রবীন্দ্রসাহিত্যে নারী

ড. নাজনীন বেগম | শুক্রবার , ৫ মে, ২০২৩ at ৭:৩৫ পূর্বাহ্ণ

১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ আসেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর এবং নওগাঁর পতিসরে। পৈতৃক জমিদারি তদারকি করতেই তিনি গ্রামবাংলার নিভৃত পল্লির ছায়াঘন আবহে ঘুরে বেড়িয়েছেন। প্রমত্ত পদ্মায় বজরাভ্রমণের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্য পায় এক অনবদ্য কাব্যসম্ভার। ‘সোনার তরী’ কাব্যগাথা আজও কবিকে মহিমান্বিত করে, সৃজনদ্যোতনায় তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ কবিতাগুচ্ছকে কাল থেকে কালান্তরে পৌঁছেও দেয়। শুধু তাই নয়; নৈসর্গিক সৌন্দর্যে পরিপুষ্ট বাংলার পল্লিজননী কবিকে নতুন এক জগৎ আর বাংলার সাহিত্যকে দেয় এক অভাবনীয় সম্পদ। গ্রামীণ জনপদ আর হতদরিদ্র মানুষের মিলনসৌধে কবির সৃষ্টিশীল আঙিনা যেমাত্রায় ঝংকৃত হয়ে ওঠে সেখান থেকেই তৈরি হতে থাকে ছোটগল্পের আঙ্গিক আর বৈশিষ্ট্য।

বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের প্রথম সার্থক রূপকার রবীন্দ্রনাথ একেবারে পল্লিবাংলার মূল শেকড় থেকে তুলে আনেন তার গল্পের আনুষঙ্গিক রসদ। সমাজসচেতন রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত ব্যবস্থার গভীরে গেড়ে বসা অপসংস্কারকে একেবারে কাছ থেকে দেখেন। অবিভক্ত বাংলার নবজাগরণের মধ্যাহ্নে রবিকিরণের উন্মেষ; তবে শহরকেন্দ্রিক আধুনিকতার জোয়ার তখন অবধি গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছয়নি। ঐতিহ্যিক ঠাকুরবাড়ির পরশমণি রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর সমৃদ্ধ বলয় থেকে চলে এলেন হতদরিদ্র, নির্বিত্ত, মূর্খ, মূঢ় জনগোষ্ঠীর একান্ত সান্নিধ্যে। একেবারে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করলেন নিপীড়িত, নির্যাতিত সিংহভাগ গোষ্ঠীর বংশানুক্রমিকভাবে চলে আসা অসহায়ত্ব এবং দুর্ভোগকে। তার চেয়েও বেশি মর্মাহত হলেন পিছিয়ে পড়া অর্ধাংশ নারীসমাজের অবর্ণনীয় দুঃখ আর দুর্দশা দেখে। সেই বোধে নবদ্যুতির আলোকে সৃজনক্ষমতা এক নিরন্তর গতিপ্রবাহকে আমন্ত্রণ জানাল। বাংলা সাহিত্যের আঙিনা ভরে উঠল অপরিচিত এক ছোটগল্পের মোড়কে। এর আগে বাংলা সাহিত্যে কোনো গল্পের ধারা ছিল না। ভাবুক, আবেগপ্রবণ, রোমান্টিক কবি সামাজিক বাস্তবতার টানাপোড়নে হয়ে উঠেন বিদগ্ধ এক সমাজপর্যবেক্ষক। একেবারে কাছ থেকে অনেকটাই নিজের দেখা, বাকিটা সৃষ্টিশীল চেতনায় তৈরি হতে থাকে তাঁর গল্পের সমৃদ্ধ অবয়ব। সাহিত্যের নবতর এই আঙিনায় তাঁর হাত দিয়ে যেসম্পদ তৈরি হতে থাকে সেখানে শুধু তিনি পথিকৃৎই নন; এখনও মহানায়কের অপ্রতিহত জায়গায়।

