দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৯:০২ পূর্বাহ্ণ

আমার হাতে ট্রেনের টিকেট। আমার হাতে তিন দিনের হোটেল বুকিং-এর স্লিপও। বেইজিং যাওয়া এবং তিনদিন আরামে থাকার ব্যবস্থা আপাতত হয়েছে। এর থেকে বেশি থাকতে চাইলেও কোন সমস্যা নেই। হোটেলের বুকিং বাড়ানো যাবে, ট্রেনের টিকেটও পরিবর্তন করা যাবে। শুধু সময়মতো জানাতে হবে। আমার বন্ধু ইউছুপ আলী ভাইর গুয়াংজু অফিসের কর্মকর্তা চীনা তরুণী মিজ লোটাস সবকিছু আমাকে পই পই করে বুঝিয়ে দিলেন। পরদিন বেলা দুইটা নাগাদ ট্রেন।

জোবায়ের এবং কায়সার ভাই আমার সাথে গুয়াংজু স্টেশনে যাবেন এবং আমাকে ট্রেনে তুলে সিটে বসিয়ে দিয়ে আসবেন। সব প্রোগ্রাম ঠিকঠাক করার পর নিজেকে বেশ নির্ভার মনে হলো। আবারো কফি নিলাম। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে টের পেলাম যে আমার ভিতরের অস্থিরতা উবে গেছে।

বেশ উত্তেজনায় রাত কাটলো। গুগলের সহায়তায় বেইজিং সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় তার সবটুকুই জেনে নেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বিশাল বেইজিং এর কতটুকুই বা জানা যায়! এত বড় দেশের রাজধানী, কত মানুষ! কত ব্যবসা কত বাণিজ্য, কত রাজনীতি, কত কূটনীতি! আরো কত কিছু যে আছে বেইজিং-এর আনাচে কানাচে!! অথচ এর কিছুরই তেমন একটা প্রচারণা নেই, জানতামও না। আসলে আমার মনে হয় চীন সরকার তাদের সম্পর্কে কোনকিছুই বিশ্বকে জানাতে চায়না।

নিজেদের মতো করে নিজেরা থাকতে চায়। হয়তোবা বৈশ্বিক কিংবা অভ্যন্তরীন রাজনীতি বা ক্ষমতা রক্ষার তাড়না থেকেই সরকার নিজেদের সবকিছুতে অন্যরকমের একটি গোপনীয়তা রক্ষার চেষ্টা করে। তথ্য প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের মাঝেও চীনের কোটি কোটি মানুষ ফেসবুকের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নাম শুনেনি। শুনেনি কিংবা ব্যবহার করেনি হোয়াটসআপের মতো যোগাযোগ মাধ্যমও। তথ্য প্রযুক্তির আরো বহু কিছু এরা চিনে না, জানে না সেগুলো সম্পর্কে। অবশ্য তারা নিজেদের মতো করে নিজেদের যোগাযোগের জন্য সর্বোচ্চটা করে নিয়েছে। চীন ‘উইচ্যাট’ নামের আলাদা একটি এ্যাপস তৈরি করেছে। কিউকিউ নামের একটি এ্যাপসও সেখানে বেশ জনপ্রিয়।

আরো নানা নামে নানা কাজের নিজস্ব এ্যাপস রয়েছে তাদের। দেড়শ’ কোটি মানুষের বিশাল বাজারে তারা যা করে সেটিই টিকে যায়, সফল হয়। এতে করে পশ্চিমা বিশ্বের কোন কিছুর তোয়াক্কা না করেও তারা দিব্যি বিশ্ববাণিজ্যে রাজত্ব করছে। গুগলে নানা কিছু দেখতে দেখতে আমার মনে হলো, চীনের এত এত ঐতিহ্য,সম্পদ এবং সৌন্দর্য আছে যে যা বিশ্বের পর্যটন খাতকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করতে পারে। বিশ্বের দরবারে সবকিছু উন্মুক্ত করে দিলে তাদের ভাবমূর্তি অনেক বেশি উজ্জ্বল হতো, উপকৃত হতো পৃথিবী।

