যা জানি, অনুভব করি তা অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করি

স্মৃতি বিষাদ আনন্দের কথা আজাদীকে বললেন পবিত্র সরকার

| রবিবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২২ at ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ

উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও গবেষক ড. পবিত্র সরকার জন্মেছিলেন এদেশে, সাভারের অদূরে বলিয়ারপুরের ঠাকুরবাড়ি পঞ্চাশে। নগরায়ণের থাবায় তাঁর জন্মস্থান গিলে খেয়েছে ধামরাই। ১৯৩৭ সালের ২৮ মার্চ জন্ম। ১১ বছর বয়সে উদ্বাস্তু হয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। লেখাপড়া করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। এরপর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য উচ্চশিক্ষা পর্ষদে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ছয় বছর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন টানা ২৭ বছর। এ পর্যন্ত তাঁর মৌলিক বই প্রকাশিত হয়েছে ৯২টি। এর বাইরে সম্পাদনা করেছেন ৬৪টি গ্রন্থ। শিশুসাহিত্যেও রেখেছেন অবদান। পাশাপাশি লিখেছেন গল্প, কবিতা, নাটক। করেছেন অভিনয়ও। মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করেছেন শিকাগোতে, ফান্ড সংগ্রহ করে পাঠিয়েছেন যুদ্ধের ময়দানে। অস্ত্র কিনেও পাঠিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু হিসেবে তাঁকে সম্মানিত করেছে বাংলাদেশ সরকার। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামে। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকের সমাবর্তনে সমাবর্তন বক্তা তিনি। গতকাল সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দৈনিক আজাদীর চিফ রিপোর্টার হাসান আকবর।

পবিত্র সরকার বললেন, একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিতে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগই যথেষ্ট। শিক্ষক যদি যোগ্য না হন তাহলে তুমি যা কিছুই করো না কেন সবই রসাতলে যাবে।

প্রশ্ন করেছিলাম, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে কি কি পদক্ষেপ নেয়া দরকার বলে মনে করেন? হাসতে হাসতে বললেন, শিক্ষার উন্নয়ন কঠিন কিছু নয়। অনেক টাকা ঢালতে হবে, বিশাল বিশাল বাড়ি করতে হবে, নানারকম এয়ারকন্ডিশনের ব্যবস্থা করতে হবে, তা নয়। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। শিক্ষকেরা মন দিয়ে পড়াবেন, ছাত্ররা মনোযোগ দিয়ে পড়বে। তারা অন্যান্য কিছুও করবে। খেলাধুলাও করবে, আনন্দ বিনোদন উপভোগ করবে। আর দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক ভালো রাখা কিংবা সমন্বয় করার জন্য প্রতিষ্ঠান এবং সমাজ চেষ্টা করবে। তবে সবকিছুর আগে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, ঘুষ নিয়ে শিক্ষক নিয়োগ, অযোগ্য লোককে চাকরি দেয়া, ক্লাসে অংক করাতে পারে না, দুই লাইন ইংরেজি লিখতে পারে না-এমন সব কেলেংকারির ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে ঘটেছে। আমার মনে হয়, শিক্ষা ব্যবস্থাকে নষ্ট করার জন্য এর বেশি কিছু আর করতে হয় না। বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ছোটখাটো দুয়েকটি ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মন্ত্রী এবং সাঙ্গপাঙ্গদের যে ঘটনা উন্মোচিত হয়েছে তা যেকোনো দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে নষ্ট করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে ভালো লাগে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি শিক্ষক হিসেবেই দীর্ঘজীবন কাটিয়েছি। শিক্ষক হিসেবে ছাত্রছাত্রী এবং অন্যান্য মানুষের প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছি। সেই ভালোবাসার যোগ্য কিনা জানি না, তবে সেই পরিচয়টাই আমি মনে করি আমার প্রধান পরিচয়।

