রাতের বয়স বাড়ার গল্প

আবু মুসা চৌধুরী | শুক্রবার , ১৫ জানুয়ারি, ২০২১ at ৮:৩৩ পূর্বাহ্ণ

কৈশোর-উত্তীর্ণ মেয়েটি শহরে আসে জীবিকার তাড়নায়। অনাত্মীয় ও রূঢ় নগরে কাজ করে গাঁয়ের বাড়িতে টাকা পাঠায়। বুড়ো মা-বাবা ও ভাই-বোনদের ভরণ-পোষণ চলে অতি কষ্টেসৃষ্টে। একদিন বৃদ্ধ বাবা দেখতে আসে মেয়েকে। অচেনা শহরে এসে বুড়ো হতচকিত। মেয়ের নির্ধারণ করে দেওয়া স্থানে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন মধ্যরাত। তামাম পৃথিবীতে থোকা থোকা অন্ধকার। সুনশান নীরবতা। বৃদ্ধ রাস্তার মোড়ে এসে মেয়ের হদিশ খোঁজে। মেয়ে বাপকে রাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। বৃদ্ধ দূর থেকে দেখে কয়েকটি অপরিচিত মানুষের ছায়া। কী নিয়ে যেনো তার মেয়ের সঙ্গে ওরা ফিসফিস আলাপ করছে। সহজ সরল গেঁয়ো বুড়ো বোঝে না কিছুই। শহরের এসব হাল-হকিকত দেখে অবাক হয়। মেয়ের নাম ধরে ডাক দেয়। মেয়ে কী চাকুরি করে তা জানার তীব্র বাসনা বুড়োর। ইতোমধ্যে মধ্যবয়সী এক লোকের সঙ্গে রফা হয় মেয়েটির। বুড়ো অনতি-দূরের মেয়েকে ডাকে আবার। ব্যবসার এই পিক-আওয়ারে বাপের উপস্থিতিতে মেয়েটি বিরক্ত। দূর থেকে বলে, বাজান আপনি যান। ‘মেয়েটি ওই লোকটির সঙ্গে উঠে পড়ে রিকশায়। বেকুব বুড়ো ডাকে মা-রে তুই ক’নে যাস? মেয়েটি জবাব দেয়, বাজান আপনি যান।
উপরের ঘটনাক্রম মহান লেখক শওকত আলী রচিত ‘বাজান আপনি যান’ গল্প থেকে নেয়া।
কালজয়ী লেখক শরৎচন্দ্র অন্ধকারের সৌন্দর্য আবিষ্কার করতে না পারলেও, এতদ বিষয়ে মানে আন্ধার রাত নিয়ে আমার আগ্রহ বিস্তর। তাই আমি নিশাচর। উদ্ধৃত গল্পের মতো কোনো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি না হলেও, এর কাছাকাছি অনেক দৃশ্যপট আমার নজরে এসেছে প্রত্যক্ষভাবে।
স্টেশনের বুকস্টল মালিকের সঙ্গে আমার বেশ খাতির-ভাবসাব। আমাকে দোকান পাহারা দেওয়ার জন্যে দাঁড় করিয়ে তিনি নামায পড়তে বা খাওয়া দাওয়া করতে নয়তো কেনাকেটা করতে যান। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পত্রিকা মুখস্থ করি বা সাময়িকীর পাতা ওল্টাই। ফিরে এসে তিনি আমাকে চা-নাস্তা খাওয়ান। তখন স্টেশনের দোতলায় অবস্থিত আবাসিক হোটেলটির যথেষ্ট দুর্নাম অসামাজিক কাজের জন্যে। আইনের লোকজন মাঝে মাঝে কয়েকজন যৌনকর্মী ও হোটেলের ম্যানেজারকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এসব আমার চোখের সামনেই ঘটে। কিন্তু কয়েকদিন পরই নৈব নৈব চ। পূর্বের অবস্থা।
সন্ধ্যার দিকে ওই বুকস্টলে উগ্র প্রসাধনী মাখা রঙচঙে পোশাক পরা একটি মেয়ে টিস্যু কিনতে আসে প্রতিদিন। কয়েকদিন পর আমার সঙ্গে মুখচেনা হয়ে যায়। দেখা হলেই সালাম দেয়। জিজ্ঞেস করে, ‘আঙ্কেল কেমন আছেন?’ আমিও হাসি মুখে জবাব দিই। ওর নাম কী, কিংবা বৃত্তান্ত জানা হয় না।
এই, এখন এ মধ্যরাতের স্টেশনে তাকে দেখি অন্যরূপে। বোরখার ক্যামোফ্লাজে ওর দেহাবয়বের গঠন ও কন্ঠস্বর আমাকে জানান দেয় ওর উপস্থিতি। ওরা কয়েকজন গল্প করে। যাপিত জীবনের গল্প? না, যে জীবন যাপন করা হয়, তাই-ই তো জীবন-যাপন। ওদের জীবনে তো ওই বিলাসিতা কোনোভাবেই আসে না। ওরা দিনগত পাপক্ষয় বা আয়ুক্ষয় করে। জীবনকে তো যাপন করে না। অল্প দূর থেকে আমি শুনি।
‘গতর বেচা পয়সায় ভাত খাই। এই কামাই ওই মাঙ্গীর পোলারে দিমু কিয়ের লাইগা?’
