রণাঙ্গনের ফরাসী বন্ধু অ্যান ডি হেনিং

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ১ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৩০ পূর্বাহ্ণ

সেদিন অসহায়ভাবে ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় ছিলনা! ঘরবাড়ি দোকানপাট পুড়ে পুড়ে ধোাঁয়ার কুন্ডলী আকাশ ছোয়া ঘনকালো মেঘের মতো। কখনো আগুনের লাল আভা চোখ ঝলসে দিচ্ছে। মানুষ পাগলের মতো দিশাহীন দৌড়াচ্ছে সাথে গবাদিপশুও।

 

এই দৃশ্য ধারণ করার মতো কোন ক্যামেরা আমাদের কাছে ছিলোনা। কিন্তু বুকের মধ্যে সেই ক্ষত এখনও দগদগে। ক্ষেত্রপাল স্যারের আহাজারি, তাঁর স্ত্রীর সম্ভ্রম বাঁচাতে আগুনে পুড়ে মরার কোনটাই আমরা ক্যামেরায় ধারণ করিনি। সর্বস্ব হারানো মানুষের আর্তনাদের ভিডিও আমাদের নেই। আছিয়া বেগমের

চারপাশের লাশের স্তুপ থেকে গুলিবিদ্ধ দুই পা নিয়ে উঠে আসার দৃশ্যও আমাদের হাতে নেই। এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে যে নৃশংসতা চালিয়েছে পাকিস্তানীরা তার কতটুকুইবা বিশ্ব জেনেছে? সেই নয় মাসের দগ্ধ ক্ষত নিয়ে যারা আজও বেছে আছেন তাদের কতজনকেইবা আমরা মনে রেখেছি! ভাগ্য

ভালো কিছু মানবতাবাদী বিদেশি সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই মুক্তি পাগল মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এটা সত্যি যে তখন মিডিয়া এত শক্তিশালী ছিলো না। ৫২ বছর পার করেছি স্বাধীনতার। আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু অরক্ষিত হলেও এখনও সুরক্ষিত আছে অনেক বিদেশি ফটো

সাংবাদিকদের কাছে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের অবিস্মরণীয় কিছু দলিল। সেই দীর্ঘ দুই দশক পরে মেধাবী চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা লিবার লেভিনের কাছ থেকে এক অসাধারণ প্রামাণ্য চিত্র উদ্ধার করেন। যেটা আমরা তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’এ দেখতে

পাই। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা ডকুমেন্টরি ফিল্ম করার জন্য এদেশের একদল সংস্কৃতি কর্মীর সঙ্গ নেন মার্কিন এই চলচ্চিত্র নির্মাতা। যারা শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের দেশাত্মবোধক ও সংগ্রামী গান শুনিয়ে উজ্জীবিত করতেন। এই শিল্পীদের সাথে থেকে লেভিন প্রায় ২০ ঘন্টার ফুটেজ সংগ্রহ

করেন। যুদ্ধের শেষের দিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তিনি সেই ডকুমেন্টরি সম্পূর্ণ করতে পারেননি। এইরকম ছড়িয়েছিটিয়ে আছে আজও পৃথিবী জুড়ে আমাদের দুঃখ দিনের স্মৃতিগুলো। গত ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে হয়ে গেল অ্যান ডি হেনিংএর উইটনেসিং হিস্ট্রি ইন দা মেকিং

ফটোগ্রাফস বাই অ্যান ডি হেনিং’ শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের ছবির প্রদর্শনী। অনেক বিদেশি সাংবাদিক পাকিস্তানীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তাদের অত্যাচার নির্যাতনের তথ্যচিত্র সংগ্রহ করেন। তা বিভিন্ন মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে বিশ্বে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন। অ্যান ডি হেনিং সহ আরও বেশ কিছু সাংবাদিক

যুদ্ধকালীন সময়ে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন ক্যামেরাকে অস্ত্র বানিয়ে। পুরুষ সাংবাদিকদের তুলনায় নারী সাংবাদিক কম হলেও একইরকম সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। অ্যন ডি হেনিং সেরকমই একজন সাহসী আলোকচিত্রী। তাঁর তোলা ছবিগুলো মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য

