রোগ প্রতিরোধে সচেতন হতে হবে

ডা. দুলাল দাশ | মঙ্গলবার , ১ নভেম্বর, ২০২২ at ৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ

মানব জীবন অমূল্য সম্পদ। বারবার তা আসে না। তাই জীবনকে স্বাস্থ্যসম্মত ও দীর্ঘায়ু করতে ছাত্রবস্থা থেকেই প্রত্যেককে যত্নবান হওয়া উচিত। টাকা পয়সা, ধন সম্পদ সব কিছু মূল্যহীন যদি আপনার স্বাস্থ্য সুন্দর ও ঠিকঠাক না থাকে। মনে রাখবেন স্বাস্থ্যই সুখের মূল। শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন বয়ে আনে সুখ ও সমৃদ্ধি আর বিশৃঙ্খল জীবন বয়ে আনে দুঃখ, ব্যর্থতা ও সল্পায়ু। তাই শরীরকে সুস্বাস্থ্যবান ও রোগমুক্ত রাখার জন্য আমার এই প্রয়াস-
প্রথম ধূমপান দিয়ে শুরু করি। একটা সিগারেট শেষ করলেন সাথে সাথে রক্তচাপ তাৎক্ষণিক বৃদ্ধি পেয়ে গেল এবং তা ১৫ মি. স্থায়ী হল। যখন কোনো লোক ধূমপান করেন তখন নিকোটিন নামক এক ধরনের বিষ রক্তে প্রবেশ করে। মাত্র একটান ধূমপান ঘটাতে পারে ডি.এন.এ ক্ষয়। তৈরী হয় জটিল রোগ, যার মধ্যে ফুসফুস, অন্ননালী, মুত্রনালীসহ অন্যান্য ক্যানসার রোগ ও হৃদরোগ। তাই ধূমপান ছাড়ুন, ধূমপানকে না বলুন এবং নিয়মিত জীবনে যোগ করুন আরও ৩-৮ বছর।
ডায়াবেটিস হলে যত্ন কিভাবে নিবেন- ডায়াবেটিস বর্তমান বিশ্বে খুবই পরিচিত রোগ যার প্রকোপ প্রতি ঘরে ঘরে। তারপরও বলতে চাই এই রোগ সারাজীবনের রোগ। একে কন্ট্রোল করা বর্তমানে সহজসাধ্য। ডায়াবেটিস যে কোনো বয়সেই হতে পারে। ৪০ বছর পার হয়ে গেছে এমন অনেক লোকের ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে বা অনেকেই এখনও জানে না তাদের ডায়াবেটিস আছে। ডায়াবেটিস হলে খুব সাধারণভাবে তিনটা ‘ডি’ মেনে চলুন ভাল থাকবেন। তিনটা ডি হল ডাইট, ড্রাগ, এবং ডিসিপ্লিন। ডায়াবেটিস দুই প্রকার ১. ইনস্যুলিন নির্ভর ২. বিনা ইনস্যুলিন ডায়াবিটিস। আধুনিক পদ্ধতিতে রক্তের সুগার মাপা হয়। যার মান ৭% এর উপর হলেই বিপদ আর ৮ ঘণ্টা উপবাসের পর ১৩০মি.গ্রা. এর উপর হলে বা ৭০ মি.গ্রা. এর নীচে হলে বিপদ। অন্যসময় ১৮০মি.গ্রা/ ১০০ মিলি এর উপর হলে যে কারো অবস্থা বিপদ সীমার মধ্যে থাকে। গ্লকোজের এর মান বেড়ে গেলে শরীরে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ব্যাঘাত হয়। তাৎক্ষণিক শ্বাস কষ্ট হয়। আবার কমে গেলে এর নীচে মস্তিষ্কে এ গ্লুকোজ নিঃশেষিত হয়ে দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে। এমনকি কোমাতে চলে যায়। যা খুবই মারাত্মক ও জীবন নাশ হতে পারে। যারা ইনস্যুলিন ইনজেকশান নেয় বা মুখে ঔষধ খায় তাদের প্রতি বিশেষ হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলা যায় চিনি জাতীয় খাবার সঙ্গে রাখা উচিত। আর এ অবস্থা হওয়ার আগে রোগীকে বুঝতে হবে যে তার শরীর কাঁপছে, ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, শরীর ঘামাচ্ছে, মাথা ঝিম ঝিম করছে। কোনো লক্ষণ ছাড়া রক্তে গ্লুকোজ বারবার বিপদসীমার উপর থেকে গেলে রক্তে বাড়তি গ্লুকোজ জমা হয়ে কালক্রমে রক্তনালীর পথ রোধ করে দেয়। চোখ, টিস্যু, কিডনি ও হৃদপিণ্ডের প্রভূত ক্ষতি করে।