পবিত্র সরকারের বয়স ৮৬ ছুঁই ছুঁই; জীবনকে দারুণভাবে উপভোগ করেন। এই জীবনীশক্তির রহস্য কী? তরুণ প্রজন্মের জন্য কোনো পরামর্শ আছে কিনা জানতে চাইলে হাসতে হাসতে বলেন, আমি প্রচুর গান শুনি। গান শুনতে ভালোবাসি। রবি ঠাকুরের গীতবিতান নিয়মিত পড়ি। সকালে ঘুম ভাঙলে নিজেও গুনগুনিয়ে কিংবা চেঁচিয়ে রবি ঠাকুরের গান গাই। রবি ঠাকুরের পূজোর গান, প্রেমের গানের পাশাপাশি লোকসংগীত, পশ্চিমা সংগীত, আরবি সংগীত, গজল সবই শুনি। সবগুলো থেকে আমি জীবনসুধা সংগ্রহ করি।

তিনি বলেন, একটাই জীবন। জীবন একটা এটা ধরে নিয়ে এই জীবনের জন্য সবটুকু উজাড় করে দিতে হবে। না হলে তুমি কিছু পাবে না। এই জীবনটা শুধু তোমার একার জীবন নয়। অন্য মানুষের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে, অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে জড়িয়ে জীবন। সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে জড়িয়ে তোমার জীবন। এই জীবনটা যাতে মূল্যবান হয়ে ওঠে সেই চেষ্টাটাই আন্তরিকভাবে করতে হবে। তাহলে জীবন তোমাকে ভরিয়ে দেবে।

নিজের জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, সাভারের কাছে বলিয়ারপুর গ্রামে আমার জন্ম। বেড়ে ওঠা ধামরাইয়ের কাছে ঠাকুরবাড়ি পঞ্চাশে। কিন্তু মাত্র ১১ বছর বয়সে ক্লাস ফোরে পড়ার সময় দেশভাগ হয়ে গেল। উদ্বাস্তুর মতো ওপারে চলে গেলাম। দেশভাগ দুই দেশের, দুই ধর্মের হাজার হাজার পরিবারের সর্বনাশ করেছে। হাসান আজিজুল হক সাহেবও এমন সর্বনাশা ঢেউয়ের কবলে পড়া একজন।

তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে পশ্চিমবঙ্গ চলে যাই। ওখানে গিয়ে অবর্ণনীয় এক দুর্ভোগ শুরু হয় আমাদের। আমি মানুষ হয়েছিলাম পিসির সংসারে। আমাকে দত্তক নিয়েছিলেন আমার পিসি। পিসেমশাই অর্থাৎ আমার পালক পিতা ছিলেন মানিকগঞ্জের কাছে বালিহাটির জমিদারের নায়েব। মোটামুটি অবস্থাপন্ন। সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে আমাদের শৈশব কাটছিল। কিন্তু দেশভাগের ধাক্কা সামলানো কঠিন হয়ে উঠল। সব ছেড়ে ওপারে যাওয়ার পর আমাদের সংসার চলছিল না। আমি অনেক কষ্ট করতাম। আমার ছোট পিসি, যাঁর কাছে আমি মানুষ, তিনি না হলে আমার পক্ষে আজকের অবস্থানে আসা কোনোদিনই সম্ভব ছিল না। আমার পিসি মুড়ি ভেজে বিক্রি করতেন, গরুর দুধ বিক্রি করতেন। আর তা দিয়ে আমার লেখাপড়ার খরচ যোগাতেন। আমার ছোট পিসি আমার জন্য শরীর এবং জীবনপাত করেছিলেন। তাঁর কাছে আমার ঋণ এক জীবনে শোধ হবে না।

পবিত্র সরকার বলেন, দেশভাগের পর নিজের সত্যিকারের মা-বাবা বড় দুর্ভোগে পড়েছিলেন। এক বছরের মাথায় বাবা মারা যান। তাঁর অপর দুই ভাইসহ পরিবারের অন্যরা চরম দুর্বিপাকে পড়ে যান। সেই দুর্যোগে টিকে থাকা কঠিন হয়ে উঠেছিল। বড় দাদার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল। এক পর্যায়ে তিনি পুলিশের কনস্টেবলের চাকরি নিলেন। ওই পুলিশ কনস্টেবল থেকে তিনি আর এগোতে পারেননি। আমার চাকরি হওয়ার পর ছোট ভাইয়ের লেখাপড়ার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলাম। ছোট ভাই অবশ্য একটি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল পর্যন্ত হতে পেরেছিল। তবে নিজের জীবনে কোনো অতৃপ্তি নেই। নিজেকে সফল বলে মনে করি। যেখানে জন্মেছিলাম সেখান থেকে এতদূর আসা অকল্পনীয় ছিল।

