বেগম রোকেয়ার বিজ্ঞান চিন্তা

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ১ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৩১ পূর্বাহ্ণ

এক তারা ভরা রাত্রিতে আরাম কেদারায় আধশোয়া হয়ে বঙ্গ ললনাদের দুর্দশার কথা ভাবতে ভাবতে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয় সুলতানা। হঠাৎই দেখতে পায় এক মোহনীয় নারী দাঁড়িয়ে তার সম্মুখে। সুলতানাকে হাসিমুখে সম্ভাষণ জানায় ‘সুপ্রভাত’ বলে! তাকে বাগান পরিভ্রমণের আমন্ত্রণ জানায়।

 

 

রাতদুপুরে ঘরের বাইরে বেরোলে কোন পুরুষের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা নেই মনে করে সেই আগন্তুকের অনুগামী হয় অবরোধবাসিনী সুলতানা। আগন্তুককে বোনের আসনে বসিয়ে ‘সারা’ নাম দেয়। সারার হাত ধরে বাগানে প্রবেশ করেই অবাক বিস্ময়ে নিজেকে আবিষ্কার করে প্রকাশ্য দিবালোকে। এ যেন এক স্বর্গীয় নন্দনকানন! কিন্তু অস্বস্তিতে পা জড়িয়ে আসে তার। অবগুণ্ঠন ছাড়া দিনের আলোয় খোলা আকাশের নিচে হেঁটে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা তার হয়নি এযাবত কালে।

নন্দনকাননের ব্যস্তসমস্ত কর্মীরা সুলতানাকে ‘পুরুষের মতো ভিরু ও লজ্জানম্র’ বলে উপহাস করে। বিস্ময়াভিভুত সুলতানা তার সহচরের কাছে জানতে পারে, রাজ্যের নাম ‘লেডিল্যান্ড’ বা নারীস্থান। এ রাজ্যের প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, শিক্ষা ও গবেষণা, নগর পরিকল্পনা, কৃষি ব্যবস্থাপনাসহ যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ

পরিচালিত হয় নারী বিশেষজ্ঞদের পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধানে। এই নারীশক্তির উৎস কোথায় ? সম্পদ, সৌন্দর্য কিংবা মারণাস্ত্র? না কি আদিভৌতিক কোন জাদুমন্ত্র? না, এই শক্তির উৎস বিজ্ঞান।

১৯০৫ সালে রচিত (প্রথমে ইংরেজি ভাষায় রচিত, পরে বাংলায় অনুদিত) বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ‘সুলতানাস ড্রিম’ (‘সুলতানার স্বপ্ন’) সেই শ্বাসরুদ্ধকর বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী যেখানে নারীস্থানের প্রতিনিধি সারা’র হাত ধরে স্বপ্নযোগে দেশভ্রমণে বের হয় বঙ্গনারী সুলতানা। মাত্র দশ পাতার এই ছোট্ট

গল্পটি অনেকদিন আগে পড়া, একাধিক বার পড়া। এবছর জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য– ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন: জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন’জানার পর ২০২৩ সালের মার্চ মাসে আবারও খুলে বসি রোকেয়াসমগ্র।

পায়রাবন্দের রোকেয়ার বয়স তখন বড়জোর পঁচিশ। স্বামীর সঙ্গে বসবাস করছিলেন কলকাতার শহরতলিতে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন দু’দিনের সরকারি সফরে যান অন্য শহরে। সেই দু’রাতের কোন এক রাত্রিতেই বোধ করি রোকেয়াতে ভর করে সুলতানা ও সারা। তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন; তবে

ঘুমিয়ে নয়, জেগে জেগে। কল্পনায় ভেসে বেড়ান তাঁর স্বপ্নের নারীস্থানের অলিতে গলিতে, যে রাজ্যের মূল দর্শন প্রেম ও সত্য। এপ্রেম প্রকৃতির প্রতি, দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি। সত্য ছেড়ে কেউ মিথ্যার আশ্রয় নিলে তার জন্য একটা শাস্তিই বরাদ্দচিরতরে দেশান্তরে যাওয়া। মৃত্যুদণ্ড বা রক্তপাতের মতো কোন

ঘটনা সে রাজ্যে ঘটেনা। সাধারণ মানুষ নিয়ম মেনে চলে। যে যার কাজে নিমগ্ন; কেউ কারও পথে কাঁটা দেয় না, বাড়া ভাতে ছাই দেয় না। ফলে কোন অপরাধ সংঘটিত হয় না, আর তাই অপরাধ দমন বিভাগ বা আইন আদালতেরও প্রয়োজন পড়ে না। রাজ্যের রানী সন্তানের মতো আগলে রাখেন নাগরিকদের। এ যেন এক স্বর্গরাজ্য! কেমন করে পথ চলা শুরু এই স্বর্গরাজ্যের ?

