রাও ফরমান আলীর ডায়েরি ও বুদ্ধিজীবী হত্যা

ড. উজ্জ্বল কুমার দেব | বুধবার , ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৯:০২ পূর্বাহ্ণ

রাও ফরমান আলী ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেজর জেনারেল। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে তাকে পূর্ব পাকিস্তানের নিয়োগ দেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রাও ফরমান আলী সামরিক পুলিশ ও শীর্ষ সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অনুষ্ঠিত গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে তাকে চিন্তা করা হয়।

পূর্ব পাকিস্তানকে হত্যা ও ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে দমন করার জন্য পাকিস্তান সরকার যে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক সামরিক অভিযান এর পরিকল্পনা করে, তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে রাও ফরমান আলী বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ১৮ই মার্চ সকালবেলা, ঢাকা সেনানিবাসের জিওসি কার্যালয়ে বসে জেনারেল রাজার সাথে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করে হালকা নীল রঙের একটি ডাইরিতে। পেন্সিল দিয়ে পাঁচ পাতা জুড়ে ছিল এই ন্যক্কারজনক পরিকল্পনা।

অত্যন্ত চালাক এ আর্মি অফিসার যুদ্ধ শেষে মিত্রবাহিনীর কাছে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে, তখন ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় তৎকালীন ঢাকার নিরাপত্তা জোন ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে আশ্রয় নেয়। ১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর বেলা ২ ঘটিকার সময় অসহায়ের মতো জনতার সামনে বলতে থাকেন, আমরা আর যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থায় রাও ফরমান আলী তার বিরুদ্ধে আরোপিত সকল অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করলেও, হামুদুর রহমান কমিশন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও গণহত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ পায়। ১৯৭১ এর যুদ্ধ শেষে তৎকালীন গভর্নর হাউসে (বর্তমানে বঙ্গভবন) এ ডায়েরিটি পাওয়া যায়।

সেখানে দেখা যায় নিহত হওয়া ও নিখোঁজ হওয়া অনেক বুদ্ধিজীবীর নাম লেখা রয়েছে। যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন, তাদের তালিকায় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী এবং সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিবর্গ। আর এইসব হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করে আল বদর বাহিনী, যা তৎকালীন জামায়াতে ইসলামের ছাত্র সংঘের সদস্যদের দ্বারা গঠিত।

পাকিস্তান বাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের উপর সুনির্দিষ্টভাবে সারাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়িত্ব দেয়া হয়। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, পাক বাহিনীর সহযোগিতায় ঢাকা সহ সারা দেশে আল-বদর সদস্যরাই মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে চোখ বেঁধে অত্যাচার ও হত্যা করেছে।
পাকিস্তানের একজন নেতৃস্থানীয় সাংবাদিক ও আমলা ছিলেন আলতাফ গওহর। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে কর্মরত ছিলেন। তিনিও বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার একটা নীলনকশা ও হিটলিস্টের ব্যাপারে তার এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলেন। উক্ত বন্ধু গওহরকে অনুরোধ করেছিলেন হিটলিস্টে থাকা তার এক আত্মীয়ের নাম বাদ দেওয়ার জন্য।

এ অনুরোধ তিনি করেছিলেন রাও ফরমান আলীর কাছে। ঐ সময় রাও ফরমান আলী তার ড্রয়ার থেকে একটি ডায়েরি বের করে নামটা কেটে দেন। বুদ্ধিজীবীদের তালিকা সহ এই ডায়েরির পাতাগুলি রাও ফরমানের অফিসের ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশনের প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০,০০০ বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন।

কিন্তু এই পরিকল্পনা মতো হত্যাযজ্ঞ চলেনি। কারণ ফরমান আলীর লক্ষ্য ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদেরকে গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা।

বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন ১৯৮৯ সালে পাকিস্তান গিয়ে রাও ফরমান আলীর একটা সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। রাও ফরমান আলীকে যখন এই ডায়েরির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়, তখন তিনি সুকৌশলে এড়িয়ে যান। জবাবে বলেন, ‘কাউকে হত্যা করতে হলে কি আমি এভাবে তালিকা সংরক্ষণ করব? আসলে ওই সময় আমাকে এসে বিভিন্নজন অনেক লোকজনের নামে অভিযোগ করতো। আমি ওই ডায়েরিতে তাদের নাম টুকে রাখতাম, এর সঙ্গে ওই হত্যাকাণ্ডের কোন সম্পর্ক নেই’।

এই সাক্ষাৎকার থেকে আরো জানতে পারি একাত্তরে চলা হত্যাকাণ্ড কে রাও ফরমান আলী গণহত্যা বলতে নারাজ। সত্যিকার অর্থে ১৯৭১ এর ২৫ শে মার্চ কালরাত্রির পর থেকেই সারা বাংলাদেশ জুড়ে বুদ্ধি ভিত্তিক কর্মকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার ও হত্যা করা শুরু হয়েছিল। কিন্তু নভেম্বর মাসের দিকে এসে সামরিক জান্তা যখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, এই যুদ্ধে আর তাদেরকে জেতা সম্ভব নয়, ঠিক তখনই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আরো জোরদার করা হয়। এটি ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত।

পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পরিকল্পনা করেছিল, দেশকে বুদ্ধিজীবীশূন্য করে দিতে পারলে বাংলাদেশ যদি কখনো স্বাধীনও হয় ; এই জাতি কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। এ ধারণা থেকে আসলে সুচিন্তিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছিল মূলত ১০ই ডিসেম্বর থেকে। চূড়ান্ত বাস্তবায়ন শেষ করে ১৪ ডিসেম্বর। এ সময় অনেকের দেহে আঘাতের চিহ্ন, চোখ, হাত-পা বাঁধা, কারো কারো শরীরে একাধিক গুলি, অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে। যা থেকে হত্যার পূর্বে তাদের নির্যাতন করা হয়েছিল সে তথ্যও বের হয়ে আসে। আমরা হারিয়েছিলাম আমাদের জাতির সবচেয়ে ১১১১ জন প্রতিভাবান সূর্যসন্তানকে।

একটি জাতিকে সঠিক পথের ঠিকানা দেন বুদ্ধিজীবীরা। বুদ্ধিজীবীরাই জাগিয়ে রাখেন জাতির বিবেক। সাহিত্যিকরা তাদের রচনাবলীর মাধ্যমে, সাংবাদিকরা তাদের কলমের মাধ্যমে, শিল্পীরা তাদের গানের সুরে, শিক্ষকরা তাদের পাঠদানে, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদরা জনগণের সান্নিধ্যে আসার মাধ্যমে। কিন্তু জাতিকে দিকভ্রান্ত করার জন্য ১৯৭১ এ এদেশের কিছু মানুষের সহযোগিতায় সারাদেশে গণহত্যা চালায় পাকবাহিনী। সারা দেশে এখন পর্যন্ত ৯৪২ টি বধ্যভূমি সনাক্ত করা হয়েছে, যেখানে নির্যাতন করা হয়েছে আমাদের জাতির সূর্যসন্তানদের। সে সমস্ত প্রতিথযশা ব্যাক্তিরা আজো বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের ইতিহাস আরও সমৃদ্ধ হত, দেশ হত উন্নত। বিনম্র শ্রদ্ধায় আজ স্মরণ করি সে সমস্ত বীরকে, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন।

লেখক: অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