নতুন করে আর কিছুই প্রত্যাশা নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, যা পেয়েছি ওইটুকুই আমার প্রাপ্য ছিল। জগতে কোটি কোটি মানুষ আমার চেয়ে বেশি সফল। আবার কোটি কোটি মানুষের চেয়ে আমি বেশি সফল। যতখানি হতে পেরেছি তাতেই আমি সুখী। লেখালেখি করি। নিজের ভিতর থেকে একটি তাগিদ অনুভব করি। আমি যা জানি, যা অনুভব করি তা অন্য লোকের কাছে পৌঁছে দেয়ার তাড়না থেকেই লেখালেখি। কারণ আমি এটা ভাবি যে, আমার দেশের মানুষ জ্ঞানের জন্য প্রাচীন ঐতিহ্যের কাছে হাত পাতে, বাঙালি মুসলমানেরা মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্য এবং হিন্দুরা প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যের কাছে হাত পাতে। তাছাড়া পাশ্চাত্যের একটা বিশাল জ্ঞানভান্ডার গত দুইশ-আড়াইশ বছর হলো উন্মোচিত হয়েছে। এখন আমরা হাত পেতে আছি মূলত পাশ্চাত্যের কাছে। আমি তো অন্যদের চেয়ে একটু বেশি সুযোগ পেয়েছি, পাশ্চাত্যেও গেছি। আর লেখাপড়ার মধ্য দিয়ে প্রাচীন ভারতের কথাও কিছু জানি। সে সুযোগ কম পেয়েছে তেমন ছেলেমেয়েদের জন্য আমি নিজের ভাষায় কিছু জানাতে পারি, সেই চেষ্টা থেকেই মূলত আমার লেখালেখি। আমি বাংলাতেই লিখি। ছোটদের জন্য গল্পও লিখি, ছোটদের জন্য ছড়া-কবিতা লিখি। মোটের উপর আমি যা জানি, অনুভব করি তা অন্যদের কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করি।

পবিত্র সরকার বলেন, দীর্ঘ জীবনে সুখের স্মৃতি অনেক। তবে সবচেয়ে বেশি যে স্মৃতি এখনো আমার চোখে ভাসে তা হচ্ছে আমার প্রথম সন্তানের মুখ দেখা। শিকাগো শহরে জন্ম নিয়েছিল আমার প্রথম সন্তান বসুধিতি সরকার। হাসপাতালের ইনকিউবিটরে ছোট্ট একটি শিশু, ফর্সা মতোন। শিশুটির মুখ দেখার সাথে সাথে আমার ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল। অসাধারণ একটি অনুভূতি খেলা করে গেল শরীর-মনে। আমাকে দেখে বাচ্চাটি কেঁদে উঠল। আমার মনে হয়েছিল আমি স্বর্গীয় কোনো সংগীত শুনছি।

নিজের জীবনের কষ্টের বহু স্মৃতি আছে। তবে সবচেয়ে বেশি কষ্টদায়ক ছিল নাকের অপারেশনের একটি স্মৃতি। নিজের নাকে ছোটবেলায় আটবার অপারেশন করতে হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, একবার অপারেশনের সময় এনেসথেসিয়া ঠিকভাবে নাকের ভিতরে যায়নি। অপারেশনের সময় ছুরি, কাঁচি দিয়ে যখন আমার নাকের ভিতর থেকে টেনে টেনে মাংস ছেড়া হচ্ছিল তখন আমার পুরো শরীরের উপর যে ঝড় গিয়েছিল সেটা কোনোদিনই ভুলব না। তবে মানসিক কষ্ট টুকটাক থাকলেও এত বেশি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি যে তার ক্ষতিপূরণ হয়ে গেছে।