নারীর প্রতি বিশেষ দায়বদ্ধতায় এই পশ্চাৎপদ অংশের সামাজিক অভিশাপ আর বঞ্চনার যেকঠিন বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে গল্পের মূল আঙ্গিকে সেটাই ছোটগল্পের মাহাত্ম্যকে আজ অবধি পাঠকসমাজ নানা মাত্রিকে বিমোহিত আর আলোড়িত হয়ে যাচ্ছে। এমনকি তার চিরস্থায়ী আবেদনে এখনও পাঠক বিস্ময়াভিভূত হয়ে রস সম্ভোগও করছে। ঊনিশ শতকীয় নতুন জোয়ারের সুবর্ণ সময়ে গ্রামবাংলার নারীসমাজের অবস্থা কত শোচনীয়, মর্মান্তিক এবং বেদনাবিধুর ছিল; তেমন অসহায়ত্বও তাঁর গল্পের বিষয়বস্তুকে ভারাক্রান্ত অনুভবে পাঠকের হৃদয়ে আঘাত করে। নতুন পুরানোর দ্বন্দ্বই শুধু নয়, সমাজের অসম বিকাশ নারীজাতির চলার পথকে কতখানি কণ্টকিত আর নির্জীব করে রেখেছিল নারীচরিত্ররূপায়ণে সেসব প্রতিবন্ধকতাও তাঁর সৃজনসত্তায় ভর করে। ফলে নারীনিপীড়নের বাস্তব ঘটনাপ্রবাহ তৎকালীন সমাজব্যবস্থার বিক্ষুব্ধ চালচিত্র বলাই যায়।

১৮৯০ সালে ‘দেনাপাওনা’ দিয়েই তাঁর গল্পের শুভযাত্রা। পণপ্রথার আবর্তে নির্বিত্ত পিতা আর অসহায় কন্যার যেমর্মবেদনা ফুটে ওঠে, শতবর্ষ পরেও তার আবেদন আজও সচেতন অংশকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। গ্রামবাংলার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অতিসাধারণ ঘটনাগুলো তার গল্পের উপজীব্য হয়ে যেসম্ভার পাঠকসমাজের কাছে আসে তা যেমন অসাধারণ, একইভাবে কঠিন বাস্তবের অসহনীয় এক দুর্ভোগ। সাধারণ নিম্নবিত্তের নিঃসম্বল পিতা আর পণপ্রথার জাঁতাকলে পিষ্ট কন্যার যেঅবর্ণনীয় দুর্যোগ তার শেষ পরিণতি হয় আত্মহননের মধ্য দিয়ে। এখনও আমাদের দেশে যৌতুকের বলিতে পীড়িত হওয়া নারীর সংখ্যা একেবারে কম নয়। কবি লিখছেন : আত্মঘাতী নিরুপমার শেষকৃত্য হয়েছিল আড়ম্বর আর আর্থিক ব্যয়বহুলতায়। শেষ করছেন এই বলে : উৎসবে আয়োজনে, সাড়ম্বরতায় সত্যিকারের প্রতিমা বিসর্জনই বটে।