উচ্চ রক্তচাপকে পরাজিত করুন-
উপসর্গ: উচ্চ রক্তচাপের অধিকাংশ রোগীর তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। তথাপি সতর্কীকরণ সংকেত অনেক দেখা দিতে পারে। যেমন- মাথাঘোরা, মাথাব্যথা, অল্প হাঁটা চলাতেই শ্বাসকষ্ট। হাত পা অবশভাব, চোখে ঝাপসা দেখা, মাথা ঘাড় গলা, কাঁধ ব্যথা করা। ৭০-৮০% ক্ষেত্রে উচ্চ রক্ত চাপের কারণ পাওয়া যায় না। মাত্র ১০-২০% কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। সেগুলো জটিল। সাধারণত মেদ বহুল শরীর, বংশগত, ধূমপান, এ্যাংজাইটি, টেনশন, যারা অতিমাত্রায় লবণ খায়, অতিরিক্ত মদ্যপান করে তাদের উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ বেশি।
বিপদের ঝুঁকি: সঠিকভাবে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে হার্ট এ্যাটাক, সেরেব্রাল রক্তক্ষরণ, কিডনি ইসফেকশন, হাঁপানি হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশি বিচলিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। ‘আমেরিকান ন্যাশনাল হার্ট ইনস্টিটিউট’ লঘু ধরণের ব্লাডপ্রেসারে আক্রান্ত ৪৫৯ জন নরনারীর উপর ৮ সপ্তাহ গবেষণায় লক্ষ্য করেছেন যে যারা প্রচুর পরিমাণে ফলমূল, শাকসবজি, তরিতরকারী খেয়েছেন, কম চর্বিযুক্ত খাবার খেয়েছেন, প্রচুর আশযুক্ত খাবার, আমিষ সমৃদ্ধ খাবার খেয়েছেন, লবণ পরিমাণমত, ওজন কম রেখেছেন, নিয়মিত ও পরিমিত ব্যায়াম করেছেন, ধূমপান ত্যাগ করেছেন, এরা ব্লাড প্রেসার ঠিক রেখেছেন। আরও যারা উচ্চ রক্তচাপ কমানোর জন্য ঔষধ খেয়েছেন, উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ আপনার মধ্যে প্রকাশ পচ্ছে কিনা নজর রাখতে হবে বিশেষ করে যাদের বয়স ৪০ এর উর্ধ্বে। অতি সম্প্রতি উচ্চ রক্তচাপের সাথে সম্পর্কে যুক্ত বিশটির বেশি নতুন ‘জেনেটিক’ কোড আবিষ্কার হয়েছে। প্রত্যেক মানুষ এই জেনেটিক কোড গুচ্ছের কোনো একটির বাহক। তাই চিকিৎসা করতে ইহা কাজে লাগবে।
স্ট্রোক থেকে বাঁচুন-রক্তে জমাট পিণ্ডদ্বারা যখন মগজে রক্ত প্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত হয় তখনই স্ট্রোক। সুতরাং স্ট্রোক হল মস্তিস্কের রোগ। ১৫% ক্ষেত্রে রক্তনালী ছিড়ে গিয়ে ‘স্ট্রোক’ হয়। তখন আক্রান্ত অংশে মস্তিস্ক অক্সিজেন পায়না ও কয়েক মিনিটের মধ্যে মস্তিষ্ক কোষ মরে যায়। রক্ত চলাচল যদি পুনস্থাপিত না হয় মগজের সামান্য ক্ষতি নিয়ে এবং সামান্য পঙ্গুত্ব নিয়ে রোগী বেঁচে যায়। আর যদি ব্রেইন টস্যিু দীর্ঘ সময় অঙিজেন বা পুষ্টি বঞ্চিত থাকে তাহলে চিরস্থায়ী পেরালাইসিস/অবশ অথবা মৃত্যু। সুতরাং যত শীঘ্রই চিকিৎসা করা যায় ততই মঙ্গল।