দুই কন্যা সন্তানের জনক পবিত্র সরকারের বড় মেয়ে বসুধিতি তাঁর সঙ্গেই চট্টগ্রামে এসেছেন। ছোট মেয়ে বসুধারা কলকাতায়। স্ত্রী মৈত্রেয়ী সরকার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াতেন। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের এই নারীর কাছেও নিজের অসীম ঋণের কথা জানালেন পবিত্র সরকার। ২০১৯ সালে স্ত্রী বিয়োগের পর তিনি একা আছেন। বড় মেয়ের শ্বশুরবাড়ি কাছে হওয়ায় প্রায় সারাক্ষণ মেয়ের তত্ত্বাবধানে থাকেন। দুই মেয়েই উচ্চ শিক্ষিত এবং স্বামী-সংসার রয়েছে।

যে দেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ঘরছাড়া হলেন সেদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করলেন কেন? জবাবে তিনি বললেন, স্বাধীনতা আসলে অনেক বড় ব্যাপার। সত্যিকারের স্বাধীনতাকামী মানুষ, যারা ছোট্ট গোষ্ঠীস্বার্থ চিন্তা করে না, তাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা সবসময় বৈধ। তাদের সহায়তা করা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমরা দেখছিলাম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, আকাঙ্ক্ষা করছে। বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ করছিলাম। আমাদের ভাষা নিয়ে একটি রাষ্ট্র স্বাধীন হবে-এটা আমাদের রোমাঞ্চিত করছিল। তাই নিজেদের সবটুকু দিয়ে ওই যুদ্ধকে সমর্থন করা নৈতিকতার অংশ মনে করেছিলাম।
কিছুটা উদাস হয়ে তিনি বলেন, ওই সময় আমি আমেরিকার শিকাগোতে ছিলাম। সেখানে পিএইচডি করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে প্রথমে ভাষাবিজ্ঞানে এমএ করি। পরে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি। ওই সময় শিকাগোতে বিখ্যাত স্থপতি এফ আর রহমান, যিনি ওই সময়কার আমেরিকার সর্বোচ্চ ভবন সিয়ার্স টাওয়ার বানিয়ে ম্যান অব দ্য ইয়ার হয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সহায়তার জন্য ছোট্ট একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলাম। আমাদের ওই দলে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শামসুল বারী, যিনি পরবর্তীতে ব্যারিস্টার হয়েছিলেন, চট্টগ্রামের সন্তান নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুচ ছিলেন। আমরা মিশিগান এবং শিকাগোতে কয়েকটি ডিনার পার্টির আয়োজন করেছিলাম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। অর্থ সহায়তা নিয়েছিলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য। পরবর্তীতে তা দিয়ে ডুবুরির পোষাক, অস্ত্র এবং নগদ অর্থ প্রভৃতি মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট পাঠিয়েছিলাম। বাংলাদেশ ঠিক পথে এগোচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু হিসেবে আমাকে সম্মানিত করেছে। এজন্য সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

বংশাই নদীকে মিস করেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে প্রচুর মিস করি। আত্মীয়-স্বজন আছেন। আমার নিজের যমজ বোন ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন, মানিকগঞ্জের কাছে। জন্মভূমি তো পাল্টানো যায় না। মৃত্যু কোথায় হবে জানি না। জন্মস্থানের জন্য একটি আবেগ সবসময় থেকে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালেও ওই আবেগ টের পেয়েছিলাম।

বাংলাদেশের পাহাড় এবং সমুদ্র খুবই ভালো লাগে জানিয়ে পবিত্র সরকার বলেন, পাহাড় এবং সমুদ্র পাশাপাশি থাকলে আমার বেশি ভালো লাগে। কঙবাজার আমার পছন্দের ও ভালো লাগার একটি জায়গা। তবে বাংলাদেশ কিংবা পশ্চিমবঙ্গ, দুই দেশের বর্ষার বৃষ্টি খুবই টানে। স্বাস্থ্যকর না হলেও ভাজাভুজি খেতে প্রচুর পছন্দ করতেন একসময়। তবে এখন খুবই অল্প খান। বলেন, সারা দিন খুবই অল্প খাই। রাতের বেলা ভাত-রুটি কিছুই খাই না। একটুখানি সবজি বা এক টুকরো মাছ বা মাংস, আর কিছু না।

