের হাতে।

উপরে আমাদের উপমন্ত্রী মহোদয়য়ের লেখার লেশ ধরে বলতে চাই, তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা চট্টলবীর আমাদের সবার ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার আসনে যিনি এখনো একইভাবে আসীন, তাঁর নেতৃত্বের ধরন আলাদা আবার তাঁরই যোগ্য সন্তান যিনি পিতার আদর্শকে একই মাত্রায় লালন করে আমাদের উপমন্ত্রী মহোদয়ের নেতৃত্বের ধরনও ভিন্ন। ঠিক তেমনি একজন আদর্শ শিক্ষক সাফিয়া রহমানের শিক্ষাদানের ধরন এবং আবার অনেক শিক্ষকের শিক্ষাদানের ধরনও ভিন্ন। কিন্তু সকল শিক্ষকের শিক্ষার্থীদের প্রতি ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধের জায়গায় অভিন্ন।

পৃথিবীর সকল পেশার মধ্যে শিক্ষকতা পেশাকেই সম্মানের জায়গায় রাখা হয় সর্বাগ্রে। কিন্তু সেই শিক্ষকদের সম্মানটাই যদি হুমকির মুখে পড়ে তবে সেই শিক্ষককের বেঁচে থাকার কারণ বৃথা হয়ে যায়। সবকিছুর পরেও আশায় বুক বাঁধি আমাদের সন্তানেরা একদিন মানুষ হবে।

স্বশিক্ষায় সুশিক্ষিত হয়ে একদিন আমাদের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এমপি মহোদয়ের মতো কোনো ছাত্র আমাদের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে তাঁর স্মৃতির পাতায়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও কলেজ শিক্ষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনৈতিকতা বিবর্জিত আমাদের ছাত্র রাজনীতি : আমরা কী শিক্ষা দিচ্ছি?
পরবর্তী নিবন্ধতুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্পে নিহত ২১ হাজার ছাড়াল