শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের বিকল্প নেই

রঞ্জন বণিক | বৃহস্পতিবার , ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ

করোনার ঢেউ বিশ্বব্যাপী সর্বত্র লেগেছে। পৃথিবীর ২১৬টির মত দেশ ও অঞ্চল করোনা মহামারিতে কমবেশি বিপর্যস্ত। করোনা মানুষের জীবনাচরণ থেকে শুরু করে ব্যবসাবাণিজ্যে এমনকি চিন্তাধারায়ও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। দেশেদেশে অসংখ্য মানুষের জীবনহানি স্বাস্থ্যখাতের দুর্বল দিকটির রুগ্ন চেহারা সবার সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছে করোনা। উন্নত দেশগুলো সমরাস্ত্র তৈরি ও এর প্রসারে যে ব্যাপক গবেষণা ও অর্থ ব্যয় করেছে–তার ছিটেফোঁটাও স্বাস্থ্য, শিক্ষা কিংবা অন্যকোন মানবিক-কল্যাণখাতে ব্যয় হয়নি এটি আজ জলের মত পরিষ্কার। লকডাউনে হঠাৎ থমকে যাওয়া বিশ্বে মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে ঘুরে দাঁড়িয়েছে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে। একটা বিষয় কিছুটা হলেও আমাদের আশ্বস্ত করেছে, সেটি হল করোনাকে যতটা ভয়ংকররূপে বিশ্বমিডিয়া উপস্থাপন করেছে, বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশে এটি ততটা মহামারি আকার ধারণ করেনি। প্রাকৃতিক কারণে হোক, শারীরিক সক্ষমতার কারণে হোক কিংবা বিধাতার আশির্বাদ যা-ই বলি না কেন উন্নত দেশগুলোর তুলনায় আমাদের মত দেশে করোনায় জীবনহানি নগণ্য বলাই চলে। যদিও অস্বাভাবিক একটি মৃত্যুও কারো কাম্য নয়।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলে নয়–করোনা মানুষের স্বার্থপরতার নগ্নরূপটিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। দেখা গেছে পিতার লাশ ফেলে সন্তান পালিয়েছে। বৃদ্ধা অসুস্থা মাকে রাস্তায় ফেলে রেখে গেছে কেউকেউ। এমনকি শেষ বিদায়ের ক্ষণে শোকাহত মমতাময় চোখের জলে নয় প্রিয়জনকে বিদায় দিয়েছে আতঙ্কগ্রস্ত দুটি চোখ। ভাবখানা এই-যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কবর দেয়া কিংবা দাহ করতে পারলেই রক্ষা পায়।
ধীরে ধীরে আমরা সব ডর-ভয়, আতঙ্ককে পেছনে ফেলে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছি। করোনা এখন অনেকের কাছে অতিসাধারণ জ্বর-সর্দি-কাশির মত একটি রোগ। ভয়কে জয় করে দেশের সবকিছু স্বাভাবিক এখন। শুধু একটিমাত্র খাত–যা এখনো করোনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি তাহল শিক্ষাখাত। আমাদের স্কুল-কলেজগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। অথচ কোমলমতি শিশুরা, শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে নেই। তারাও অভিভাবকের সাথে মুক্তবায়ু সেবন করতে ছুটছে পার্কে, রেস্তোরাঁয়, সমুদ্র সৈকতে এবং নানা বিনোদন স্পটে। ছুটছে কোচিং সেন্টারে, বেড়াতে যাচ্ছে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। আমরা সবাই জানি করোনা একটি ভয়াবহ ছোঁয়াচে রোগ। এটি খুব সহজে একজন থেকে অন্যজনের মধ্যে সংক্রমিত হয়। পরিবারের যে বয়স্ক লোকটি জীবিকার প্রয়োজনে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের ভিড় ঠেলে কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছেন। তিনিও সহজে রাস্তাঘাটে, যানবাহনে কোভিড সংক্রমিত হতে পারেন। এবং দিনশেষে ঘরে এসে সন্তানসন্ততি কিংবা পরিবারের অপরাপর সদস্যদের মাঝেও সংক্রমণ ছড়াতে পারেন। সৌভাগ্যের বিষয় হল আমাদের দেশে তেমনটা হচ্ছে বলে মনে হয় না। কেননা এখনো পর্যন্ত আমাদের দেশে কম বয়স্করা আক্রান্ত হবার সংখ্যা খুবই কম। সুতরাং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলে আমাদের শিক্ষার্থীরা গণহারে আক্রান্ত হবে এমন ধারণা যারা পোষণ করেন, সমপ্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে তাদের সাথে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ একমত পোষণ করে না। দুএকটি দেশের উদাহরণকে সামনে এনে জীবনহানির দোহাই দিয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাকে বেশিরভাগ লোক ভাল চোখে দেখছে না। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আঠার বছরের নিচে কাউকে ভেকসিনের আওতায় আনা হবে না। এর অর্থ হল আমরা ধরেই নিয়েছি আঠার বছরের কম বয়সীরা কোভিড আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা নেই। আমাদের দেশের দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কারো বয়স আঠার বছরের বেশি নয়। এখানে একটি বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। একদিকে আমরা ধরে নিয়েছি এরা কোভিড আক্রান্ত হবে না, তাই ওদের ভেকসিনের প্রয়োজন নেই । অন্যদিকে ধরে নিয়েছি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে ওরা কোভিড আক্রান্ত হতে পারে। বাস্তবতা হল দেশের সব শিক্ষার্থীরা এখন মুখিয়ে আছে কখন আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে। শিশু-কিশোরদের কলকাকলিতে মুখরিত হবে একবছর ধরে মৃতপ্রায় শিক্ষাঙ্গনগুলো। ধুলোর আস্তরণ থেকে মুক্ত হয়ে টেবিল-বেঞ্চ আবার চকচকে হয়ে উঠবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে শ্রেণিকক্ষ প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে।
