মিয়ানমারে বৌদ্ধ সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণকারী প্রথম আমেরিকান প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক অ্যালান ক্লেমেন্টস দীর্ঘ নয় মাস ধরে ১৯৭৫ সালে অং সান সুচির মুক্তির পর পরই অসংখ্য সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এবং তাঁর উপর ভিত্তি করে ১৯৯৬ সালে ফ্রান্স থেকে ‘ দ্যা ভয়েস অব হোপ ‘নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। অ্যালানের সাথে দীর্ঘদিনের এই আলাপচারিতা মূলক গ্রন্থটিতে অং সান সুচি তার স্বভাবসুলভ সহজতার সঙ্গে, অকপটে তাঁর স্বপ্ন, বিশ্বাস ও প্রত্যাশার কথা যেমন বলেছেন, তেমনিই বলেছেন মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর অবাধ কর্তৃত্ব ও সেনাশাসনের অসংখ্য নেপথ্য কাহিনি। সেনাশাসনের প্রাচীর ঘেরা রাষ্ট্রের পূর্বাপর ইতিহাস স্পষ্ট করে তুলেছেন এ গ্রন্থটিতে, যাতে দেখানো হয়েছে মিয়ানমারের সমাজ ব্যবস্থায় ও মানুষের জীবনাচারণে সেনাশাসনের প্রভাব কতটুকু এবং সেনাবাহিনীর দীর্ঘ শাসনে কীভাবে গণতন্ত্র ভূলুন্ঠিত হয়েছে। এ গ্রন্থে আরো তুলে ধরা হয়েছে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নেতা উগাম্বিরার বক্তব্যও। যেখানে মিয়ানমারের সুদীর্ঘ সেনা শাসনের নিখাদ চিত্র পাওয়া যায়। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা সেনা শাসনের অবসানে ২০১১ সালে গণতন্ত্রায়নের সূচনা হলেও মিয়ানমারে সত্যিকারের গণতন্ত্র আসেনি কখনো। ক্ষমতার উপর সেনাবাহিনীর সাংবিধানিক এবং সংবিধান বহির্ভূত প্রভাব, নাগরিকদের অধিকার সীমিতকরণ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ, সর্বোপরি রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানো – সবই প্রমাণ করে যে মিয়ানমারে কখনো গণতন্ত্র নামক বস্তুটি ছিল না। আমেরিকান সাংবাদিক অ্যালান ক্লেমেন্টস দেখিয়েছেন মিয়ানমারে স্বৈরতন্ত্র কীভাবে সাধারণ নাগরিকদের কার্যত কর্তৃত্ববাদী শাসনের যাঁতাকলে পৃষ্ঠ করেছে। ২০১৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে অং সান সুচির বিজয়ের পর গণতান্ত্রিক মিয়ানমারকে সবাই বলছিল নতুন মিয়ানমার। এরপর রোহিঙ্গা নির্যাতনসহ নানা ইস্যুতে সারা বিশ্বের কাছে সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে মিয়ানমারকে। গত শতকের অর্ধেক সময়ই সেনাশাসনের নিয়ন্ত্রণে ছিল দেশটি। সে সময় দীর্ঘ ১৫ বছর গৃহবন্দী রাখা হয় অং সান সুচিকে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি দেশটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। মিয়ানমারের রাজনৈতিক ইতিহাস পুরোটাই হলো জেনারেলমুখী। ১৯৪৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশটির প্রধান প্রধান ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলেই জ্বলজ্বল করে উঠবে এই সত্য। মিয়ানমারের স্বাধীনতার পর থেকে ৭২ বছরের জীবনে মিয়ানমারকে বেসামরিক সরকার শাসন করেছে মাত্র ১৫ বছর। তারমধ্যে গত ১০ বছর শাসন করেছে বেসামরিক শাসনের ছায়াতলে সামরিক শাসক। তাই মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান নতুন কোন ব্যাপার নয়। ১৫ বছর গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অহিংস লড়াইয়ের জন্য ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান সুচি। এরপর তাঁর দল শীর্ষে চলে আসে। ২০১২ সালের উপনির্বাচনে ৪৫ আসনের মধ্যে ৪৩টিতে জয়ী হয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দল হয় সুচির এলএনডি। এরপর ২০১৫ সালের নির্বাচনে এনএলডি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। সেই সরকারের মেয়াদ শেষ হয়েছিল গত বছরের নভেম্বরে।গেল বছর ৮ নভেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে সুচির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) ভূমিধস জয়ই হলো সেনাদের বিদ্রোহের অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ।অং সান সুচির বাবা মিয়ানমারের জাতির পিতা জেনারেল অং সান ১৯ জুলাই ১৯৪৭ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হন এবং তাঁর বড় ভাই ‘বা উয়িক’-কে হত্যা করা হয়। প্যারামিলিটারির একদল সশস্ত্র লোক রেঙ্গুনের শহরতলির সেক্রেটারিয়েট ভবনে এঙিকিউটিভ কাউন্সিলের মিটিং চলাকালীন সময়ে ঢুকে পড়ে এবং তাদের হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয় সম্ভবত ‘উ সও-এর হুকুমে। উ সও ছিলেন অং সান-এর রাজনেতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। পরবর্তীতে তাঁর বিচার হয় এবং তাঁকে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসী (এনএলডি) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরে। গণতন্ত্র নিয়ে শব্দবাদ্যকে চিরতরে নির্বাসনের জন্য এবং গণতন্ত্রের সমর্থনে ভবিষ্যতে যেন আর কোন আন্দোলন না হয় সে কারণে আনুমানিক ৩০০০ নিরস্ত্র ছাত্র, ভিক্ষু এবং বেসামরিক লোককে সেনাবাহিনী রাস্তার উপর গুলি করে হত্যা করে। হাজার হাজার কর্মীদের গ্রেফতার ও নির্যাতন করা হয়। তখন সেনাবাহিনী সারাদেশে মার্শাল ‘ল’ জারি করে। মার্শাল ‘ল’ ভঙ্গকারীদের সামরিক আদালতে বিচার করা হয়। এভাবে মিয়ানমারের ৭২ বছরের ইতিহাসের প্রায় পুরোটাই বিভিন্ন ভাবে সেনা শাসকদের ইতিহাস । তার প্রেক্ষিতে বলা যায় এবার ফেব্রুয়ারি ১ তারিখে যা ঘটলো তা নতুন কিছুই নয়।
