রাবেয়া হত্যার রহস্য উন্মোচন

স্বামী ও তার ভগ্নীপতি গ্রেপ্তার

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ১৮ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ

চালচলনে মলিন বেশ, পড়নে লুঙ্গি, কোমড়ে গামছা প্যাঁচানো। ঠিক যেন মাঠের কোনো গরীব কৃষক। কিশোরগঞ্জের নিকলী এলাকার মানুষের সাথে এভাবেই মিশে গিয়েছিল হালিশহর থানা পুলিশের একটি টিম। ঝুপরি কোনো হোটেলে ভাত খেয়েছে তারা কখনো দুটো পেঁয়াজু আর ডাল দিয়ে, কখনো আবার ডিম দিয়ে। কেউ কেউ পান খেয়ে ঠোঁট লাল করেছিলেন, কেউ আবার খেতেন বিড়ি বা সস্তা সিগারেট। পণ ছিল একটাই; খুনের আসামীকে ধরতেই হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার জানে না আসামী; তাই তাকে গ্রেপ্তারে প্রযুক্তির ব্যবহার করে লাভ নেই। এ চিন্তা থেকে সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল পুলিশের ওই টিমের সদস্যরা। আর এভাবেই খুনের আসামী মো. জামিনকে গ্রেপ্তার করে হালিশহর থানা পুলিশ। তার আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল খুন হওয়া রাবেয়ার ছোট বোনের জামাই মো. মোস্তফাকে। রাবেয়া হত্যার রহস্য উন্মোচনের এ কাহিনী বর্ণনা করেন চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) পশ্চিম বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার জসিম উদ্দিন। গ্রেপ্তার জামিন কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী থানার দক্ষিণ হাটি এলাকার শাহ আমিনের ছেলে। তার ভায়রা ভাই মোস্তফা কিশোরগঞ্জের নিকলী থানার শিবলী থানার দামপাড়া সুন্দরবনের মোড় এলাকার মো. শফিকুল ইসলামের ছেলে। দুজনই হালিশহর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন।

উল্লেখ্য, গত ১৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় নগরীর হালিশহর থানাধীন এব্লকের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ রোডের ১১ নম্বর বাসার ভেতরে স্বামীর হাতে স্ত্রীকে খুনের ঘটনা ঘটে। জানা যায়, গত এক বছর পূর্বে নিহত রাবেয়া আক্তার (২৭) তার প্রথম সংসারের দুই কন্যা সন্তানসহ আসামী মো. জামিনকে (২৪) বিয়ে করে। সংসার জীবনে বনিবনা না হওয়ায় তাদের মধ্যে কলহের সৃষ্টি হতো। এই বিরোধ সমাধানের জন্য নিহতের বাবা আসামীর স্বজনদের সাথে একাধিকবার বৈঠক করেন।

নিহত রাবেয়া আক্তার হালিশহর থানাধীন বি ব্লকের হান্নানের মালিকানাধীন মিডওয়ে অ্যাপারেলস নামে ছোট গার্মেন্টসে চাকুরী করতো। ভিকটিমকে তার স্বামী আসামী জামিন (২৪) প্রতিনিয়ত সন্দেহ করায় ভিকটিম গত ২ মাস পূর্বে চাকরি ছেড়ে দেয়। এরপর রাবেয়া সংসারের সচ্ছলতার জন্য তার বাবার চায়ের দোকানের পাশে রাস্তায় পিঠা বিক্রি করতো। তার স্বামী সেটাও পছন্দ করতো না। ঘটনার কয়েকদিন আগে এনজিও থেকে লোন নেয়ার জন্য একটি ফরমে স্বাক্ষর দিতে বললে রাবেয়া অস্বীকৃতি জানায়। মো. জামিনের সাথে রাবেয়া এ প্রসঙ্গে তর্কে জড়ায়। এই কলহের জের ধরে ১৪ জানুয়ারি দুপুর আড়াইটার দিকে আসামি মো. জামিন তার ভায়রা মোস্তফার সাথে পরিকল্পনা করে কীভাবে রাবেয়াকে সরিয়ে দেওয়া যায়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার দিন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে জামিন একটি ছুরি নিয়ে বাসায় ঢুকে। অপর আসামি মোস্তফা পেছন পেছন গিয়ে জামিনের কক্ষের পাশের কক্ষে অবস্থান করে। জামিন ঘরে ঢুকে রাবেয়ার প্রথম ঘরের মেয়ে মিম আক্তার জান্নাতকে দেখতে পেয়ে তাকে বাইরে যেতে বলে। মিম বের হয়ে তার নানার পানের দোকানে গিয়ে জানায়, তার বাবা একটি ছুরি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেছে এবং তাকে বাইরে যেতে বলেছে।

এদিকে মিম বাসা থেকে বের হতে না হতেই পাশের কক্ষে অবস্থানরত ভায়রা মোস্তফা জামিনের শয়ন কক্ষে প্রবেশ করে। রাবেয়া খাতুন নাস্তার জন্য রান্না ঘরে প্রবেশ করলে আসামির ভায়রা ভাই মোস্তফা রাবেয়াকে জাপ্টে ধরে এবং জামিন রাবেয়ার গলায় ছুরি বসিয়ে দেয়। এরপর এলোপাথারি ছুরিকাঘাত করে রাবেয়াকে। গুরুতর অবস্থায় রাবেয়া খাতুন চিৎকার করলে জামিনের হাত থেকে ছুরি কেড়ে নিয়ে মোস্তফা রাবেয়ার গলায় কয়েকবার আঘাত করে। রাবেয়া দৌড়ে তার বাবার দোকানের সামনে রাস্তায় পড়ে যায়। জামিন ও মোস্তফা দেয়াল টপকে খাল পাড়ের দিকে পালিয়ে যায়। জামিন খালপাড় দিয়ে পালানোর সময় হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ছুরিটি খালে ছুঁড়ে মারে।

আহত রাবেয়াকে দ্রুত হালিশহর থানার ফইল্যাতলী বাজারের হেলথ কেয়ার ডায়াগনস্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টারে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষনা করেন। এ ঘটনায় রাবেয়ার বাবা হালিশহর থানায় মামলা করেন। গত রোববার (১৫ জানুয়ারি) রাবেয়ার জানাজার নামাজ থেকে তার ছোট বোনের স্বামী মো. মোস্তফাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার থেকে জানা যায় জামিন কোথায় আছে।

উপ পুলিশ কমিশনার জসিম জানান, এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামীদের গ্রেপ্তার আমাদের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ আসামীরা ছিল আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ছোঁয়ার বাইরে। তারা ফেসবুক কিংবা অন্য কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতো না। তাই সম্পূর্ণ সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি বলেন, কিশোরগঞ্জের নিকলী এলাকার মানুষ সাধারনত কৃষি নির্ভর। তাই তাদের চালচলন খুবই সাধারণ। ওই এলাকার পোশাক সাধারনত লুঙ্গি গামছা। তাই আমাদের টিমও লুঙ্গি গামছা পড়েই ওই এলাকায় অবস্থান নেয়। এদিকে স্থানীয় গোয়েন্দা তথ্যর ভিত্তিতে জানা যায়, আসামী জামিন একটি সেলুনের দোকানে চুল কাটছে। পরে ওই তথ্যর ভিত্তিতে ওই দোকানে অভিযান চালিয়ে জামিনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধডিলারকে আটক করলেন কাউন্সিলর
পরবর্তী নিবন্ধচার পা নিয়ে পৃথিবীতে এলো শিশুটি