৩০ দশকের বাংলা কবিতার নৈরাজ্যিক রিরংসা-জাত হতাশা, নেতি, অবক্ষয়- এইসব প্রতীচ্য উচ্ছিষ্ট বা ‘ক্লেদজ কুসুম’-এর পঙ্কিল আবর্ত থেকে উত্তীর্ণ ৪০ দশকে কবিতা দায় ও মুক্তির পথে বাঁক নেয়। এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন বা দিকবদলের অনুঘটক-এর ভূমিকা পালন করেন সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সমর সেন- এই ত্রয়ী এবং তাদের অন্য সহযোগী ও অনুবর্তীবৃন্দ।
সুকান্ত পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটি’র চিত্রকল্পে তিরিশীয় বোদলেয়র-ভারাক্রান্ত নন্দনতত্ত্বের মুখায়ববে রূঢ় ও জান্তব চপেটাঘাত করে যেখানে পরিবর্তনের প্রাণে নতুন উষ্ণ রক্ত সঞ্চার করেছিলেন, এর সমান্তরালে দিনেশ দাশ ‘এর যুগের চাঁদ হলো কাস্তে;- এই চূড়ান্ত উচ্চারণ ছিলো বাংলা কবিতায় জনসম্পৃক্ত বৈপ্লবিক ধারার উন্মোচন। এই দর্শনের অন্য অনুকারকবৃন্দের মধ্যে রয়েছেন মণীন্দ্র রায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গোলাম কুদ্দুস প্রমুখ।
এতোসব প্রসঙ্গের অবতারণা এ কারণে যে, স্বল্পায়ু কবি রমেন দত্তের কাব্যসংগ্রহ পাঠ-অভিজ্ঞতায় এই প্রতীতি সঞ্চারিত হলো যে, মাত্র ৫৩ বছরের জীবৎবালে ন্যূনাধিক ৩৬টি কবিতার রচয়িতা এই শব্দ-কোবিদ এমন এক পরিক্রমায় পদাতিক ছিলেন, যার মূল্যায়ন করেছেন তারই সতীর্থ ‘জলৌকা হে নীল যমুনা’, ‘কালনেমিকাল’- কাব্য-কুসুমের স্রষ্টা ৬০ দশকের কবি শামসুল ইসলাম। তাঁর অভিমত ‘নিত্যদিনের অর্থাৎ আটপৌরে জীবনের সমূহ গ্লানিকে উপেক্ষা করে শুভঙ্কর এক স্বপ্নলোকের দ্বীপে উত্তীর্ণ হবার বাসনার-দুর্মর আবেশনিমগ্ন আবহ আর চিত্রকল্প তার ছন্দের নিবন্ধে ধরা পড়ে আছে।
হে জীবন, আরো নিবিড় আশ্লেষে বাঁধো
হে জীবন, আরো কল্লোল মুখর হও।
এ ধরনের ছত্রে জীবনের ভালোবাসার দুর্মর বাসনা তার মধ্যে কাজ করেছে। পৃথিবী একদিন সুন্দর হবে। ভালোবাসা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছবে। কবির আশাবাদী মন এ-রকম প্রত্যয়ে আচ্ছন্ন থেকেছে…’
এই অভিমত এবং কবি রমেন দত্তের সমুদয় কবিতা সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় উপলব্ধ অভিমত এমন যে, কবির কাব্য-অন্বিষ্ট কেবল ফুল-পাখি-নদী-চাঁদ-প্রজাপতি-জোছনাধর্মী নিরেট সৌন্দর্যচর্চা নয়। তার মানস-পরিধি জনসম্পৃক্তি, গণচেতনা- সর্বোপরি শুভবোধের সুস্থ ও সুবল বারতাবাহী। তার সুস্পষ্ট ঘোষণা-
‘অঙ্কুরিত সে প্রতিভা দিনে দিনে দীর্ণকার অন্ধকার ব্যূহ/তারপর একদিন হয় মহীরূহ’ (নায়ক)
অথবা
‘ধমনীতে রক্ত নাচে বারবার দোল লাগে প্রাণে
কালের-মন্দিরা ধ্বনি নবতম বার্তা আনে’ (শপথ) রমেন দত্তের সমগ্র সৃষ্টি ও জীবন-অভীপ্সার প্রত্যক্ষ রূপায়ন-
‘এইটুকু হাসি-সুখ এইটুকু সংগীতের কণা/প্রাণের একটি সুরও ব্যর্থ হতে দেবো না- দেবো-না/দাঙ্গা-যুদ্ধ-হাহাকার-মারি আর মড়কের সাথে/শক্তি পরীক্ষা হবে। সংকল্পের দৃঢ়বদ্ধ হাতে/ছিন্ন করে আঁধারের হীনতম মিথ্যা যবনিকা/সগর্বে উড়াতে হবে আনন্দের আলোক-পতাকা।’
ছন্দ্যোনিষ্ট কবি ছিলেন রমেন দত্ত। তার কোনো কবিতায় বিন্দুমাত্র মাত্রাচ্যুতি ঘটেনি। ১৮ মাত্রার ক্ল্যাসিক্যাল অক্ষরবৃত্তে কবিতা রচনা করছেন সুনিপুণভাবে। আর এই ছন্দ্যোপাচার আরোপিত বা সচেতন বলে বিবেচনা করার কোনো অবকাশ নেই। তার ছন্দ স্বতোঃৎসারিত। সহজ। স্বাভাবিক ও অকৃত্রিম। সনেট রচনায়ও পারঙ্গম ছিলেন তিনি।
সবচেয়ে প্রশাংসার্হ হলো- অসম ও বিবিধ মাত্রায় মাত্রাবৃত্তে কবিতা রচনায় দুর্লভ ও ব্যতিক্রমী কৌশল প্রয়োগ করেছেন তিনি সুচারুভাবে। বাংলা ও বাংলা সাহিত্যের জন্যে নিতান্তই দুর্ভাগ্যজনক- এই ক্ষমতাবান কবি পূর্ণ বিকশিত হওয়ার আগেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তার জন্ম ১৯৩২ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোণায়। ১৯৬৫ সালে অর্ধসাপ্তাহিক ‘আমার দেশ’ ও ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ অবধি দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত ছিলেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা ছিলো অনন্য। তিনি ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘মুক্তি’র সম্পাদকের দায়িত্বের ছিলেন খন্দকার আবদুল মালেকের সহযোগে। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন দেশে প্রখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ তোহা খান ও কবি আল মাহমুদ সহ ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় কাজ করেন। দেশের অগ্রণী প্রকাশনা সংস্থা ‘মুক্তধারা’ ১৯৭৩ সালে তার গল্পগ্রন্থ ‘শ্বেতপদ্মের রূপ’ প্রকাশ করে। ১৯৮৫ সালে রমেন দত্ত পরলোক গমন করেন। রেখে যান একমাত্র পুত্র শৌভিক প্রসাদ দত্ত। সহধর্মিণী অঞ্জনা দত্ত তার মৃত্যুর আগেই পরপারে গমন করেন।
রমেন দত্তের কনিষ্ঠ ভ্রাতা গল্পকার রথীন্দ্র প্রসাদ দত্ত পরম মমতায়-আন্তরিকতায়-যত্নে প্রয়াত অগ্রজ রমেন দত্তের এই কবিতা সংগ্রহ প্রকাশ করেন। সম্পাদনায় রথীন্দ্র প্রসাদ দত্ত যে নিষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন তা অবশ্যই প্রশংসার্হ। এই কাব্যের প্রকাশক খড়িমাটি। মূল্য ১৬০ টাকা।