বুঝলাম মধ্যস্বত্বভোগী দালাল ও ইউনিফর্মধারী কারো ভূমিকা আছে এখানে। কয়েকজন আরএনবি বা রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কতেক লোক ঘুর ঘুর করে মেয়েগুলোর আশপাশে। ওই জায়গা থেকে সরে এলাম। রাত বাড়ছে। চারপাশে থমকে আছে নাগরিক কোলাহল। শাহরিক মানুষগুলো ঘুমিয়ে আছে অকাতরে। শেষ ট্রেনটি স্টেশন ছেড়ে গেছে বেশ আগে। দূরপাল্লার যাত্রীবাহী ট্রেনটি এসে থামার পর শান্ত ও নিস্তরঙ্গ স্টেশন চঞ্চল হয়ে ওঠে। শুরু হয় কোলাহল। হইচই। উত্তরবঙ্গ থেকে আসা অভাবী, খেটে খাওয়া মানুষগুলোর হাঁক-ডাক, কিচিরমিচিরে ব্যস্ত হয়ে ওঠে পরিবেশ। একসময় সব থেমে যায়। ঘড়ির কাঁটা স্পর্শ করে রাত দু’টোর ঘর। চা খাওয়ার জন্য বেরিয়ে এলাম বাইরে।
ফুটপাতের টংদোকান থেকে চা খাওয়ার পর আমার শরীর আবার চন মন করে ওঠে। সুখটান দিই সিগ্রেটে। আমার শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে ঢুকে যায় নিকোটিনের নিঃশব্দ মাধুরী। আমি আবার চাঙ্গা হয়ে উঠি। পেছন থেকে ভেসে আসে ডাক- ‘মুসা মামা’….।
কীরে সুমন ‘তুই তো বেশ বড়ো হয়ে গেলি। বিয়া-শাদি কইরছতনি?’