তের বছরের কিশোরী রানী যখন রাজ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তাঁর পক্ষ থেকে সরকার পরিচালনা করছিলেন প্রধানমন্ত্রী। নারীরা তখনও অন্তঃপুরের বাসিন্দা। দিন বদলের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন বিদুষী রানী। শহরে গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন শত শত বালিকা বিদ্যালয়। মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায়

শিক্ষিত করার বাসনায় স্থাপন করেন একের পর মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়। বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার জন্য বরাদ্দ করা হয় ব্যাপক সরকারী অনুদান। গবেষণাগারে দিবারাত্রি গবেষণায় নিমগ্ন সহস্র নারী। সৌরশক্তি ব্যবহার করে তারা ফসল ফলায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, প্রকৃতির সঙ্গে বোঝাপড়া করে। স্বয়ংক্রিয় বায়ুযানে

চড়ে মেঘের কোল থেকে বৃষ্টি ধরে নিয়ে আসে মেপে মেপে, সংরক্ষণ করে বছর জুড়ে। এ রাজ্যে তাই মেঘ জমে না, ঝড় বব্জ্রপাতে প্রাণহানি বা সম্পদ নষ্ট হয় না, পথঘাট জল কাদায় ভরে গিয়ে জলাবদ্ধতা বা দুর্গন্ধও ছড়ায় না। মশা মাছি বা প্লেগের উপদ্রবও নেই এই রাজ্যে। গ্রীষ্মে অবিরাম কাজ করে যায় ফোয়ারা,

আর শীতে আগে থেকে জমিয়ে রাখা সৌরশক্তি উত্তাপ বিলিয়ে যায় ঘরে ঘরে। রান্নায় ব্যবহৃত হয় সৌরশক্তি। ফলে আগুন, ধোঁয়া, ঝুল কালিতে রাঁধুনির নাভিশ্বাস ওঠে না। স্নানঘরে রয়েছে প্রাকৃতিক ঝর্না। বোতাম টিপতেই ছাদ সরে যায়; ঝুলন্ত জলাধার থেকে নেমে আসা ঝর্নাধারায় ধুয়ে মুছে যায় সকল ক্লান্তি।

এতো অবিশ্বাস্য কর্মযজ্ঞ রাজ্য জুড়ে! পুরুষরা তখন কি করছিল? পুরুষরা নিয়োজিত রাজকার্য সমাধায়; প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে অস্ত্রসংরক্ষণ ও সামরিক প্রশিক্ষণে।

একদিন ভিনদেশি এক নাগরিক এসে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে রাণীর কাছে। ভিনদেশি রাজা তাকে ফেরত চাইলে মানবিক ঔদার্যশালী রাণী তা প্রত্যাখ্যান করেন। যুদ্ধ ঘোষণা করা হয় রাণীর বিরুদ্ধে। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত হতে থাকে রাণীর বাহিনী। ষোল বছরের বালক থেকে ষাট বছরের বৃদ্ধও নাম

লেখায় যুদ্ধে। মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। শত্রুপক্ষ চলে আসে রাজধানীর সন্নিকটে। রাণী তখন বিশেষ সভা ডাকেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সঙ্গে নিয়ে। শারীরিক শক্তিপ্রয়োগ ও অস্ত্র চালনা করে দেশ রক্ষায় ব্যর্থ সামরিক বাহিনী। মস্তিস্ক খাটিয়ে একটা উপায় বের করার জন্য নারীবাহিনীকে আহবান জানান বিচক্ষণ রাণী। রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হয় গবেষকের দল। একটাই শর্ত তাদেরনারীদের তাদের নিজেদের মতো করে কাজ করতে দেওয়া চাই। অতএব,

পুরুষদের গৃহে থাকার প্রজ্ঞাপন জারি হোক। কারণ পুরুষেরা অবাধে চলাফেরা করলে নারীদের অবাধ বিচরণ বাধাগ্রস্ত হয়। রাণীর নির্দেশে ঘরে ফিরে যায় রণক্লান্ত সৈন্য ও বাদবাকি পুরুষেরা। তবে নারী করবে দেশরক্ষা! ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতে ছাড়ে না তারা।

অচিরেই দু’হাজার নারী গবেষক গমন করে যুদ্ধক্ষেত্রে। অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নয়, সরাসরি সূর্যলোকের তুলনায় সহস্র গুণ শক্তিসম্পন্ন জমানো সৌরশক্তি নিয়ে। কাচের ওপর প্রতিফলিত সেই উত্তাপে ঝলসে যায় শত্রুপক্ষ, পুড়ে যায় তাদের মারণাস্ত্র, প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায় তারা পরাজিত সৈনিকের মতো।

দেশের সার্বভৌমত্ব ও সম্মান রক্ষায় ব্যর্থ পুরুষরা সেই থেকে সন্তান লালন পালনসহ অন্তঃপুর দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত হয়। দক্ষ শ্রমিকরা অবশ্য ফিরে যায় কলকারখানায়, নারী গবেষকদের বাতলে দেওয়া সূত্র অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করে। নারী বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করে, আর পুরুষ করে কায়িক