স্ট্রোক ঝুঁকি নির্ভর করে নানা উপাদানের উপর। কতকগুলি নিয়ন্ত্রণ সাধ্য কতকগুলি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ঝুঁকিপূর্ণ দিকগুলি (১) বয়স ৫৫ এর উর্ধ্বে। (২) পরিবারের অন্য কারো কি স্ট্রোক হয়েছিল? (৩) হার্ট ডিজিজ কখনও ধরা পরেছিল কিনা? (৪) বহুমূত্র আছে কিনা? (৫) ধূমপান করে কিনা? (৬) দিনে কয়বার অ্যালকোহল পান করেন (৭) দেহের ওজন কি বেশি? (৮) রক্তচাপ কি অটল থাকে১৪০/৯০ এর উর্ধ্বে। ডায়াবেটিস স্ট্রোক এর ঝুঁকি ৩ গুণ বেশি এবং ব্রেন এর ক্ষতি হয় গুরুতর। হার্ট ডিজিজে স্ট্রোক এর ঝুঁকি ৫০০ শতাংশ। সুতরাং কয়েকটি অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস বদলিয়ে স্ট্রোক এর ঝুঁকি হ্রাস করা যায়। যেমন উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টারল, অত্যধিক ওজন, নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে ইত্যাদি। স্ট্রোকের সতর্ক সংকেত- মুখমণ্ডল, বাহু বা পা, দেহের একপাশ হঠাৎ অবশ বা দুর্বলরোধ করলে, হঠাৎ হতবিহ্বল অবস্থা, হঠাৎ এক বা দুচোখ দিয়ে দেখতে অসুবিধা, মাথা ঝিম ঝিম বা ভারসাম্য হানি। এই লক্ষণগুলি দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের নিকট বা হাসপাতালে নেওয়া উচিত।
হৃদরোগ- বর্তমান সমীক্ষায় দেখা গেছে, ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভাস হৃদরোগ বাড়ার প্রধান কারণ। বলেছেন বিশ্বের খ্যাতিমান হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন ডাক্তার দেবী শেঠী। তাই ত্রুটিপূর্ণ খাদ্য অভ্যাস থেকে নিজেকে মুক্ত রাখুন। আমাদের দেশে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ১৭% হৃদরোগের কারণ। চিকিৎসকেরা বলছেন একশত রোগীর মধ্যে ১২-১৫ জন হার্টের রোগী। বিশ্বে বিভিন্ন রোগে মুত্যৃর কারণের মধ্যে ৩১% মারা যায় হৃদরোগের কারণে। আপনার কোলেস্টরেল লেভেল বেশি? সেটা কমান। উচ্চ রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখুন। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন। নিয়মিত শরীর চর্চা করুন এবং ওজন কমান। যারা হৃদরোগের জন্য ওষুধ খাচ্ছেন ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ বন্ধ করবেন না। মনে রাখবেন সুস্থ্য হার্ট সুস্থ জীবন। প্রচুর শাক সবজি, দেশী ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস করুন।
পরিশেষে বলব- প্রচুর পানি পান করুন ৫০% রোগমুক্ত থাকুন। অট্টহাসি হাসুন হার্টকে সতেজ রাখুন। নিয়মিত ব্যায়ামে জীবনে যোগ হয় আরও ৪টি বছর। ধূমপান না করলে আরও ৩-৮ বছর। ওজন ঠিক রাখলে ২-৮ বছর।
লেখক : প্রাক্তন চীফ অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ : লেখক ও দার্শনিক
পরবর্তী নিবন্ধশিশু রাসেলের প্রতি বাবার ভালোবাসা