রোদবৃষ্টি

দীপক বড়ুয়া | শুক্রবার , ৩০ এপ্রিল, ২০২১ at ৮:০৭ পূর্বাহ্ণ

ঠিক দুপুরে আমার জন্ম। বাবা নাম রাখলেন রোদ্দুর। মা ছেটে ডাকে ছোট নামে, রোদ। তখন থেকে রোদ্দুর নয়, রোদ নামে সবাই ডাকে, চেনে, জানে। পৃথিবীতে মা’র চেয়ে বড়ো কিছুই নয়, বুঝলাম। মা- বাবার এক মাত্র সন্তান আমি। জাঁহাপুর নদী ঘেঁষে আমাদের বাড়ি। বাবার মুখে শুনেছি, কখনও আমাদের বাড়ির দিকে নদী ভাঙেনি। ছিমছাম। ওপাড় ভেঙেছে। ওপাড়ের মানুষের ঘরবাড়ি ভাঙার ছবি দেখেছি। নির্মম ওদের কান্না শুনেছি। দিনে, দুপুরে, সন্ধ্যায়, বিকেলে জোয়ারভাটায় ধুপধুপ করে ঘরবাড়ি ভেঙে নদীর জলে পরতো। কী বিকট শব্দ! ওদের কী কাকুতি! অনেক বছরের বাপদাদার ভিটেটা নদীর জলে ভেসে গেলো। তারপর নদীর পাড়ের থেকে অনেক ভেতরে জমি কিনে ঘর বাঁধে। তা’ও ভেঙে ভেসে যায়। নদীর একূল ভাঙে, ঐকূল গড়ে, এইতো নদীর খেলা।ঠিক তাই ঘটছে। এবার ভাঙতে শুরু আমাদের পাড়। ওপাড় ভাঙা বন্ধ। বিধাতার অপরূপ খেলা। দুই পাড়ের মানুষের জীবনযাপন মাছ বিক্রি করে। দুপাড়ের মানুষের আত্মীয়তা হয়। বিয়েশাদি ও। তখন প্রচুর মাছ ছিলো তেরপারি নদীতে। পরিবারে বেশি সন্তান থাকলেও অভাব ছিলো না। মাছ বিক্রি টাকায় সংসার চলতো সহজে। আজকাল ছেলেপুলে কম হলেও সংসার চলে না।সবকিছুর দাম আকাশ উঁচু। অভাবে অনেকের ছেলেরা শহরে চাকরি করে। ওদের বাড়তি আয়ে পরিবারে সচ্ছলতা আসে। মা- বাবার এক মাত্র ছেলে আমি। ভীষণ প্রিয়, আদরের। শহরে যাবার কথা বলি। মা- বাবা দু’ জনেই কাঁদে। এ’ বছর আমাদের উঠোন খেয়েছে তেরপারি নদী।এরপর বারিন্দা। তারপরতো বসত ঘর। আজকাল নদীতে মাছ নেই। দূরে জাল ফেলি, মাছ আসে না। খালি হাতে ফিরি। তা’তে মা- বাবা রাগে না। বড়ো গলায় মা বলে, – আমাদের এতো কিছুর প্রয়োজন নেই। দু’মুটো চাল হলে চলবে।বাবা বলে,- এখনও অনেক ধানিজমি আমাদের। ওগুলোতে চলবে। আমরা জেলে। বাড়তি পরিচয় নেই আমাদের। সবাই তাই জানে। প্রায় পঞ্চাশ পরিবার। বিত্তশালী বনমালি পাড়ার সর্দার। তার কথায় সবাই চলে।তার অনেক নৌকা। ইঞ্জিন বোট আছে। অন্য জায়গায় ভাড়া টানে।রফিসিং বোটও আছে। গভীর সাগরে মাছ ধরে। বিক্রি করে প্রচুর আয় করে।
