বিপন্ন বিস্ময়ের কবি জীবনানন্দ দাশ

ডেইজী মউদুদ | শুক্রবার , ২৩ অক্টোবর, ২০২০ at ৯:২৬ পূর্বাহ্ণ

‘ আলো – অন্ধকারে যাই মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, – কোন এক বোধ কাজ করে
স্বপ্ন নয় – শান্তি নয়- ভালোবাসা নয় ,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
তিরিশোত্তর বাংলা কাব্য জগতের অন্যতম আধুনিক ও শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর নজরুল ইসলামের দীর্ঘ সময়ের শক্তিশালী কাব্যধারার সাথে অনেকটা বিদ্রোহ ঘোষণা করে কবি জীবনানন্দ দাশ, সুধীন দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী আর বিষ্ণু দে বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক নবধারার সূচনা করেন। ‘কল্লোল’ প্রগতি আর ‘কালি ও কলম’ যুগের এই কবিরা বাংলা কাব্যজগতে ‘পঞ্চপাণ্ডব ’ নামে পরিচিত। চর্যাপদের কবিদের পদাবলী থেকে শুরু করে মধ্য যুগের বাংলা কবিদের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিরায়ত প্রেম আর একচ্ছত্র রোমান্টিক কাব্য প্রতিভা আর কাজী নজরুল ইসলামের জ্বালাময়ী আর জাগরণী কবিতায় বাঙালি পাঠক দীর্ঘকাল বিমুগ্ধ ছিল। তিরিশের দশকে রবীন্দ্র -নজরুলের সেই কাব্য পরিমন্ডল ভেঙে এই পঞ্চপাণ্ডব বাংলা কবিতার ইতিহাসে সূচনা করেন নতুন এক আবহ। তারা কবিতার সাথে বিশ্ব এবং বিশ্বের নানা সমস্যা আর সংকটকে কবিতার বিষয়বসু্ত হিসাবে নির্বাচন করেন। বিশ্বের বড় বড় দার্শনিক, চিত্রকর, বিজ্ঞানী, কবি ও পণ্ডিতদের আদর্শকে তাঁরা প্রথম বাংলা কবিতায় সন্নিবেশিত করে আধুনিক বাংলা কবিতার সূচনা করেন। কেবল বিষয় বৈচিত্র্যে নয়, কবিতার আঙ্গিক আর কাব্যরীতিতেও আধুনিক কবিদের অনুসরণ করেন। কবি ও সমালোচক বুদ্বদেব বসু বলেন ‘কবি জীবনানন্দ দাশ পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত আগাগোড়া রোমান্টিক কবি।…তিনি সংসারের অস্তিত্ব আগাগোড়া অস্বীকার করেছেন, তিনি আমাদের হাত ধরে এক অপূর্ব রহস্যালোকে নিয়ে যান,- সে মায়াপুরী হয়তো আমরা কোনদিন স্বপ্নে দেখে আসবো’।
জীবনানন্দ দাশ যখন কবিতা লেখা শুরু করেন তখন বিশ্বের কবিরা এগিয়েছে অনেকদূর। নামী দামী শিল্পী আর দার্শনিকদের বিভিন্ন মতবাদ আর আদর্শকে কবি জীবনানন্দ দাশ তার চেতনায় অত্যন্ত সফলতার সাথে ধারণ করেছেন, চর্চা করেছেন, লালন করেছেন। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতার বিকাশ থেকে বিনাশএর বিভিন্ন ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর সাতটি কাব্যগ্রন্থের মাঝে ঝরা পালক, ধূসর পান্ডুলিপি, বনলতাসেন, রূপসী বাংলা, মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির আর বেলা অবেলা কালবেলার প্রত্যেকটি কবিতায় কবি তাঁর আধুনিক মনন, চিন্তা চেতনা আর ধ্যান ধারণার সার্থক প্রতিফলন ঘটান।
