শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ১৩ নভেম্বর, ২০২১ at ৭:২৫ পূর্বাহ্ণ

ব্যাংককে এলো বাংলাদেশী বন্ধু
আমি থাকতাম থাইল্যান্ডের দক্ষিণের এক শহরে। মাসের চার সপ্তাহের তিন সপ্তাহ অফিসের কাজে কাটাতাম অন্যান্য শহরে। ব্যাংককে আসা হত খুব কম। ২০১৭ সালের মার্চে দুই বন্ধুর আলাদা করে বেড়াতে আসার কথা। ওদের জানিয়ে রাখলাম অন্য শহরে কাজ না থাকলে ব্যাংককে যাবো দেখা করতে। দু’জন যখন তাদের ব্যাংকক যাওয়ার তারিখ জানালো, ওমা! দেখি একই দিন ওরা দু’জনই ব্যাংককে থাকবে। মহা মুশকিল! ওরা আবার কেউ কাউকে চেনে না। দু’জনই আসছে তাদের অফিসের কাজে। কাকতালীয় এবং মজার ব্যাপার হল, শাওনের স্ত্রীর নাম এবং আমার আরেক বন্ধুর নাম একই। সেই বন্ধু নাম প্রকাশে ঠিক স্বস্তিবোধ করছে না বলে ওকে এখানে ‘বান্ধবী’ বলে সম্বোধন করবো। তো, বান্ধবী আসছে ব্যাংককে একটা ট্রেনিং করতে আর ট্রেনিং-এর দুইদিন আগে এসে একটু একসাথে আড্ডা দিয়ে, থাই খাবার খেয়ে, শপিং করে ঘুরে বেড়াতে চায়। এদিকে শাওন আবার থাইল্যান্ড থেকে যাবে চীনে। চীনে বেশ ঠান্ডা, তাই শীতের কাপড় কিনে নিয়ে যেতে হবে এখান থেকে। বান্ধবী আর আমার থাকার ব্যবস্থা হলো পুরোনো ব্যাংককের স্যামসান রোডের একটা হোটেলে। একসাথে বের হলাম আশেপাশের অলি-গলি ঘুরতে। একটা কেমন পাড়া-পাড়া ভাব আছে, অনেক আপন-আপন। নিজের বাড়ির সামনেটায় কেউ দোকান খুলে বসেছে, কেউ রেস্টুরেন্ট দিয়েছে কেউবা ভ্যানে করে ফলমূল ও অন্যান্য জিনিস বিক্রি করছে। খুব ভোরে এখানে মানুষের ব্যস্ততা শুরু হয়। ভোরে এই গলিগুলোতে হাঁটলে দেখা যায় বয়স্ক নারীপুরুষ বাড়ির সামনের আঙিনা, রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করছে; কেউ রান্নার ব্যাবস্থা করছে; স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ প্রাত:ভ্রমণ করছে। এ-বাড়ির মানুষ, ও-বাড়ির মানুষের সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। এ সব দৃশ্যাবলী দারুণ ভাল লাগে। তো, এইসব গলিতেই আমরা হাঁটতে বেরুলাম। ও আগেও ব্যাংকক এসেছে, তাই টুরিস্ট স্পটে যাওয়ার কোন তাড়া নেই। হাঁটতে-হাঁটতে দেখি গলির একটা দেয়াল রঙিন হয়ে উঠেছে। পশ্চিমা ভ্রমণকারী আর স্থানীয় শিল্পী মিলে দেয়ালে আঁকছে। আঁকিয়েরা এঁকে চলেছে, আর পথচারী মানুষ নিজেদের ছবি তুলছে দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে।
বান্ধবীর সাথে আমার পরিচয় ভ্রমণকে কেন্দ্র করেই। ও-একসময় বেশ ঘুরে বেড়াত। একসাথে বেশ কয়েকবার আড্ডা দেয়া হলেও, ওর সাথে একসাথে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। তাই স্বল্প সময়ের এই ভ্রমণ আমরা খুব উপভোগ করছিলাম। রাতে স্থানীয় রেস্তোরায় খেতে খেতে ও বলছিল ওর জীবনের কথা। ২০০১ সালে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে প্রথম যে-কয়জন নারী ক্যাডেট নিয়োগ করা হয়, ও ছিল তাদের একজন। এক