পরিশ্রম। এ রাজ্যে গাড়ি ঘোড়া নেই। ফলে যানজট আর সড়ক দুর্ঘটনা বলে কোন কিছুর অস্তিত্বও নেই। মানুষ পায়ে হেঁটেই চলাচল করে, দূরপথের জন্য ব্যবহৃত হয় দ্রুত গতি সম্পন্ন বায়ুযান। শুধু তাই নয়, প্রাকৃতিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের কোন অপচয় হয় না এই দেশে। যে নারীর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায় প্রকৃতি ও

বিজ্ঞানের আশীর্বাদে দেশরক্ষাসহ সুশৃঙ্খলভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালিত হয়, সেই রাণীর বাসভবনে জনতার আছে অবাধ প্রবেশাধিকার। ফটকে অস্ত্র ও উর্দিধারী দ্বাররক্ষী দণ্ডায়মান থাকে না দিবারাত্রি। কারণ, রাণীর বাড়িটা কোনো প্রাসাদ নয়। এখানে নেই হীরে জহরত, নেই কোন ময়ুর সিংহাসন।

সুলতানাস ড্রিম’ শেষ হয়। সাখাওয়াত হোসেনও বাড়ি ফেরেন। স্ত্রীর হাতের কাল্পনিক বা অতিপ্রাকৃতিক রচনা পাঠ করে বিব্রত বা ক্ষুব্ধ নন, বরং অভিভূত হন তিনি। স্ত্রীর রাষ্ট্রচিন্তা, বিজ্ঞানমনস্কতা, মানবিক ঐশ্বর্য, সর্বোপরি ইংরেজি ভাষার ওপর দক্ষতা দেখে মুগ্ধ স্বামী ‘স্ত্রীর স্বপ্ন’ ছাপার আকারে প্রকাশের উদ্যোগ

গ্রহণ করেন, আর সেই স্বপ্ন পূরনের জন্যই গচ্ছিত অর্থের বড় একটা অংশ মৃত্যুর আগে তুলে দেন স্ত্রীর হাতে। বলে রাখা ভাল, এই স্ত্রী কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ গ্রহণতো করেননিই, বিদ্যালয়েরও চৌকাঠ মাড়াননি। কল্পনায় সৌরবিদ্যুৎ, স্নানঘরের ঝর্না, উড়োজাহাজসহ অত্যাধুনিক যত যন্ত্রপাতির ছবি তিনি এঁকেছেন,

তার বেশীরভাগের সঙ্গেই প্রত্যক্ষ পরিচয় লাভের সুযোগ তাঁর ঘটেনি। তবু তিনি স্বপ্ন দেখেছেন। ঊনিশ শতকের পরাধীন ভারতবর্ষের এক অনগ্রসর জনপদে জন্ম নেওয়া এই নারী কি প্রাণের টানে অবিরাম জ্ঞান সাধনা করেছেন আর সমাজের ঘুম ভাঙাতে পথে নেমেছেন, তার খবর সেকালে যেমন কেউ রাখেনি, একালেও রাখে না।

সুলতানাস ড্রিম’ প্রকাশিত হয়েছিল শতাধিক বছর আগে। পৃথিবী এগিয়ে গিয়েছে অনেক দূর। এগিয়েছে বাংলাদেশও। সরকার প্রধানসহ শতসহস্র নারী নিয়োজিত আছে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে। কিন্তু আজও বিজ্ঞানের সঙ্গে মিতালি স্থাপিত হয়নি আমাদের নারীদের। ঘর গেরস্থালি আর সূচিকর্ম ছাড়াও যে জ্ঞান

বিজ্ঞানে অসামান্য অবদান রাখা যায়, সে ভাবনা নেই সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীর মাঝে। সমাজের নির্যাতিত আর পিছিয়ে পড়া নারীদের দিন বদলের কথা উচ্চারিত হয়না সফল ও আলোকিত নারীদের মুখে। এখনও আমাদের মেয়েরা জ্ঞানচর্চার চেয়ে সৌন্দর্যচর্চায় অধিক সময়, শ্রম আর অর্থ নিবেদন করে এবং সভা

সমিতির শোভা বাড়িয়ে নারী জনমের সার্থকতা আর নারীর ক্ষমতায়নের আস্বাদ লাভ করে। এমন প্রহসনের অবসান না হওয়া পর্যন্ত নারীমুক্তি বা নারীদিবস অন্তঃসারশূন্য বলেই প্রতীয়মান হবে।

. সালমা বিনতে শফিক, অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধরণাঙ্গনের ফরাসী বন্ধু অ্যান ডি হেনিং
পরবর্তী নিবন্ধবোয়ালখালী উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক হলেন জহুরুল ইসলাম