দলিল। ১৯৭১ সালে ফরাসির এই আলোকচিত্রী যখন জানতে পারেন নিরীহ বাঙালির উপর নারকীয় হত্যার উৎসব চালাচ্ছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী।তখন কিন্তু পাকিস্তান সরকার বিদেশি সাংবাদিকদের পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। তিনি তখন দ্রুত ভারতের কোলকাতা চলে আসেন এবং তার আলোকচিত্রী

সহকর্মী মিশেল লেন্ট, সংবাদদাতা ডেনিশ নিল্ড ও কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সিস্টেমের সংবাদদাতা প্যাটিক ফরেস্টের সঙ্গে দেখা করেন তারপর তারা সীমান্ত পেরিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করেন। অ্যানের স্মৃতিতে সেইদিনগুলো এখনো অনেক উজ্জ্বল। তিনি নতুন দেশের স্বপ্নে বিভোর মানুষের দুর্ভোগ ও সংগ্রাম নিজ চোখে

দেখেছেন। তিনি তা ক্যামেরাবন্দী করেছেন। খালি গায়ে রাইফেল হাতে মুক্তিযোদ্ধার ছবি, ট্রেনে উঠা শরণার্থী পরিবার, গরুর গাড়িতে চড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলা মানুষের ছবি। এছাড়াও যুদ্ধকালীন নানারকম ছবি যার মধ্যে একটা ছবিতে দেখা যায় একদল মানুষ মানচিত্র সংবলিত বাংলাদেশের পতাকা তুলে

ধরেছে। এসব ছবি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মানুষের আবেগ ও স্মৃতি বহন করে। ওরা আমাদের রণাঙ্গনের সহযোদ্ধা নিঃসন্দেহে। জাতি কৃতজ্ঞ দুঃসময়ের এই পরিক্ষীত বন্ধুদের কাছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় অ্যানের বয়স ছিল ২৫ বছর। ২০২২ শে পঞ্চাশ বছর পর এদেশে এসে তিনি খুবই আবেগআপ্লূত। লাল

সবুজ পতাকার এই দেশটির জন্ম যন্ত্রণার সাক্ষী তিনি। ১৯৭২ সালে তিনি এদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য ও একবার এসেছিলেন। অ্যান একজন দুঃসাহসী আলোকচিত্রী। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ছবি ও তুলেছিলেন তিনি। শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিভিন্ন সংঘাতময় অঞ্চলের ছবি তিনি তুলেছেন।

অনেক রাষ্ট্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের পাশে ছিলোনা। কিন্তু প্রতিটি রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের সমর্থন ও ভালোবাসা ছিল আমাদের সাথে। নিউইয়র্ক টাইমসের সিডনি এইচ শ্যামবার্গ আফসোস করে বলেন, ‘বাংলাদেশে আমার অভিজ্ঞতা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম একাত্তরের গণহত্যা

ভালোভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়নি।’ এসব পথ ধরে একদিন হয়তো বিশ্বের জঘন্যতম গণহত্যার স্বীকৃতিও আমরা পাব যেটা পাকিস্তানীরা এখানে ঘটিয়েছিলো। পাঁচ দশক পাড়ি দিয়ে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে আমরা পরিপূর্ণ একটা পরিণত জাতি হয়ে উঠার কথা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও তার

ব্যাপ্তি আমাদের অহংকারের বিষয়। কিন্তু এই অহংকারের জায়গাটা আমরা যতটা না আগলে রাখার চেষ্টা করেছি তারচেয়ে বেশী করেছি বিতর্কিত। মুক্তিযুদ্ধের অনেক প্রামাণ্য দলিল হারিয়ে গেছে এমনকি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রত্নসম্পদও সুরক্ষিত করা যায়নি। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন তাদের বেশিরভাগই এখন আর নেই। আগামী দশ থেকে বিশ বছরের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা তো বটেই যারা সাক্ষী ছিলেন তাঁরাও থাকবেননা।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এবং আবেগটা যেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বয়ে বেড়ায় সেই জায়গাটায় আমাদের কাজ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ যেন আমাদের প্রজন্মকে সবসময় স্বপ্ন দেখতে এবং দেশকে ভালোবাসতে অনুপ্রাণিত করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগণতন্ত্র-মানবাধিকার বিতর্কের অবসান জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধবেগম রোকেয়ার বিজ্ঞান চিন্তা