গাট্টাগোট্টা সুমন এসে দাঁড়ায় পাশে। এখন সে তাগড়া জোয়ান। আমার সঙ্গে ওর পরিচয় ও যখন ছিলো একরত্তি কিশোর। সরল স্বাস্থ্যের অধিকারী কিশোরটি একটানেই বাঁশি বা ছিলিমের অর্ধেক তামাক শেষ করে দিতো। কী সে দম! ওর ওই ক্যারিশমায় আমিও সুমনের প্রতি আকৃষ্ট ও মায়াপ্রবণ হয়ে যাই। একবার ঈদে ওকে চোরাই মার্কেট থেকে আড়াইশো টাকা দিয়ে একজোড়া স্যান্ডেলশ্যু কিনে দিয়েছিলাম। আর একটা শার্ট কেনার জন্য ওর হাতে দিয়েছিলাম ২০০ টাকা। পরে খবর নিয়ে জেনেছি বদমাশটা স্যান্ডেল বিক্রি করে ইয়ার-দোস্তদের নিয়ে তামুকের মোচ্ছব বসিয়েছিলো। সুমন আমার বেশ ন্যাওটা। বলে, ‘এক খানকিরে বিয়া করছিলাম মুসা মামা।
তারপর? আমি জিজ্ঞেস করি। সে বলে ‘আমার নামে কেইচ দিয়া ভাগছে।’
অ।
তো, এখন কী করস? ওই মাল-টাল আইনা দিই লোকজনরে। দু’চাইর-দশ টাকা পাই। ওই দিয়া চাইলা যায়। মুসা মামা, আমারে বিশটা টেকা দেন। কিছ্‌ খামু। টাকা নিয়ে সুমন অন্তর্হিত হয়। এখন রাত তিনটা। মন্থর পায়ে হেঁটে যাই পাবলিক টয়লেটের দিকে। টয়লেটের ম্যানেজার নাসির হেসে স্বাগত জানায়। শুশ্রূধারী নাসির বাঁশি বানানোর এক ওস্তাদ কারিগর। ওর বানানো তামুকের সুখ্যাতি আছে তামাম স্টেশনে। দু’ছেলে এক-মেয়ে ওর। ছেলেদের নাম রেখেছে ওর নামের ‘ন’ বর্ণের সঙ্গে মিলিয়ে নাহিদ ও নাজমুল। মেয়ের নাম রোকসানা। মেয়ে পড়ে এক এনজিও স্কুলে। নাসিরের বউ ভেগেছে ওর চেয়ে অবস্থাসম্পন্ন এক স্মাগলারের সাথে। ছেলে দু’টো ওর কাছে আর মেয়ে আছে মায়ের সঙ্গে। নাসিরের সঙ্গে ওর মাও থাকে। বাসা ঝউতলায়। ওর বাবাও বিয়ে করে অন্য বিবি নিয়ে আলাদা সংসারে বসবাস করে। নাসির ও ওর মায়ের কোনো খোঁজ খবর নেয় না। বউ ভেগে যাওয়ার পর ক’দিন মন খারাপ থাকে নাসিরের। হঠাৎ একদিন বলে, ‘স্যার জীবনে তো একজন সাথীর দরকার আছে।’ ওর মুখে এরকম ভারী কথা শুনে অবাক হই। এবং শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই একজন দার্শনিক বসবাস করে। ওমা, কয়েকদিন পর দেখা গেলো, নাসির সুশ্রী, টান টান এক কালো মেয়ের সঙ্গে বসে গল্প করছে ভ্যানগাড়ির ওপর বসে। জিজ্ঞেস করি-
‘নাসির কে?’ নাসিরের জবাবটি ছিলো মোক্ষম ও বেশ তাৎপর্যবহ। সে হেসে বলেছিলো-
‘লগের মানুষ।’ যাক নাসির বৃত্তান্ত। ও বলে স্যার, চা আনামু? বললাম, এখন আর খেতে ইচ্ছা করছে না। তোর ছেলে-মেয়ে সকলে স্কুলে যায় তো? নাসির হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়। এর মধ্যে আকাশের রং পাল্টাতে থাকে। আমার তৃষ্ণা জেগে ওঠে সিগারেটের। ঝুপড়ি দোকানের সামনে দেখলাম কুলিসর্দার ফারুক দাঁড়িয়ে। সে আমাকে সিগ্রেট খাওয়ায়। আমাদের মধ্যে কুশলাদি বিনিময় হয়।
ফারুকের সঙ্গে আমার পরিচয় মজমাতে। সিলেটি তাহের তাইসহ অনেকবার ওর সঙ্গে বসেছি। ওর গায়ের লাল রঙের শার্টটি আমার বেশ লাগে। ওরকম একটি শার্ট বানাতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু বউ ও লোকনিন্দার ভয়ে আমার টকটকে লাল শার্টের শখ মরে যায়। কুলিদের ড্রেস পরলে লোকে কী ভাববে? আমার অর্ধাঙ্গিনী তো ঘরে জায়গাই দেবে না।
আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। মসজিদ থেকে ভেসে আসে আজানের মোহনীয় ও পবিত্র সুর। আসসালাতু খাইরুম নিনান নাউম। ঘুমের চেয়ে নামাযই উত্তম। আমি স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৃষি সম্মাননা পেলেন কোহিনুর কামাল
পরবর্তী নিবন্ধজলের উপর জলের ছায়া