ময়ুখকাব্যের অন্তর্গত নিনাদ

মুহাম্মদ রেজাউল করিম | শুক্রবার , ২৩ অক্টোবর, ২০২০ at ৯:২৫ পূর্বাহ্ণ

আগেই বলে রাখি, কবিতার সাথে ময়ুখ চৌধুরীর গেরস্থালি ইতিমধ্যে অর্ধশত বছর পার হয়ে গিয়েছে। ফলে কোনো কবির অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে আসা সৃজনকর্মের অন্তর্গত নিনাদে কান পেতে দেখার এখনই উপযুক্ত সময়। গঠন আঙ্গিক এবং অর্থবাচকতার নিক্তিতে ময়ুখ চৌধুরীর কয়েকটি কবিতা আজকের আলোচনায় বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব। এর বাইরে কবিতা বিচারের আরো অনেক করণকৌশল রয়েছে। ইদানীং একটি অভিযোগ খুব চর্চিত হচ্ছে যে, অত্যাধুনিক কবিগণ কবিতা থেকে ভালোলাগাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে এনে ভাগাড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। কবিতাকে তারা মুক্তি দিয়েছেন ভালোলাগার বন্ধন থেকে। এমন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে আমি ময়ুখ চৌধুরীর কাব্যগ্রন্থগুলো থেকে মাত্র ৩টি কবিতা নির্বাচন করেছি কবিতার সাথে ভালোলাগার বন্ধন বিশ্লেষণ করার জন্য। কবিতাগুলো হলো ‘ঝাউতলার চাঁদ/কালো বরফের প্রতিবেশী’, ‘এ শহর আমার শহর/অর্ধেক রয়েছি জলে, অর্ধেক জালে’ এবং ‘ঘুমের ভেতরে/আমার আসতে একটু দেরি হতে পারে’।
‘ঝাউতলার চাঁদ’ কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা। সম্পূর্ণ কবিতাটি প্রায় একই আঙ্গিকে নির্মিত। ৬+৬+৩ এবং ৬+৬+২, এভাবে পর্ব বিভাজন করে পঙক্তিগুলো বিন্যস্ত। মধ্যম লয়ের এই কবিতাটি যেমন পাঠসুখকর তেমনি এর ভাবগত ব্যঞ্জনাও পাঠকচিত্তকে মোহিত করে রাখে। ভালোলাগার আরেক উপাদান হলো কবিতাটির সুরেলা অন্ত্যানুপ্রাস। যে চাঁদের বয়স পনেরো বছর, তার মানসচিত্তের আন্দোলন মাত্রাবৃত্তের লয়ে আন্দোলিত হয়েছে এই কবিতায়। বিদ্যাপতির উপস্থিতিই তা প্রমাণ করে। আমরা এই কবিতার শুরুতেই দেখি শ্রাবণ জোছনায় বৈষ্ণবকবি বিদ্যাপতির আছর ভর করে ঝাউতলার এক কিশোরী চাঁদকে। স্মরণ করিয়ে দেই, ‘দেহবাদী’ বিশেষণটিও কবি বিদ্যাপতির বিশেষ্যলগ্ন একটি ভূষণ। কবি ময়ুখ চৌধুরী ‘ঝাউতলার চাঁদ’ কবিতায় দেখিয়েছেন :
চাঁদের বয়স পনেরো বছর মাত্র/তবুও নয়নে মেঘের কাজল মাখে,
বিদ্যাপতির কাব্যে সে অহোরাত্র/জ্যেৎস্না ঝরায় শাওন দুর্বিপাকে।