পর্যটনের এত বেশি সম্পদ তাদের পরতে পরতে ছিটিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে যে চাইলে পৃথিবীর অনেক বেশি ট্যুরিস্ট তারা আকৃষ্ট করতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন পর্যটন স্পট ঘুরে ওদিকে চীনের খুব বেশি নজর আছে বলে মনে হয়নি। এক ক্যান্টন ফেয়ার নিয়ে তাদের যে আগ্রহ, গ্রেটওয়াল নিয়ে তার এক শতাংশও নেই!
অবশ্য তাদের নিজস্ব পর্যটকের সংখ্যাই অনেক। বিশাল দেশ, বিপুল মানুষ, বিশাল বাজার। নিজেদের শিল্পোৎপাদন নিয়ে নিজেদের মতো করে বিশ্বের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে তারা। বিশ্বের মেগাকারখানা খ্যাত চীন পুরো দুনিয়ার সবকিছুরই যেন একক যোগানদাতা! একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো একটু পরিষ্কার হবে। তৈরি পোষাক রপ্তানিতে চীন বিশ্বের এক নম্বর স্থান দখল করে আছে বহু বছর ধরে।

তারা বছরে প্রায় ৫শ’ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। বিপরীতে ৩০ বিলিয়নের রপ্তানি নিয়ে দ্বিতীয় স্থান ধরে রাখতে বাংলাদেশ ভিয়েতনামের সাথে যুদ্ধ করে! প্রথমের সাথে দ্বিতীয়ের ব্যবধান ১৬ গুণের বেশি। এই একটি তথ্যই প্রমাণ করে চীনের অর্থনীতিতে শিল্পায়ন ঠিক কোন পর্যায়ে রয়েছে।

রাতে জম্পেশ খাওয়া দাওয়ার পর জাহেদ ভাই ব্যাগ গুছিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়ে বললেন, শীতের কাপড়ছোপড়সহ হালকা কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখুন। বেইজিং-এ যা লাগবে শুধু তা নিয়ে যান। বাকি জিনিসপত্র এখানে থাক। সবকিছু নিয়ে টানাটানির কোন দরকার নেই। কথাটি আমার মনে ধরলো। যেহেতু আমি গুয়াংজু হয়ে ঢাকা ফিরবো, সুতরাং বেইজিং এত কিছু টানাটানির দরকার কি! একটি কেবিনব্যাগে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখলাম। দুপুরে ট্রেন, সুতরাং তেমন কোন তাড়াহুড়ো নেই। জাহেদ ভাই বললেন, একটু আর্লি লাঞ্চ করে বের হবেন। সমস্যা হবে না।

সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর বেইজিং যাওয়ার কথা মনে হতে পরাণটা কেমন যেনো করে উঠলো। শেষপর্যন্ত বেইজিং যাচ্ছি!!
নাস্তার আয়োজন অনেক। মেহমানের জন্য দুহাত উজাড় করে নানা খাবার তৈরি করা হয়। সকালের নাস্তায় এত কিছু লাগে না। অথচ কি যে এলাহী আয়োজন! ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে আমাকে স্টেশনের পথ ধরতে হবে। তাই আর বের হলাম না। জাহেদ ভাই সবাইকে নিয়ে অফিসে চলে গেলেন। বললেন, আপনি লাঞ্চ করে তৈরি হয়ে থাকবেন। কায়সার ভাই আর জোবায়ের এসে আপনাকে নিয়ে যাবে। বেইজিং থেকে ফেরার পর আমার সাথে দেখা হবে। কোন সমস্যা যদিও হবে না, তবুও যে কোন সমস্যায় ফোন করবেন।

আমি টিভি দেখছিলাম। চীনা নৃত্যের একটি অনুষ্ঠান দেখছিলাম। কিছু না বুঝলেও ছন্দ বেশ ভালো লাগছিল। পৃথিবীর সব দেশেই সুর এবং ছন্দের ভাষা মনে হয় একই। অন্তরের একেবারে গভীরে গিয়ে দোলা দেয়, ঝড় তোলে! চীনা গৃহপরিচারিকা রান্না ঘরে কাজ করছেন। আর্লি লাঞ্চের তাগাদা দেয়া হয়েছে তাকে। নিশ্চয় তিনি অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু বেশি তাড়াহুড়ো করছেন। আমি এক কাপ কফি দেয়ার অনুরোধ করলাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি এক মগ কফি এনে দিলেন। ধোঁয়া এবং গন্ধ একই সাথে যেন উড়াউড়ি করছিল।

স্টেশনে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছিল। কিন্তু বিলম্বে নাস্তা করার কারণে লাঞ্চের নামে আমার আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছিল না। কায়সার ভাই এবং জোবায়ের আমাকে স্টেশনে নেয়ার জন্য এসে গেছেন। তারাও আর্লি লাঞ্চ করে নেবেন। স্টেশন থেকে ফিরতে ফিরতে অনেক সময় লেগে যাবে। তাছাড়া আসার পথে তারা বাসায় না এসে অফিসে চলে যাবেন।

