রূপকথা

দীপক বড়ুয়া | শুক্রবার , ২৫ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৭:০৫ পূর্বাহ্ণ

আজকাল অসময়ে কেউ ফোন করে না।
সবার মনে ভয়,আতংক। কখন করোনা চেপে ধরে। একটি ভয়ংকর সময় পার করছি। রাতের খাওয়া শেষে বিছানায় যাচ্ছি, প্রিয় মোবাইল বাজে।
তাড়াহুড়ো নেই।
রাত সাড়ে এগারটা। আজ একটু দেরিতে খাওয়া। এইসময় ফোন আসা মানে দুঃসংবাদ। কারো অসুস্থতা, নয়তো মৃত্যু সংবাদ। টেবিলের উপরে রাখা ফোন হাতে নিয়ে দেখি, অপরিচিত নাম্বার।
ধুত্তুরি! ধরব, না ধরব না। কৌতূহলে ফোনের সুইচ অন করি। ওপার প্রান্তে মহিলার কন্ঠ। মিষ্টি গলা। কথা বলব?
হিমাদ্রীর পছন্দ নয়, মেয়ের সাথে কথা বলি। সে আমার স্ত্রী, প্রাণের বউ। ওতো এখন রান্না ঘরে। রান্না ঘর এবং শোবার ঘরের দূরত্ব তেমন নয়। কথা বললে শোনা যায়। তার আগে হিমাদ্রীর প্রশ্ন,
– এত রাতে কার ফোন?
আমার কন্ঠ শুকিয়ে কাঠ। কথা বেরুয় না। চেঁছিয়ে বলে,
– কে ফোন করল?
-চিনিনা। অস্পষ্ট গলায় বললাম।
হিমাদ্রীর কান বিড়ালের কানের মত। আমার কথা শুনে বলে,
– রেখে দাও।
তাই হল। রেখে দিলাম।
হিমাদ্রী ওয়াশ রুমে এখন। সে বেশি সময় কাটায় ওখানে। চোখেমুখে জল দেবে। গায়ে জল ঢালবে। হাঁটু থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত সুগন্ধি সাবানে ধোবে অনেকক্ষণ। শরীরের কোথাও গন্ধ থাকলে হিমাদ্রীর ঘুম আসে না।
তখন আবারও ফোন বাজে।
এবার ভয় নেই। ড্রইংরুমে গিয়ে ফোন অন করি। হিমাদ্রীর কম হলেও আধ ঘন্টা লাগবে, ওয়াশ রুম থেকে আসতে।
– প্রথমে ফোন কেটে দিলেন কেন? সেই মেয়েটির ফোন।
সত্য কথা বলা যাবে না। আমি মিথ্যে বললাম,
– ওয়াশ রুমের তাড়া ছিল, তাই।
– আমি আপনাকে চিনি।
– কে আপনি?
– বারে আমি রূপকথা। কলেজ, ভার্সিটিতে একসাথে পড়তাম, বাংলায়।
রূপকথা!
রূপকথা ভীষণ সুন্দরী, স্মার্ট মেয়ে। লেখাপড়ায় ভালো। পছন্দ করতাম। ভালোবাসতাম দু’জন দু’জনকে। কিন্তু বাবার বন্ধুর মেয়ে হিমাদ্রীর সাথে আমার বিয়ে দেয়।
তো রূপকথা এতদিন পরে আমাকে ফোন করল, কেন? পরিচিত, কথা না বললে হয়?
– তো আপনি করে বলছ, ব্যাপার কি? পুরনো বন্ধু, তুমি বলো।
– দীপাঞ্জল, তোমার খবর কি?
– এই আছি। ভালো। তোমার খবর কি? তোমার স্বামী, ছেলেমেয়ে কি করে?
আমার প্রশ্নে রূপকথা কাঁদতে শুরু করে।
আমি অবাক। ফিরতি প্রশ্ন করি,
– তুমি কাঁদছ কেন রূপকথা।
– ওরা কেউ নেই।
– কোথায় গেছে?
– করোনায় মারা গেছে।
– ওমা বল কি? কিভাবে?
রূপকথা বলে,
– প্রথমে আমার ঋত্বিককে করোনা ধরে। ওকে দু’জনে সেবা করছি দিনরাত। পরে আমার স্বামীর করোনা। কি আশ্চর্য, এক সপ্তায় দু’জন আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যায়। এখন আমি একা, ভীষণ। কিচ্ছু ভালো লাগেনা।
কি বলে সান্ত্বনা দেবো রূপকথাকে জানিনা। তবু সাধারণত মানুষ, মানুষকে যেভাবে বলে, সান্ত্বনা দেয়, আমিও তাই করি, বলি,
-চিন্তা করোনা। পৃথিবীতে কেউ চিরদিনের জন্য আসে না।
সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছের বাইরে কেউ চলতে পারি না। তিনি যা করেন ভালোর জন্য করেন।
– তো, আমি এখন কি করবো, কাকে নিয়ে থাকব জানো? আমার তিন কুলেতো কেউ নেই।
রূপকথার এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।
আমি নির্বাক!
আহা! কি অসুখ এলো পৃথিবীতে। নাম করোনা। যার সঠিক ওষুধ এখনও বেরুয়নি। বের করতে পারেনি কোন বিজ্ঞানী! বের হলেই বা কি? করোনা, সেতো রঙ পাল্টায় প্রতি মুহূর্তে।
এরপরও কি করোনার ওষুধ বের হবে না? নিশ্চয়ই হবে। হয়তো সময় বলতে পারে, কখন?
আমাকে শোবার ঘরে না দেখে হিমাদ্রীর বড় গলা।
– তুমি কোথায়?
ড্রইংরুম থেকে ছুটে আসি।
হাতে মোবাইল দেখে প্রশ্ন করে,
– কার সঙ্গে কথা বলছ?
আমার মুখে উত্তর নেই।
মনও নেই সেখানে।
মনটা রূপকথার কাছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৪২ নাগরিকের করা অভিযোগ অসত্য ও ভিত্তিহীন : সিইসি
পরবর্তী নিবন্ধদাগ