১৯৬২ সালেও জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখল করেন। নে উইন মিয়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা জেনারেল অং সান -এর ৩০ কমরেডের একজন ছিলেন। প্রায় দুই যুগ নে উইন ছিলেন কঠোর সামরিক শাসক ( ১৯৬২-৮৮)। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাসীন হন জেনারেল ‘সা মং’। বলা যায় মিয়ানমার হলো সেনা জেনারেলদের দেশ। যাইহোক, দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় সেনারা মিয়ানমারে শুধু শক্তিশালীই হয়নি গণমানসেও সেনাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরী হওয়ার একটা মনস্তত্ত্ব কাজ করতে থাকে। অনেক বিশ্লেষক ও গবেষক মনে করেন, নির্বাচনে চরম ভরাডুবির সাথে সাথে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দ্বারা ২০০৮ সালে প্রণীত সংবিধানও একটা কারণ সেনাদের এই ক্ষমতা দখলের। বিতর্কিত ওই সংবিধানটি সেনাবাহিনীকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করেছে। ওই সংবিধান সেনাবাহিনীকে সরকারের ২৫ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ দিয়েছে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও দেওয়া হয় সেনাবাহিনীকে। সংবিধানের এ ব্যবস্থা সেনাবাহিনীকে বেসামরিক আইন প্রণেতাদের পাশ কাটিয়ে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে মিয়ানমারে দ্বিতীয় দফা গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।এতে এনএলডি ৮০ শতাংশের বেশী ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়। তবে ভোটে প্রচুর কারচুপি হয়েছে বলে ভিত্তিহীন অভিযোগ এবং ভুয়া ভোটার তালিকা হয়েছে বলেও অভিযোগ তুলে অং সান সুচির সাথে সেনা প্রধান মিন অং হ্লাইং দরকষাকষি শুরু করেন। তারপর থেকে একটু একটু করে শোনা যাচ্ছিল সেনা অভ্যুত্থানের কথা। এছাড়াও আগামী জুলাই মাসে বর্তমান সেনা প্রধানের অবসরে যাওয়ার কথাছিল এবং সুচি সরকার তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধিতে আগ্রহী ছিল না এবং অবসরে যাওয়ার পরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে সেনা প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের হাতে ক্ষমতা একেবারে শূন্য হয়ে যেতে পারে এ ভয়ে সেনাবাহিনীর কাছে এই অভ্যুত্থান করা ছাড়া বিকল্প ছিল না।
মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের বড় ভিত্তি হচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, বেসামরিক রাজনৈতিক দল নয়। মিয়ানমারে চীনের প্রভাব নিরঙ্কুশ হওয়ার কারণে সেনারা বেশ দুশ্চিন্তামুক্ত। তাই চীন এই অভ্যুত্থানের জন্য নিন্দা করেনি এমনকি জাতিসঙ্ঘের উত্থাপিত নিন্দা প্রস্তাবটিও চীন ভেটো দিয়ে রহিত করে দিয়েছে। আর মিয়ানমারে ভারতের বাণিজ্যিক উপস্থিতিও চোখে পড়ার মত এবং ক্ষমতাসীনদের সাথে সখ্য সামপ্রতিক কালে চীনের জন্য প্রীতিকরও নয়। ভারতের পক্ষ থেকেও সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরী হয়েছে।এখন সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের ফলে এটা বলা যায় চীনের সাথে মায়ানমারের সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়বে।এবং ভারতও দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বলয়কে আরও জোরদার করতে চাইবে, তাই দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক প্রভাব পড়বেই। বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের প্রধান সম্পর্কের বিষয় হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। বলা যেতে পারে সুচি থাকাকালীন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনে যে নীতি অনুসরণ করেছিলেন, সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসাতে সেই নীতির পরিবর্তন হবে বলে তেমন একটা মনে করা যায় না। কারণ সুচি ও সেনাবাহিনীর চরিত্র রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রায়ই একই। বরং সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেওয়াতে চীনের সমর্থন সেনাবাহিনীর প্রতি আরো বাড়বে, যেহেতু চীন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন চাই না। তাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি ভূরাজনৈতিক পট পরিবর্তনের চাপের মধ্যে পড়ে আরো দীর্ঘায়িত হবে। মিয়ানমারের সেনা শাসকদের ব্যাপক চীন নির্ভরতার কারণে এ অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন আসবে, তাতে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি এখন আরো ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে। তাই বাংলাদেশকে শুধু মাত্র চীন ও ভারতের ওপর নির্ভর না করে, অন্যান্য দেশ ও বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকারকে সাথে নিয়ে মিয়ানমারের বর্তমান সেনাশাসক গোষ্ঠীর উপর ক্রমাগত চাপ বাড়ানোর প্রক্রিয়াটি অব্যাহত রাখতে হবে ।
লেখক : প্রাবন্ধিক