বিশ্বের বড় বড় সমস্যা আর সংকট, মানুষের জীবনের জটিলতা আর যন্ত্রণা কে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে দেখেছেন সুন্দর আর সুনীল পৃথিবী যেন ভরে গেছে অসংখ্য বিধ্বস্ত পাখির ঝরা পালকে। কবির প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘ঝরা পালক ’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালের শরৎকালে। এই গ্রন্থের তিনটি উল্লেখযোগ্য কবিতা হলো ‘নীলিমা, ‘পিরামিড ’ আর ‘সেদিন এ ধরণীর’। কবিতাগুলো ইতিহাসচেতনা, মহাজাগতিক বিস্ময়, অতীতকাতরতা, প্রেম আর প্রকৃতিনির্ভর। ইতিহাসের অনুসন্ধান করে কবি এখানে অতীতআশ্রয়ী হন। কাল আর মহাশূন্যের বিন্তৃতি কবির বহু কবিতায় স্বাতন্ত্র্যের ছাপ রেখেছে। বহু কবিতায় মৃত্যুচেতনা থাকলেও তাঁর কাব্যিক ভুবন অনেক বেশি জীবন্ত। সেদিন এ ধরণীর কবিতায় কবি প্রকৃতির নানা উপকরণকে অনেক বেশি মানবায়িত করে তুলেছেন।
‘চকিতে ছিড়িয়া গেল ধরণীর নাড়ির বন্ধন-/ শুনেছিনু কান পেতে জননীর স্থবির ক্রন্দন/ ডেকেছিল ভিজে ঘাস হেমন্তের হিম মাস জোনাকির ঝাঁড়! আমারে ডাকিয়াছিল আলেয়ার লাল মাঠ- শ্মশানের খেয়াঘাট আসি’ –
ইতিহাসের পরতে পরতে বিচরণ করতে করতে এক পর্যায়ে তিনি বুঝলেন পৃথিবীর পান্ডুলিপিএখন আর সুনীল নেই, তাঁর অন্তর্দৃষ্টিতে পৃথিবী এখন ধূসরতায় পরিপূর্ণ। ফলে তার পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ আমরা পেলাম ‘ধূসর পান্ডুলিপি’। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। এ গ্রন্থেও কবি অনেক বেশি ইতিহাস আর ঐতিহ্য সচেতন। গৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতা, গ্রীক পুরাণ, হিন্দু পুরাণকে তিনি অনুষঙ্গ হিসাবে নিয়েছেন, তবে ইংরেজ কবিদের রচনারীতি আর ভাবধারাকে অনুসরণ করেছেন। শকুন, বৈতরণী, ক্যাম্পে কবিতাগুলোসহ আরো কিছু কবিতা অসাধারণ নয়, অনন্যসাধারণ। তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বনলতা সেন’। প্রথম কবিতা ‘বনলতা সেন’ এ যেন তাঁর সব কথা বলা হয়ে গেছে। কবিতা রচনার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তিনি বিশ্ব পরিভ্রমণ করে কেবল বনলতা সেনের কাছে গিয়েই শান্তি পেয়েছিলেন। ইতিহাসচেতনা নির্ভর কবিতাগুলোর মাঝে তাঁর বনলতা সেন কবিতা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ও ‘হাজার বছর ধরে শুধু খেলা করে ’ ‘হাওয়ার রাত’ ‘নগ্ন নির্জন হাত’ আর ‘ শিকার’ কবিতায়ও নারী এসেছে, এসেছে প্রকৃতির বিভিন্ন উপকরণ ঘাস, ফুল, পাখি। তবে এসব উপকরণকে তিনি কবিতায় মানবায়িত করে তুলেছেন প্রখর কাব্যক্ষমতার মধ্য দিয়ে। এ কাব্যের বেশ কটি কবিতায় নারীরা শিরোনাম হয়ে এসেছে। আবার কোন কোন কবিতার ভেতরে আমরা নারী উপস্থিতি সরাসরি লক্ষ্য করি। যেমন :বনলতা সেন, শঙ্খমালা, সুদর্শনা, শ্যামলী, সুরঞ্জনা,সবিতা ও সুচেতনা। কবিতায় শেফালিকা বোস আর অরুণিমা সান্যালকেও আমরা খুঁজে পাই। রূপসী বাংলার প্রতিটি কবিতায় আবহমান গ্রাম বাংলার অপূর্ব নৈসর্গিক চিত্র কত ভাবেই না তিনি চিত্রিত করেছেন। ‘ আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয় , হয়তোবা শঙ্খচিল শালিখের বেশে. ..’