বছরের বেশি সময় প্রশিক্ষণ আর কাজ করার পর ও দেখল এই কঠোর শারীরিক পরিশ্রমও করে উঠতে পারছে না। এদিকে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সুযোগও আর নেই। আর ঘরেবাইরে নানা কথা তো শুনতেই হচ্ছে। ভর্তি হয়ে গেল পাসকোর্সে। ইউনিভার্সিটিতে অনার্স না পড়ে, পাসকোর্সে পড়লে সুধীসমাজ বেশ খানিকটা হেয় চোখে দেখে বৈকি! সেইসব সয়ে নিয়ে ডিগ্রি পাস করার পর, এমবিএ করে ঢুকে পড়লো চাকরিতে। আর শুরু করল ঘোরাঘুরি আজ পাহাড়ের কোলে, তো কাল সাগরের তীরে কখনও বান্দরবানের সবুজ পাহাড়, তো কখনও নেপালের সাদা পাহাড়। ঘোরাঘুরি আর চাকরি করে পেরিয়েছে জীবনের চড়াই-উৎরাই। নিজের পায়ে শক্ত করে দাঁড়ালেই জবাব দেয়া হয়ে যাবে মানুষের সব কটাক্ষের, এই এক মনোভাব আজকে ওকে নিয়ে গেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। বাংলাদেশের খুব কম মানুষ জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করে। আর সেই হাতেগোনা মানুষদের মধ্যে ও একজন। আড্ডাবাজ মেয়েটার ভেতরে যে-লড়াকু মানুষটা আছে, তার দেখা পেয়ে নিজের ভেতরে ওর প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করলাম।
পরের দিন দু’জন মিলে গেলাম শাওনের সাথে দেখা করতে। শাওনের সাথে আমার পরিচয় প্রায় পনের বছর আগে। বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ সেবার প্রথমবারের মত ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে বাৎসরিক সম্মেলন করেছে। সেই অনুষ্ঠানে শাওন এসেছিল ওদের শাহজালাল ইউনিভার্সিটির আবৃত্তি দলের সাথে। আমার সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে যায় ওদের দলের প্রায় সবার। আমার প্রথম সিলেট যাওয়া হয়- শাওন আর ওর স্ত্রীর সাথে, সে তখন প্রেমিকা, তাদের প্রেমের একশতম দিবস উৎযাপন উপলক্ষ্যে। সে একসময় কাটিয়েছি বটে! শাওন আমার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ুয়া সংসারী বন্ধু। আমি শাওনের যাযাবর বন্ধু। আমি নারী, শাওন পুরুষ। কিন্তু, এইসব বিষয় এত বছরের বন্ধুত্বে কেউ কখনও টেরই পাইনি। আজ লিখতে গিয়ে কথাগুলো মনে এলো। শাওন ওর ছেলের জন্য শুকনো ফল, বাদাম কিনবে। এসবের জন্য মোটামুটি ঠিকঠাক দামের পাইকারি দোকান আছে ইন্ডিয়া এম্পেরিয়াম মার্কেট এর সামনে চাকরাপাত রোডে। সেখান থেকে চায়না টাউনও কাছ্‌ে। যদিও চায়না টাউনের সব দোকান প্রায় বন্ধ ছিল সেইদিন। সেখানে কেনাকাটা শেষে বান্ধবীকে বিদায় দিয়ে আমি আর শাওন গেলাম সেন্ট্রালওয়ার্ল্ড মার্কেটে ওর শীতের কাপড় কিনতে। ব্যাংককে শীতকাল বলে কিছু নেই। কেবল গ্রীষ্ম আর বর্ষা। কিন্তু, টুরিস্টের জন্য শীতের ভালো কাপড়ই পাওয়া যায়। ইউনি ক্ল থেকে বরফের মধ্যে পরতে পারার মত শীতের কাপড় কিনলাম। এখন ভাবলে মজাই লাগে। এই শাওন লেখাপড়া