পনেরো বছর বয়সী কিশোরীকে এই কবিতায় কবি তিনটি জ্যামিতিক কোণ থেকে দেখেছেন। শ্রাবণ পূর্ণিমার উত্তাল জোয়ারের পাশাপাশি উদাসীনতার ঢেউও আসে এই বয়সে। একরোখা সেই উদাসীনতাকে ঋতুবৈচিত্র্যের বর্ণও কাঁপাতে পারে না। তখন পাঠকের তীব্র কৌতূহল জাগে, এই পনেরো বছর বয়সের চাঁদটি কে? জ্যামিতির তৃতীয় রেখায় আছে নিষ্প্রেম নিরপেক্ষ চাঁদ। ঝাউতলার এই চাঁদটি শ্রাবণ আকাশে আন্দোলিত না হলেও তার ধমনীতে জোনাক পোকার আলোর বন্যা ঠিকই প্লাবন তুলে। পাথরের চাঁদে যেমন পিপাসার আলো সবচেয়ে বেশি বিম্বিত হয় তেমনি এই চাঁদেও তৃষ্ণার জল উপছে পড়ে অবিরত। কবি এমন একটি চাঁদকে জাগিয়ে তুলতে চাইছেন তাঁর কবিতায়:
পনেরো বছর নিষ্প্রেম নিরপেক্ষ-
এ রকম এক চাঁদ আছে ঝাউতলে,/শ্রাবণ-আকাশে আঁকে না কোনো আলেখ্য
তবু ধমনীতে জোনাকীর মতো জ্বলে।
অর্ধেক রয়েছি জলে, আর্ধেক জালে কাব্যের ‘এ শহর আমার শহর’ কবিতাটি ছন্দবৈচিত্র্যের কারণে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। পাঠসুখকরতো বটেই। কবিতাটিতে অন্ত্যানুপ্রাস এবং অন্ত্যানুপ্রাসের ধারাবাহিক বিরতি লক্ষ্যণীয়। তাল লয়ের দিক থেকে কবিতাটি কিছুটা দ্রুত আবৃত্তি করলে সাত মাত্রার স্বরবৃত্ত হিসেবে ঠিকঠিক মিলে যায়। ৩+৪/৩+৪ এভাবে প্রতি পর্বে সাতমাত্রা এবং পঙক্তিতে ১৪ মাত্রা। যদিও আমরা স্বরবৃত্ত ছন্দের পর্বে চার মাত্রা দেখে অভ্যস্ত। এদিক থেকে পর্যালোচনা করলে স্বরবৃত্ত হিসেবে কবিতাটি অবশ্যই একটি অনন্য উদাহরণ। আবার তাল লয় কিছুটা ধীর করে আবৃত্তি করলে মাত্রাবৃত্ত হিসেবেও কবিতাটি সুন্দর আবৃত্তি করা যায়। ময়ুখ চৌধুরী চট্টগ্রাম শহরকে মিথ, ইতিহাস এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মিথষ্ক্রিয়ায় এই কবিতায় পাঠকের সামনে উন্মোচন করেছেন:
বনানীর সবুজ রোমে ঢেকেছে মাটির কবর/ভেসেছে অন্ধকারে সাগরের নোনতা প্রহর
পরীর ঐ পাহাড় যেন মায়াবী রঙিন থামী/মেঘেদের নীল ইশারায় খুলেছে-সাক্ষী আমি;
চট্টগ্রাম শহরে পর্তুগিজ জলদস্যুরা যেমন এসেছিল তেমনি এই শহর পার হয়ে গিয়েছেন যুবক কবি আলাওল। নদীর দুই কূলকে জলের প্রেমিক হিসেবে দেখিয়েছেন এখানে কবি। নদীর তীর কি নদীকে প্রেমিকার মতো বাহুলগ্ন করে রাখতে চায়? এছাড়াও কবিতাটিতে দেখা যায়, অতিথি পরায়ণ চট্টলাবাসী সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে বরণ করে নিয়েছেন বহিরাগত বিভিন্ন জাতিকে। কর্ণফুলীকে ঘিরে প্রচলিত মিথেরও ব্যবহার করেছেন কবি এই কবিতায়:
কবে কার একটু ভুলে কানেরই একটি দুলে
দুলেছে আমার শহর নিশীথের নদীর কূলে