এক চিঠিতে কবি স্ত্রী লাবণ্যকে লিখেছিলেন : আমার কামনা কী জান? … ঘাসের নরম গন্ধের কাছে, রাত্রিদিন শালিখ বুলবুলি, কোকিল ও কাককে যারা আশ্রয় দিয়া আসিতেছেন, সেইখানে খড়ের একখাানা ঘর তুলিয়া পড়ি, লিখি, চুরুট ফুঁকি দিন কাটাইয়া দেই…’ এরপর ‘মহাপৃথিবী’তে তিনি বনলতা সেনের ধ্যান ধারণায় যেন আবিষ্ট ছিলেন। দেশবিভাগ, হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক সব মিলিয়ে পৃথিবীর অসুস্থতা তাকে পীড়িত করেছে। তাই পরবর্তীতে তিনি কেবল সাতটি তারার তিমিরকে গুণছিলেন। সপ্তঋষি তারকামণ্ডলকে নির্ভর করে কবি আবার উপলব্ধি করেন তার চারপাশের ভুবনকে। ‘আকাশলীনা’ কবিতায় বলছেন ‘ সুরঞ্জনা , ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে/ ফিরে এসো সুরঞ্জনা নক্ষত্রের রূপালী আগুন ভরা রাতে’।
তাঁর শেষকাব্যগ্রন্থ ‘বেলা অবেলা কালবেলায়’ রাজনৈতিক মৃত্যুচিন্তা কবির বেশ কিছু কবিতায় সরাসরি এসেছে। তিনি লিখেন ‘একদিন একরাত করেছি মৃত্যুর সাথে খেলা / একদিন একরাত করেছি মৃত্যুরে অবহেলা/ একদিন একরাত তারপর প্রেম গেছে চলে / সকলে চলিয়া যায় সকলের যেতে হয় বলে।
জীবনানন্দ দাশকে কেউ বলেছেন শুদ্ধতম কবি, আবার কেউ বলেছেন নির্জনতার কবি। কেউবা বলেছেন বিপন্ন বিস্ময়ের কবি আর কবি নিজেই বলেন, সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। তিনি একা একা হাঁটতেন কলকাতার রাস্তায়। হেঁটে হেঁটে ভাবতেন ‘কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে ’। কবিতার পংক্তিমালায় নিজেই বলেছেন ‘ভেবে ভেবে ব্যথা পাবো ’। এভাবে ভাবতে ভাবতেই তিনি রাস্তা পার হতে গিয়ে ট্রামের চাকায় পিষ্ঠ হয়ে গুরুতর আঘাত পান। কয়েকদিন হাসপাতালে থাকা অবস্থায় আধুনিক বাংলা কবিতার ভুবন থেকে তিনি ছিটকে পড়েন অন্ধকারের পথে। হয়তো বা কঠিন এই অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে কবি বলছিলেন : ‘গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর ছল ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার, তাকিয়ে দেখলাম পাণ্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে যেন কীর্তিনাশার দিকে,ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে আদি শুয়েছিলাম- পউষের রাতে -/ কোনদিন জাগবো না জেনে / কোনদিন জাগেবোনা আমি – কোনদিন জাগবোনা আর-’। আসলেই তিনি আর জাগেননি কোনদিনই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধময়ুখকাব্যের অন্তর্গত নিনাদ
পরবর্তী নিবন্ধউৎপাদন বৃদ্ধি করে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার আহবান