করোনা পরিবর্তী বিশ্বব্যবস্থাকে ইতোমধ্যে কেউকেউ নিউ নরমাল লাইফ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। শুনতে চমৎকার লাগলেও এর পেছনে এক সুগভীর পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য নিহিত আছে বলে অনেকে মনে করে। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা মূলত মুনাফা কেন্দ্রিক। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-মিডিয়া যা-ই বলি না কেন সবকিছুর পেছনে মুনাফা অর্জনের বিষয়টি নিপুণভাবে কাজ করেছে এবং করে যাচ্ছে। একটু সুক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে দেখা যায় কোভিড বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থায় অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং রাজনীতিতে যে গভীর ক্ষত রয়েছে তার স্বরূপ উন্মোচন করেছে। যা এতদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। পুঁজিবাদী ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ী সমপ্রদায় তাদের ব্যর্থতা ঢাকবার জন্য নিউ নরমাল লাইফের ধারণাটি সামনে নিয়ে এসেছে। যাতে করে ভোক্তাশ্রেণিকে আস্থায় এনে নতুন আঙ্গিকে তাদের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়। করোনাকালে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে যে অনলাইন সিস্টেম চালু হয়েছে করোনা পরিবর্তী সময়ে তা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে নিউ নরমাল লাইফ ধারণাকে সামনে নিয়ে আসা হয়। এই ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত অনলাইন শিক্ষা চালু করে। যদিও প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে এর আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অপরাপর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ অনলাইন শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বাধ্যতামূলক বেতনভাতা আদায় করে নিচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, অনলাইন শিক্ষায় সরকার সন্তুষ্ট হলেও শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ দেশের শিক্ষাবোদ্ধাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কেন পারেনি তা আমরা সকলে কমবেশি জানি। দেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে হলেও আত্মসন্তুষ্টিতে ভোগা নীতিনির্ধারকগণ নিউ নরমাল লাইফের ধারণাকে সংকট উত্তরণের বিকল্প উপায় মনে করে এখনো সে পথে হাঁটছে না। স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থী না এলেও কিভাবে তার শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া যায় সে ভাবনায় তাদের পেয়ে বসেছে। যদিও এরিমধ্যে পরীক্ষার বিকল্প হিসাবে এসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মেধা যাছাইয়ের আইডিয়াটি ব্যর্থ হয়েছে। শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য আপৎকালীন সময়ে অটো প্রমোশনের বিষয়টি মেনে নেয়া গেলেও শিক্ষার গুণগত মান রক্ষার্থে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হয়ে পাঠগ্রহণ এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অন্যকোন বিকল্প নেই। দেশে এখন সবকিছু সচল থাকলেও একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মৃতবৎ পড়ে আছে। যেখানে প্রাণচঞ্চল্য থাকার কথা ছিল সবচে বেশি সেসব এখন জরাজীর্ণ। শিক্ষকদের বেতনভাতা জোগাতে না পেরে নিচের দিকের অনেক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মরত শিক্ষকরা জীবিকার তাগিদে বিকল্প কর্মসংস্থান বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। সরকার বলে যাচ্ছে দেশে শিক্ষা কার্যক্রম একমুহূর্তের জন্যও থেমে নেই। আংশিক অনলাইন শিক্ষা, অটো পাস, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেয়ার চিন্তাভাবনা আমাদের স্বল্পমানের শিক্ষার মান কোন স্তরে নামিয়ে এনেছে এবং কোথায় গিয়ে থামবে তা ভাবলেই গা শিউরে উঠে। একটি উন্নত জাতিগঠনে এবং টেকসই উন্নয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে গুণগত শিক্ষার বিকল্প নাই। সেটি নিশ্চিত করার জন্য সরকারের উচিত সহসাই সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক এবং সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমরা সবাই রাজা আমাদের রাজার রাজত্বে!
পরবর্তী নিবন্ধরোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কী হবে