বৃষ্টি! বৃষ্টি তার মেয়ে। সুন্দরী। লেখাপড়া নেই। সর্দারের মেয়ে। চলাফেরা, কাপড়েচোপড়ে আধুনিক। বৃষ্টি ঘর থেকে বের হলেই সবার লালস চোখ কিলবিল করে। চুপিচুপি। সবাই ভয় করে। বৃষ্টির সাথে কেউ কথা বলে না। মেয়েরা। ছেলেদেরতো প্রশ্নই ওঠে না। বৃষ্টিকে দেখি। দূর থেকে। কখনও আম গাছের উপরে থেকে। কি সুন্দর বৃষ্টি। হাঁটা, চুল, মুখ, ফর্সা। ওর সাথে কাজের মেয়ে থাকে দু’ জন। শুনেছি বৃষ্টিরও আর ভাইবোন নেই, একা। আমারই মতো। মা- বাবার আদুরের। সর্দার বনমালী বাবাকে পছন্দ করে। সমীহ করে। হয়তো বাবার টাকাকড়ি আছে,তাই। হঠাৎ আকাশ মেঘে ভরে যায়।রেডিওতে বারবার বলছে দশ নম্বর বিপদ সংকেত। নদীর পাশাপাশি যাদের ঘর তারা যেন নিরাপদ স্থানে চলে যায়। বড়োসড়ো তুফানের আকাঙ্ক্ষায় মা- বাবা। বাড়িটা পুরনো। কি হয় ভাবে। ঠিক তখনই সর্দারের লোক পরিমল আসে। বাবা দেখে ভয়ে জড়োসড়ো। ভাবে,এই দুর্যোগে সর্দার পরিমলকে কেন পাঠালো? পরিমল বলে, – সর্দার আপনাকে ডেকেছে। – কেন ডেকেছে! বাবা ভয়ে আমতাআমতা করে জিগ্যেস করে।- শুধু তোমাকে নয়,গিন্নিমা, রোদকেও সাথে যেতে বলেছে।- কারণ কি জানো?
– না বাবু। আমার সঙ্গে যেতে বলেছে। এবং আরো বলেছে ঘরে তালা দিয়ে যেতে। আকাশ কালো মেঘে ভর্তি। দমকা বাতাস ছুটছে। গরুঘরের গরুবাছুর ডাকছে। হাঁসমুরগিরা তাদের ঘরে নিরাপদে বসে আছে। মনে হয়, এই শুরু হবে ঝড়োতুফান। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। পরিমল আবারও বলে, – বাবু আর দেরি নয়। সর্দার বকবে। মা বললো, – দেরি করছো কেন? রোদ, চলতো বাবা। আমি অবাক। এই ঝড়ে নিজের ঘরে না থেকে কেউ কি অন্যের ঘরে যায়! আমাদের ঘরে এতো সম্পত্তি, বিষয়আশয়, সব ফেলে চলে যাবো? বাবাকে বললাম, – বাবা তোমরা যাও। আমি ঘরে থাকি! মা রেগে যায় আমার কথায়। তখনি এলোমেলো ঘূর্ণিহাওয়া। ঘূর্ণিহাওয়ায় ঘরের চাল উড়ে যায়। সঙ্গে বৃষ্টি। হালকা। বাবা এই দৃশ্য দেখে দেরি করেনা।বলে,
– রোদ, রোদের মা, চলো। আমরা ছুটছি পরিমলের সাথে। গুটগুটে অন্ধকার থইথই করছে চতুর্দিকে। বৃষ্টি,হাওয়া গিলে খাচ্ছে সবাইকে। বিজলি,মেঘ ডাকছে। একটা ভয়ানক অবস্থা। সর্দারের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। পাকা, অনেক উঁচু সর্দারের বাড়ি। নতুন করেছে। তবে ইলেকট্রিক নেই। চেয়ারম্যান আসবে বলে জানিয়েছে। আমরা যখন সর্দারের বাড়ি পৌঁছি,প্রচুর বৃষ্টি,তুফান ছুটছে তখন। বৃষ্টিজলে চতুর্দিকে থইথই করছে। আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে তেরপারি নদী উপছে জল ছুটছে। সর্দার বললো, – নিধিরাম তোমরা আসছো? ভালোই হলো। তোমাদের কথা ভাবছিলাম।- কেন ভাবছেন শুধুশুধু!