ময়ুখ চৌধুরীর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই দীর্ঘকবিতা দেখা যায়। কখনো কখনো মনে হয় দীর্ঘকবিতার প্রতি কবির বিশেষ প্রযত্নময় দুর্বলতা রয়েছে। এমন একটি আখ্যানধর্মী দীর্ঘকবিতা হলো ‘আমার আসতে একটু দেরি হতে পারে’ কাব্যের ‘ঘুমের ভেতরে’ কবিতাটি। পাঠের সময় কবিতাটি তার পাঠককে নিশ্চিতভাবে মোহের ইন্দ্রজালে বন্দী করে রাখবে। এই কবিতায় একজন কন্যাশিশুর জীবনের বিকাশধারা কাব্যিক ব্যঞ্জনায় বিন্যস্ত হয়েছে। শিশুকন্যাটিকে দেখা যায়:
তোমার ভেতরে ছিলো/ কানামাছি ভোঁ-ভোঁ আলিঙ্গন
পল্লবিত শরীরের নির্দোষ উত্থান/ কোকিলের দুর্বোধ্য কূজন
এভাবে শিশুকন্যাটি ধীরে ধীরে কৈশোরে উপনীত হয় একদিন। পুতুলের বিয়ে দিতে দিতে নিজেই একদিন নিজেকে অন্যভাবে আবিষ্কার করে। তারপর কিশোরীর দেহে ও মনে তারুণ্য আসে। অনির্বচনীয় সেই তারুণ্যকে বচন দিয়েছেন কবি এই কবিতার পঙক্তিতে। যেদিন কবেকার সেই শিশুকন্যাটির হাতে মেহেদির রং লাগে সেদিন তার রূপ-লাবণ্য স্তম্ভিত করে দেয় সচকিত আগুনের মতো। যার অব্যবহিত পরেই মেহেদির সেই রং চোখের লবণ জলে ঝাপসা হয়ে যায়। শেষপর্যন্ত জীবন সমর্পিত হয় ঘুমের বড়ির ভেতরে।
ঘুমের বড়ির মধ্যে কখন সকল শান্তি চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকে তা কবিতার পঙক্তির চেয়েও ভালো জানে এই পৃথিবীর বিপন্ন আর নাস্তানাবুদ মানুষ। এই নারীও মুক্তি পায়নি এমন জীবনযন্ত্রণা থেকে। কবিতাটির ভালোলাগা শুধু তার অর্থবাচকতার মধ্যেই নয়, বরং দুই বেণীর মতো কবিতাটির আঙ্গিক বিন্যাসেও উঁকি দেয় সেই ভালোলাগা। কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে নির্মিত। পঙক্তি বিন্যাসে বৈচিত্র্য আছে।
ময়ুখ চৌধুরী দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে উচ্চারণ করেছেন, তাঁর নব্বই ভাগ কবিতাই বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতাপ্রসূত। অভিজ্ঞতার সূত্র দিয়েই তিনি নির্মাণ করেছেন সেসব কবিতা। তাই আমরা দেখি, জীবনসত্যের সাথে যখনই শিল্পসত্যের মিশ্রণ হয়েছে তখনই সৃষ্টি হয়েছে ভালোলাগার নিক্তিতে শিল্পসফল একেকটি কবিতা। সমুদ্রে ভেসে থাকা বরফপর্বতের সামান্য অংশই উপর থেকে দেখা যায়। সেই বরফপর্বতের পুরো জগতটাই লুকিয়ে থাকে জলের গভীরে। আমিও এই ছোট্ট পরিসরে মাত্র কয়েকটি কবিতা দিয়ে ময়ুখকাব্যের ভালোলাগার ভাসমান অংশটিই দেখানোর চেষ্টা করেছি। যার পুরো অংশটিই লুকানো আছে ময়ুখ চৌধুরীর দশটি কাব্যের শত শত কবিতার দেহ ও অন্তকরণজুড়ে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঘরে ফেরা ঘর
পরবর্তী নিবন্ধবিপন্ন বিস্ময়ের কবি জীবনানন্দ দাশ