নিবন্ধের শুরুতে বরেণ্য কবি বুদ্ধদেব বসু’র ‘বন্দীর বন্দনা’ কবিতার অমূল্য কয়েকটি পংক্তি উপস্থাপন করতে চাই – ‘প্রবৃত্তির অবিচ্ছেদ্য কারাগারে চিরন্তন বন্দী করি’ রয়েছো আমায়-/ নির্মম নির্মাতা মম! এ কেবল অকারণ আনন্দ তোমার!/ মনে করি, মুক্ত হবো; মনে ভাবি, রহিতে দিবো না/ মোর তরে এ-নিখিলে বন্ধনের চিহ্নমাত্র আর।/ ………. জ্যোতির্ময়, আজি মম জ্যোতিহীন বন্দীশালা হ’তে বন্দনাসংগীত গাহিব তব।/ স্বর্গলোভ নাহি মোর, নাহি মোর পূণ্যের সঞ্চয়,/ লাঞ্ছিত বাসনা দিয়া অর্ঘ্য তব রচি আমি আজি :/ শাশ্বত সংগ্রামে মোর আহত বক্ষের যত রক্ষাক্ত ক্ষতের বীভৎসতা,/ হে চিরসুন্দর, মোর নমস্কার-সহ লহো আজি।’ মহান স্রষ্টার মায়াবী মাটি ও মানুষ নির্মিত বৈচিত্রময় গ্রহ এই পৃথিবী। ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে গড়ে তুলেছেন ধর্ম-বর্ণ-অঞ্চল নির্বিশেষে জাগতিক ইন্দ্রিয়বৃত্ত। জ্ঞানমানসের দুর্জ্ঞেয় সত্তায় তপস্যানির্ভর ক্ষণজন্মা স্বল্পসংখ্যক কৃতিমানব এই ধরিত্রীকে করেছেন নতুন অভিধায় অভিসিক্ত। রচিত হয়েছে সমাজ-সভ্যতার ক্রৌর্য-পরিক্রমার দিদৃক্ষা। প্রাসঙ্গিকতায় মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জীবনচরিত অনুধাবনে উল্লেখ্য কবিতায় জ্যোতির্ময় বন্দনা নিবেদন সমরূপ উৎসর্গের নান্দীপাঠ মাত্র।
বঙ্গবন্ধুর মতো আত্মত্যাগের বন্দীশালা থেকে গৌরবদীপ্ত ঐতিহ্যিক ঐশ্বর্যের দিগ্বলয় যাঁরা নির্মাণ করেছেন, তাঁরাই বিশ্বখ্যাত এবং ইতিহাসের অধ্যায়ে যুগান্তর প্রবাহে অতিশয় প্রৌজ্জ্বল। তাঁদের সমাজ-জীবন-রাজনীতি-ধর্ম ও রাষ্ট্রদর্শন যেমন নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ; তেমনি মনন-সৃজনের বিস্ময়কর নমস্যভব্য। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভবার্ণব জন্ম বাঙালি জাতির জীবনে তেমন এক আলোকরশ্মির প্রতিসরণ। শৈশব-কৈশোর থেকে প্রচ্ছন্ন প্রকীর্তির আড়ালে দেশপ্রেম, মানবকল্যাণ এবং আত্নপ্রত্যয়ের সজীব দৃষ্টান্ত স্থাপনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন কিংবদন্তী ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গত ২৮ জানুয়ারি লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিঙের সাউথ এশিয়া সেন্টার আয়োজিত বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সমাজের সমতা প্রতিষ্ঠা এবং ধর্মকে রাজনীতির বাইরে রাখার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে মতাদর্শ, তা এখনও সারা পৃথিবীর জন্য প্রাসঙ্গিক। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার না করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর শক্তিশালী স্বতন্ত্র যে ধরণ ছিল, বর্তমান সময়ে তার বিস্তৃত ব্যবহার রয়েছে। যা কেবল বাংলার জন্য নয়, সারা পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’ অনবদ্য বিশ্লেষণে অধ্যাপক সেন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়নে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে বিশেষভাবে উপস্থাপনের বিষয়টি তুলে ধরেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘বঙ্গবন্ধুর সেকুলারিজম ধারণার মানে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে না, এমন নয়। সেটা ছিল ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার হবে না।’
তিনি বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা দর্শন ব্যাখ্যায় ষোড়শ শতকের সম্রাট আকবরের মতাদর্শের তুলনামূলক আলোচনায় বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও আকবরের মতাদর্শ এখনও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটা কেবল ভারতে ব্যবহৃত হতে পারে তা নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও প্রাসঙ্গিক।’ উক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে দেশের বরেণ্য অর্থনীতিবিদ সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্রের ধারণা এসেছে তাঁর উদঘাটিত অভিজ্ঞতার আলোকে। কারণ তিনি তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে তাঁর রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ করেছেন।’ প্রফেসর সোবহানের উপলব্ধিতে বঙ্গবন্ধুর প্রণিধানযোগ্য আদর্শিক ভিত্তি ছিল, ‘আমাদেরকে এমন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই হবে সম্পদ তৈরি এবং উপকারভোগী হওয়ার ক্ষেত্রে অংশীদার ও শাসক। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল এজেন্ডা।’ বস্তুতপক্ষে যে বিস্ময়কর জীবনচরিত বঙ্গবন্ধু নির্মাণ করেছেন; তার মূলে ছিল দেশপ্রেম-মাটি ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং সকল ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তির লক্ষ্যে অবিনশ্বর আত্মত্যাগ।
জীবনপঞ্জিকার ন্যায়োপেত মহাকাব্য ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের সূত্রমতে বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন ফরিদপুর জেলার দক্ষিণ অঞ্চলের সর্বশেষ ইউনিয়ন মধুমতী নদীর পাশেই গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। সুপরিচিত এবং সম্মানিত মধ্যবিত্ত শেখ পরিবারেই বঙ্গবন্ধুর জন্ম। ১৪৬৩ সালে এই জনপদে পদার্পণ করেছিলেন অতি উঁচুমার্গের আধ্যাত্নিক সাধক হযরত সুলতান বায়েজিদ বোস্তামী (রঃ)। তাঁর দক্ষিণহস্তখ্যাত দরবেশ শেখ আউয়ালের বংশধর শেখ বোরহানউদ্দিন এই শেখ বংশের গোড়াপত্তন করেছিলেন। প্রায় দুইশত বছর প্রাচীন দালানসমূহের ধ্বংসাবশেষ এই বংশের ঐতিহ্যকে নীরন্তর জানান দিয়ে চলেছে। এই শেখদের নৌযানের ব্যবসা এবং সংশ্লিষ্ট নৌকার বহর আটকে রেখে মাঝিদের দিয়ে অমানুষিক কাজ করিয়ে নিতেন জনাব রাইন নামক ব্রিটিশ বেনিয়ার কুখ্যাত প্রতিনিধি। আদালতে জয়ী হয়ে জরিমানা আদায়ের মাধ্যমে শেখ পরিবার প্রথম অত্যাচারের প্রতিশোধ নিলেন এই প্রতিনিধির বিরুদ্ধে।
বঙ্গবন্ধুর শৈশব কৈশোর কেটেছে বেরিবেরি হৃদরোগ এবং গ্লুকোমা নামক চক্ষুরোগের যন্ত্রণা চিকিৎসায়। স্বভাবতই পড়াশোনায় একটু পিছিয়ে পড়েছিলেন। গৃহশিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি মহোদয় গঠিত ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র মাধ্যমে সহপাঠীদের সমন্বয়ে মুষ্টি ভিক্ষার চাল সংগ্রহ ছিল জীবনের প্রথম জনকল্যাণমুখী কাজ এবং তা বিক্রি করে গরীব শিক্ষার্থীদের বই ও পরীক্ষা সংক্রান্ত খরচ মিটানো দিয়েই মাঙ্গলিক ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ব্রত যেন তখনই বপন করেছেন। প্রসঙ্গত রবীঠাকুরের প্রয়াণ পূর্ব ‘প্রথম দিনের সূর্য’ শিরোনামে কবিতায় উচ্চারিত পংক্তি ‘প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল/সত্তার নতুন আবির্ভাব- কে তুমি মেলেনি উত্তর।/বৎসর বৎসর চলে গেল।/দিবসের শেষ সূর্যশেষ প্রশ্ন উচ্চারিল/পশ্চিম সাগর তীরে নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়-কে তুমি? পেলনা উত্তর।’ জীবন সায়াহ্নে রচিত রবীঠাকুরের কবিতায় যেন বঙ্গবন্ধু খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর জন্মসত্তার যথার্থ উপাদান এবং বিশ্বমানবতার জয়গানে নিজেকে নিবেদন করার স্বয়ম্ভু দর্শন।
বঙ্গবন্ধুর প্রিয় লেখক ও সমাজচিন্তক বারট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, ‘যখন কেউ সাধারণ প্রশ্ন করেন তখন দর্শনের সৃষ্টি হয় এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তাই।’ বঙ্গবন্ধুর হৃদয়গভীরে প্রোথিত ছিল এইসব অমরবার্তা। বাংলা ও বাঙালির স্বরূপ সন্ধানে সম্ভাবিত বলয় তৈরি করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু স্বমহিমায়। ধারাবাহিকতায় বলা যায় বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনায় আরেক মহান রাজনীতিকের প্রভাব ছিল অফুরন্ত। তিনি হলেন রবীঠাকুরের ভাষায় ‘যৌবনের মূর্ত ও চিরবসন্তের উজ্জ্বল প্রতীক’ জওহরলাল নেহেরু। অপরিমেয় প্রতিভা, বিনয়ী আচরণ, নির্মল আদর্শনিষ্টা এবং বিশ্বজনীন সৌহার্দের অবিচল কারিগরী কৌশল নেহেরুকে যেমন প্রতিষ্ঠিত করেছিল বিশ্ব দরবারে অনন্য ব্যক্তিত্বে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন দুর্বার যৌবনের বৃত্যাভাসে উদ্ভাসিত কঠিন তরঙ্গ যা কিছুতেই হার না মেনে এগিয়ে চলাকে ঋদ্ধ করেছেন। হয়েছেন জাতীয়তাবাদি ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শিক বিশ্বনেতার কীর্তনআবর্ত।