১৮৯১ সালে লেখেন ‘কঙ্কাল’। নারীনিগ্রহের অভিনব এবং বিচিত্র এক কাহিনি; এতেও আছে সমাজব্যবস্থার প্রাচীন অনুশাসনের মর্মস্পর্শী বিধি। সেই বাল্যবিবাহপরিণতিতে অকাল বৈধব্যের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে সহায়সম্বলহীন অবস্থায় পিতৃগৃহে ফিরে আসা। গল্পের নায়িকা অনামিকা। নামহীন এই বালিকা কোনোএক সময় বৈধব্যকে বরণ করলে দুর্ভাগ্যের কশাঘাতে জীবনটা বিপন্ন অবস্থায় ঠেকে। শ্বশুরশাশুড়ি মিলে ‘বিষকন্যা’র অপবাদ দিয়ে বাপের বাড়িতে পাঠায়। অলক্ষ্মীর সমস্ত বোঝা মাথায় নিয়ে জীবন কাটাতে হয়। শুধু তাই নয়; বালিকা হতে পরিপূর্ণ যুবতী হওয়ার রোমাঞ্চকর অনুভূতি ভেতরে শিহরণও জাগায়―বয়ঃসন্ধিকালে যা কোনো উদীয়মান কিশোরকিশোরীর নবচেতনার অন্যরকম এক অনুভব। আর সেটাই কাল হলো ঝলমলে এই তরুণীর। কচি বয়সে যা ছিল ‘যমদেবতার’ মতো কদর্য, আগত যৌবনে সেখানে বাসা বাঁধে ‘মদন দেবতা’। সমাজবহির্ভূত বিধবা প্রেমই নয়; একেবারে গোপন প্রণয়। পরিণতিতে যা হওয়ার তাই হলো। দুর্বিষহ এবং লোমহর্ষক এমন কাহিনি গড়ায় খুন ও আত্মহত্যার চরম দুর্বিপাকে। প্রেমিককে বিষ দিয়ে হত্যা করা এবং নিজেকে শেষ করে দেওয়া কাহিনির গতিনির্মমতার বেড়াজালে আবদ্ধ হওয়া ছাড়া আর কোনো সহজ ও স্বাভাবিক রাস্তা কবির সামনে খোলা ছিল না―সামাজিক অপসংস্কারের নিষ্ঠুর প্রথার কারণে। সমাজের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেমের পরিণতি কি নতুন সময়ে নবচেতনায় এগিয়ে গেছে? ১৮৯৩ সালে লেখা ‘শাস্তি’ গল্পটি আজ অবদি পাঠকহৃদয়ে আলোচিত হয়ে যাচ্ছে। কবির লেখনীতে আছে : গল্পের প্রধান দুই পুরুষ চরিত্র দুখিরাম ও ছিদাম তাঁদের জমিদারির আঙিনায় কামলা খাটত। অর্থনৈতিক সঙ্কটের দুর্বিপাকে পড়া দুই ভাইয়ের নিত্য জীবন। স্ত্রীদের ঝগড়াঝাঁটি, অসংযত ব্যবহার, তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ, সংহার মূর্তি―সেও জীবনের অপরিহার্য এক ব্যাপার। এসব নির্বিত্ত খেটেখাওয়া মানুষেরা নাপায় যথার্থ মর্যাদা, বঞ্চিত হয় প্রাপ্ত মজুরি থেকেও। ফলে মনমেজাজও সবসময় তিরিক্ষি থাকে। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, ক্ষুধার্ত দুখিরাম ঘরের উঠোনে পা দিয়েই খাবার প্রত্যাশা করে একটু রাগী মেজাজে; সঙ্গে স্ত্রীর শ্লেষবাক্যে অগ্নিশর্মা হতে সময় লাগে না। অগ্নিমূর্তি দুখিরাম ক্ষোভে, উত্তেজনায় দা দিয়ে স্ত্রীর মাথায় আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই রাধার মৃত্যু হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় দুভাই বিমূঢ় ও স্তব্ধ হয়ে যায়। উপায়ন্তর নাদেখে ছোট ভাই ছিদাম তার বহু যত্নে, আদরে লালিত স্ত্রী চন্দরার ওপর এই খুনের দায়ভাগ চাপিয়ে দেয়। হতবিহ্বল ও দিশেহারা চন্দরা এমন অভিযোগে কোনো উত্তর খুঁজেও পায় না। এক ভাই নির্দ্বিধায় নিজের স্ত্রীকে খুন করে ফেলল বিনা অপরাধে। আর অন্য ভাই নির্দোষ স্ত্রীর গায়ে খুনির তকমা লাগিয়ে দিলো নিঃসংশয়ে, নিঃসঙ্কোচে। এমনই ছিল ঊনিশ শতকের ক্রান্তিলগ্নে গ্রামবাংলার সামাজিক ব্যবস্থাপনায় নারীনিগ্রহের কঠোর অভিশাপ। কবির নিজের জবানিতে আছে : এমন বহু হৃদয়বিদারক আর নৃশংস ঘটনা পল্লিবালার নির্মম সামাজিক বেষ্টনীতে ঘটে যেত। সহিংসতার অদম্য বেড়াজাল ভেদ করে অসহায় ও নির্বিত্ত শ্রেণি কোনোভাবেই বের হয়ে আসতে পারত না। শারীরিকভাবে অসহায় ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল নারীরা সামাজিক অব্যবস্থার কঠিন নিগড়ে আটকে থাকত। এক সময় দুইভাই এই খুনের দায়ভার থেকে চন্দরাকে বাঁচাতে চাইলেও অনমনীয় এই নারী কিছুতেই রাজি হয়নি। এমন বলিষ্ঠ নারীচরিত্রও কবি এঁকেছেন।

. নাজনীন বেগম, সিনিয়র সাংবাদিক ও গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধআনোয়ারায় মাহাতা পাটনীকোঠা আদর্শ বিদ্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় সংবর্ধনা