– এই অসময়ে তোমাদের জন্য যদি নাভাবি, কে ভাববে বলতো! – গ্রামেতো আরো অনেক লোক, তাদের কথা ভাববেন না? আমি কি ভোবে বলে দিই। বাবা আমাকে ধমকের সুরে বলে, – তুই থামতো। সর্দার বললো, – নিধিরাম,তোমাদের বাড়িতো বোধয় ভেসে গেলো। মা কাঁদে, বাবা কাঁদে। আমিও কাঁদি। চোখের সামনে বাড়ি ভেসে যাচ্ছে। গরু বাছুর, হাঁসমুরগি ভেসে যাচ্ছে। প্রচণ্ড ঝড়োতুফান। সব গাছগাছালি ভেঙে চুর। বৃষ্টি পড়ছে। মেঘ ডাকছে বিজলি চমকাচ্ছে। একদিকে রাত। অন্যদিকে কালো মেঘে অন্ধকারে ডুবে আছে সব। সব ঘরে হারিকেন জ্বলছে।ঘূর্ণিহাওয়ায় টুসটাস শব্দ বাইরে।বড়োসড়ো আম,জাম কাঁঠাল,তেঁতুলগাছ ভাঙছে।পথ জলে ডুবে আছে। আমরা সবাই বসে। বৃষ্টি! বৃষ্টি আসে হারিকেন হাতে। সর্দার বলে, – এতোক্ষণ কোথায় ছিলি? নিধিরাম, নিধিরামের বউ, রোদ আসলো! জানিস না তুই? তোর মা কই? ডাকতো তোর মাকে।
এই রাতে হারিকেনের আলোতেও কি সুন্দর বৃষ্টি! বাবার কথায় ভেতরে চলে যায় বৃষ্টি। একটু পরে বৃষ্টির মা আসে। সর্দার বলে, – নিধিরাম,তারবউ,তাদের ছেলে রোদ এসেছে। রাতে খাবে। ও হ্যাঁ, ক’দিন থাকবে ওরা। ওদের বাড়ি ঝড়ে ভেঙে, জলে ভেসে গেছে। – ম র ণ! এই ঘোরবিপদে রাতে আরো কতকি ঘটবে জানি না।
হনহন ছুটে যায় অন্য ঘরে। সর্দার বলে, – এই হলো বৃষ্টির মা’র চরিত্র। ওর বাপের বাড়ির জন্য পাগল। রাতদুপুরে বাড়ি খোলা। ঐ দেখো, বাড়ির বড়ো ঘরটায় বাপের বাড়ির লোকেরা দখল করে আছে।এতো বছর সংসার করলাম,তবু চিনলামনা বউকে। বাবা সর্দারের কথার উত্তর দেয় না। আমাকে বলে, – রোদ, কাল কি হবেরে বাবা! কি খাবো, কোথায় যাবো? মা’র কপালে হাত। গুমড়ে কাঁদছে। কেঁদেকেঁদে বলছে, – শ্বশুরের ভিটামাটি শেষ হয়ে গেলো? কি লজ্জা! রক্ষা করতে পারলাম না কেউ! সর্দার বলে, – ভাবছো কেন রোদের মা,আমি আছিনা! – আপনি কি করবেন? কতটুকুই করবেন? মা বলে। – বিপদে মানুষকে দেখা সবার কর্তব্য। দায়িত্ব। উচিতও। বৃষ্টি আসে। বলে, – বাবা, ভাত দিয়েছে। সবাইকে নিয়ে খেতে এসো।সর্দার বলে, – নিধি, রোদ, চলো খেতে। রাতে আবার কি অঘটন ঘটে? পাটিতে বসে খেতে দেয়। ভাবি, বৃষ্টি পরিবেশন করবে। কাছাকাছি দেখবো বৃষ্টিকে। দেখবো কতো সুন্দর! না তা’ নয়। সর্দার বললো, – নিধিরাম নিজে নিয়ে খাও।রোদ তুমিও নিয়ে খাও। বউমা খাও। লজ্জা করোনা। বিপদে এভাবে খেতে হয়। তখন বেশি বৃষ্টি পড়ে। সাথে তুফান। মনে হয় সর্দারের বাড়িও ভেঙে পড়বে।
সর্দার খেতে খেতে বলে, – যেভাবে শুরু হলো, জানি না কখন থামে এই তুফান। নিধিরাম বুঝতে পারছো, বৃষ্টি কখন যাবে? আবার কখন রোদ আসবে! তখনই বৃষ্টি আসে। বলে, – বাবা আর কিছু লাগবে? সর্দার বলে, – বৃষ্টি, রোদকে জিগ্যেস কর,কিছু লাগবে কিনা! বড়ো লাজুক ছেলে। বৃষ্টি লজ্জায় চলে যায়। রোদ হাসে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতেলাপিয়া-পাঙাসে বাঙালি!
পরবর্তী নিবন্ধস্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন ‘হাজারী লেইন’