বঙ্গবন্ধু মাত্র পঞ্চান্ন বৎসরের জীবনকালে প্রায় বার বছর কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। ব্রিটিশ মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা প্রয়াত লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে বলেছিলেন, ‘এক অর্থে জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্না গান্ধী ও ডি ভ্যালেরার চেয়ে শেখ মুজিব ছিলেন বড় নেতা।’ ১৯৭৩ সালে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের আলজির্য়াসে অনুষ্ঠিত শীর্ষ বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সাথে প্রথম সাক্ষাতে কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে আবেগপ্লাবিত কন্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি। তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতার দিক থেকে এই মানুষটি হিমালয়। তাই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা পেলাম।’ মিঞা মুজিবুর রহমান রচিত ‘জাতির জনক’ গ্রন্থসূত্রে মিসরের ‘আল-আহরাম’ পত্রিকার খ্যাতিমান সাংবাদিক হাসনাইন হেইকল এর কালোচিত বক্তব্য সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য- ‘নাসের কেবল মিসর ও আরব জগতের নন। তার আরব জাতীয়তাবাদও আরব জনগণের জন্য একটি মুক্তির বার্তা। একইভাবে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের একার নন। তিনি সব বাঙালির মুক্তির অগ্রদূত। তার বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলার সভ্যতা ও সংস্কৃতির নতুন অভ্যুদয়। মুজিব বাঙালির অতীত ও ভবিষ্যতের একজন বীর।’ এভাবেই মুজিব বন্ধনায় স্মরণার্থ অমীয় বাণী এবং সোপাধিক কাব্যগাঁথা শুধু বঙ্গবন্ধুকে মহান করেনি, পুরো বাঙালি সমাজ, জাতি-রাষ্ট্র, কৃষ্টি-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে করেছে বিশ্বপরিমন্ডলে নিরন্তর মর্যাদাসীন।
সম্বোধি অনুধাবন এবং ইতিহাস অধ্যয়নে বুদ্ধিদীপ্ত অন্তদৃষ্টি বঙ্গবন্ধুকে করেছে অপরিসীম প্রোৎসাহিত। এরই ভিত্তিতে দীর্ঘ সময় জনগণমন বিজয়ী বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালিকে একতাবদ্ধ করেননি, স্বাপ্নিক স্বদেশের স্বাধীন ভূখন্ড ও লালসবুজের মানচিত্র অর্জনে নির্ব্যাজ চিত্রকরের অনবদ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ধর্ম-বর্ণ, উচ্চ-মধ্যবিত্ত-দরিদ্র, অঞ্চল নির্বিশেষে বিভাজিত জনগোষ্ঠীর খণ্ডিত বিরোধ-বিচ্ছেদ নির্বাণে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদান আজ বিশ্বখ্যাত। বঙ্গবন্ধুর নির্বিকল্প নতুন আদর্শের নবতর নিলয় হয়েছে বাঙালির আজন্ম লালিত গন্তব্য। নিবন্ধের শেষ করছি জাতীয় কবি নজরুলের ‘জাতের বজ্জাতি’ কবিতার পংক্তি দিয়ে – ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জ্বালিয়াৎ খেলছে জুয়া।/ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া। /হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাবলি এতই জাতির জান।/তাইতো বেকুব করলি তোরা এক জাতিকে এক শ’খান।’ ১৭ মার্চ বিশ্বের মহাননেতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীর জ্যোতির্ময় মাঙ্গলিক ও নান্দনিক শুভক্ষণে দেশে কদর্য আবরণে আচ্ছাদিত সকল অশুভ অন্ধকারের ধূসর কুয়াশা তিরোধানে জাতি নবতর প্রেরণা ও প্রণোদনায় উদ্ভাসিত হোক। এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করে উচ্চকিত কন্ঠে আবারও বলতে চাই- জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়