বাসা থেকে কিছু পথ হেঁটে টেক্সি নিলাম আমরা। চীনা ড্রাইভার। যা বলার কায়সার ভাই বললেন। আমি চুপ করে থাকলাম। স্টেশনে নামার পর আমার চক্ষু চড়কগাছ। আবারো মনে হলো যে, বিশাল চীনের সবকিছুই বিশাল বিশাল। একটি রেলওয়ে স্টেশন যে এত বড় হতে পারে তা আমার ধারণাতেই ছিল না। বিশাল রেলওয়ে স্টেশন, যেন একটি বিমানবন্দর। নিরাপত্তা তল্লাশী থেকে শুরু করে নানা কিছু বিমানবন্দরে মতো।

মানুষ গিজগিজ করছে। দৌড়াচ্ছে, ছুটছে। তবে এত মানুষের ভিড়ের মাঝেও একটি জিনিস বেশ চোখে পড়লো যে, স্টেশনটি অসম্ভব রকমের পরিষ্কার, তকতকে ঝকঝকে। দেয়াল লিখন নেই, কোন পোস্টার নেই। চিকা মারামারির কোন কিছু চোখে পড়লো না। লাল সালু মাথায় বেঁধে কুলিদের দৌঁড়াদৌঁড়ির কোন দৃশ্য চোখে পড়লো না। মন ভালো করে দেয়ার মতো একটি পরিবেশ চারদিকে। বিমানবন্দরের মতো ডিজিটাল ডিসপ্লে। কোন ট্রেন কখন যাত্রা করবে, কখন আসবে, কত নম্বর প্ল্যাটফরমে দাঁড়াবে তার সবই প্রদর্শিত হচ্ছে।

কায়সার ভাই আমাকে দেখালেন যে, আমার ট্রেনটি সাত নম্বর প্ল্যাটফরম থেকে যাত্রা করবে। আমরা নানা পথ মাড়িয়ে সাত নম্বর প্ল্যাটফরমে এসে দাঁড়ালাম। এখনো ট্রেন আসেনি। আমি কিছুট ভড়কে গেলাম। লেট হবে নাতো! কারণ এদিকে যত লেট হবে ওদিকে রাত তত গভীর হবে। অচিন বেইজিং এ গভীর রাতে গিয়ে কোন্‌ বিপদে পড়ি!!

আমার কথা শুনে কায়সার ভাই হাসলেন! বললেন, এক সেকেন্ডও না। টিকেটে যে সময় লিখা আছে ঠিক সেই সময়ই ট্রেন যাত্রা করবে। এক সেকেন্ড আগেও না, এক সেকেন্ড পরেও না। ইউরোপের দেশে দেশে ‘সেকেন্ড’ হিসেব করে ট্রেন চলতে দেখেছি। রেল যোগাযোগে চীন কী তাহলে ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছে গেছে!

অল্পক্ষণের মধ্যে ‘সাঁই’ করে ছোট্ট একটি শব্দের সাথে চমৎকার একটি ট্রেন এসে প্ল্যাটফরমে দাঁড়ালো। চমৎকার মানে ইঞ্জিনের সামনের দিকটি বিমানের মতো, বেশ লম্বাটে। বাতাসের বাঁধা কেটে ছুটে চলার জন্য নাকি ইঞ্জিনের সামনের দিকটি একেবারে সরু করে ফেলা হয়। এমন ট্রেনের প্রথম দেখা পেয়েছিলাম জাপানে, টোকিওতে। পরে অবশ্য ইউরোপের বহুদেশেই এমন দূরন্তগতির ট্রেন দেখেছি, চড়েছি।

বেইজিংগামী ট্রেনটিও সেই একই ধাঁচের। এটি নাকি ঘন্টায় তিনশ’ কিলোমিটার বেগে চলে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, ঢাকা চট্টগ্রাম রুটে যেসব বিমান চলাচল করে সেগুলো গড়ে ৫শ’ কিলোমিটার বেগে চলাচল করে। হেলিকপ্টারের গতিবেগ দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ কিলোমিটারের মধ্যে। এমনতর পরিস্থিতিতে ঘন্টায় তিনশ’ কিলোমিটার বেগের ট্রেন সামনে দাঁড়ালে রোমাঞ্চতো একটু জাগতেই পারে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা
পরবর্তী নিবন্ধরাও ফরমান আলীর ডায়েরি ও বুদ্ধিজীবী হত্যা