১৯৮৮ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ৭০/৭৫ বার বাংলাদেশে আসা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এদেশের মানুষ অনেক বেশি আন্তরিক। তাদের আপ্যায়ন, অতিথিসেবা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ থেকে অনেক বেশি। বাংলাদেশের মানুষেরা যেমন করে আতিথেয়তা দেখান পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরা তেমন করে দেখাতে পারেন না। না হয় সব একইরকম। বিশাল বিশাল শহর গড়ে উঠছে, বাইরে যে উন্নয়ন তার সবই একই। কিন্তু মানুষের সামাজিকতা, আন্তরিকতা এবং বন্ধন আমি একটু বেশি উপভোগ করি, অনুভব করি। এই আন্তরিকতা বহু যুগ ধরে চলছে এবং এখনো টিকে আছে।

ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় স্কুলের মৌলভী শিক্ষক, যিনি বাংলা পড়াতেন, তাঁর সাথে একটি স্মৃতি এখনো জীবন্ত। পবিত্র সরকার বলেন, ছাত্র হিসেবে কিছুটা সামনের দিকে ছিলাম। শিক্ষকেরা আদর করতেন, ভালোবাসতেন। মৌলভী শিক্ষকও আমাকে খুব ভালোবাসতেন। ওই সময় একবার স্কুল বেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। মৌলভী স্যার আমাকে ডেকে বললেন, খুলনায় আমার বাড়ি। সেখানে খুব মাছ পাওয়া যায়, খেঁজুর গুড় পাওয়া যায়। সরকার মশাই, যাইবা নাকি আমার লগে? তোমাকে খাওয়াইয়া দাওয়াইয়া মোটা কইরা ফেরত আনমু। আমি মৌলভী শিক্ষকের মুখের উপর বললাম, না স্যার। আমি আপনার লগে যামু না। আপনার লগে গেলে মুসলমানেরা আমাকে কাইটা ফেলাইব। তখন দেশভাগের দামামা শুরু হয়েছে। চারদিকে কেমন ফিসফাস। ক্লাস থ্রির একটি ছেলের কাছে ওসব ভালো করে বুঝে আসার কথা নয়। মৌলভী সাহেবকে ওভাবে বলা যে উচিত হয়নি; তা-ও মাথায় ছিল না। কিন্তু আমার মুখ থেকে কথাটি শোনার সাথে সাথে মৌলভী সাহেবের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। কী বললি তুই! আমার লগে গেলে তোরে মুসলমানেরা কাইটা ফেলাইব? আমি মৌলভী সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। ‘সরি’ বলব বা ক্ষমা চাইব সেই বোধ বা বুদ্ধিও আমার ছিল না। মৌলভী সাহেব কাঁদলেন, অন্যদিকে চলে গেলেন। আমিও বাড়ি চলে গেলাম। এর কিছুদিন পরই তো দেশভাগের সর্বনাশ ঘটে গেল। আমি উদ্বাস্তুর মতো চলে এলাম। মৌলভী সাহেবের সাথে আমার আর কোনোদিন দেখা হয়নি, ক্ষমা চাওয়াও হয়নি। মৌলভী সাহেবের সেই স্মৃতি আমি ভুলতে পারিনি। হয়তো বাকি জীবনে পারবও না।

বাংলাদেশ ও ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে পবিত্র সরকার বলেন, ভারতের হিন্দু আধিপত্যবাদ নিয়ে আমার উদ্বেগ আছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী যারা ছিল তাদের কেউ কেউ এখনো আছে। তবে আমার মনে হয় শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশে এখনো অসাম্প্রদায়িক একটি আবহ আছে। টুকটাক ব্যতিক্রম সব দেশেই থাকবে। ভারতে তো আমরা প্রায় সময়ই দেখি। তবে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতাই আমার ভালো লাগে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধউচ্চশিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে দেশ ও মানবতার সেবায় কাজ করতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির তৃতীয় সমাবর্তন আজ