করেছে ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। খুব কষ্টে টেনেটুনে কোনমতে পার করেছিল ইউনিভার্সিটির গন্ডি। একটা চাকরি পাবে কিনা, এই নিয়ে ছিল সন্দেহ। আর সেই শাওন দেশের প্রতিষ্ঠিত সিরামিক কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আজকে থাইল্যান্ড, কালকে চীন, এর পরের মাসে ইতালি এভাবে দুনিয়া ঘুরছে। পরীক্ষার ফলাফল ওকে থামিয়ে দিতে পারেনি। নিজের চেষ্টা আজকে ওকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। তারপর অবশ্য সেই চাকরি ছেড়ে ও নিজের ব্যাবসা শুরু করেছে, কর্পোরেট দাস হিসেবে জীবন কাটাবে না বলে।
বিদেশের রাস্তায় দেশের বন্ধুর সাথে ঘুরে বেড়ানোর অনুভূতি প্রকাশ করা খুব কঠিন। খুব আনন্দের বিষয়। আনন্দ আরও বেড়ে যায় যখন সমাজের কাছে প্রায় বাতিল হয়ে যাওয়া মানুষগুলো সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজের যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিদেশের মাটিতে এক হয়।
আমিও ওদের মতো একসময় সমাজের বাতিলের তালিকায় নাম লিখিয়েছিলাম। দুইবার ইন্টারমেডিয়েটে ফেল করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সাইয়েন্স থেকে আর পরীক্ষাই দেব না। কিন্তু, বোর্ডের নিয়ম মেনে আমাকে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে আবার কলেজ ভর্তি বাতিল করবার জন্য। আমি লেখাপড়া ছাড়া এক বছর কাটিয়েছি। তখন আমাকে কেউ লেখাপড়ার কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতাম ‘ মেট্রিক পাস’। প্রায় সবাই একটু থমকে যেত বা ভ্রু কুঁচকে তাকাতো। প্রণব দাদা, যার সাথে আমার পরিচয় সেই সময়ে আবৃত্তি করতে গিয়ে। উনি প্রায় সময় তখন বাসায় এসে আমাকে বোঝাতেন কেন আমার লেখাপড়া করা উচিত। এমন কিছু মানুষের জন্যেই আমি আবার লেখাপড়া শুরু করেছিলাম। সেই ফেলটুস আমি শেষ পর্যন্ত কিন্তু দুই বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছি আর জাতিসংঘের হয়ে দেশে-বিদেশে কাজ করেছি এবং করছি। একটু নিজের ঢোল নিজেই বাজালাম। কেন? সেইসব অভিভাবকের জন্য, যারা নিজের সন্তানের জীবন তামা তামা করে দিচ্ছে ভাল রেজাল্ট করতে হবে, ভাল স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়তে হবে, এর ছেলে এই করেছে, ওর ছেলে সেই করেছে বলে-বলে। আজকের এই তিনজনের কথা সেইসব মানুষের জন্য, যারা ভালো রেজাল্ট হয়নি বলে, ভালো কোথাও ভর্তি হতে পারেনি বলে ভাবছে জীবন মনে হয় ধ্বংস হয়ে গেল। জীবন জীবনের মতো চলে। জীবন কল্পকাহিনীর চেয়েও অদ্ভুত।
‘স্পাইসিরোড’ থেকে কোন ইমেইল এখনো পাইনি। অফিস থেকে জানিয়েছে, আগামী সপ্তাহে পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণের জন্য যাবো, ব্যাংককের কাছেই সমুদ্র তীরের ছোট্ট শহর ‘হুয়াহিন’। খরচ একটু বেশি বলে এই শহরে আগে কখনও যাইনি। এবার অপেক্ষা ‘হুয়াহিন’ ভ্রমণের।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআত্মশুদ্ধি ও গঠনমূলক রাজনীতি
পরবর্তী নিবন্ধনারী নবনীতা, নারীর নবনীতা