মৌলভী সৈয়দ স্মরণে

রোকন উদ্দীন আহমদ | বৃহস্পতিবার , ১১ আগস্ট, ২০২২ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃসংশভাবে হত্যা করা হয় স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সাত বছরের শিশু রাসেল জীবন ভিক্ষা চেয়েও প্রাণে বাঁচতে পারেনি। এই বিভৎস হত্যাকণ্ডে বিশ্ব বিবেক স্থম্ভিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর দেশের পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তোলা হয়। যাতে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে কেউ সাহস না পায়। দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধুর সহচর ও অনুসারীদের নির্যাতন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে গ্রেফতার করে জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। জাতীয় চার নেতার সাথে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর বঙ্গবন্ধুর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ, তোফায়েল আহমদ, বিশ্বস্ত সচিব বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা এইচ.টি ইমাম, বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ সহ অনেক নেতাকে গ্রেফতার ও নির্যাতন করা হয়।
পরিকল্পিত নির্যাতন থেকে চট্টগ্রামের রাজনীতিকরাও রেহাই পাননি। অবস্থার প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতারা মুখ খুলতে পারেননি। এই বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে জাতির পিতার রক্তঋণ শোধে দক্ষিণ চট্টগ্রাম যুবলীগ সভাপতি মৌলভী সৈয়দ আহমদ চট্টলবীরের ভূমিকা পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে তিনি জীবন দিয়েছেন। মৌলভী সৈয়দ আহমদ চৌধুরী বাঁশখালী থানার শেখেরখীলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা একরাম মিয়া ও মাতা ওমেদা খাতুন। মৌলভী সৈয়দ আহমদ চৌধুরী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রতিবাদী। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড পরবর্তী প্রতিরোধের চেষ্টা করেছেন। খুনিদের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন গড়ার প্রয়াস চালিয়েছেন। স্বার্থের লোভে কিংবা হুমকিতে নিজ লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি। মৌলভী সৈয়দকে প্রাণ দিতে হওয়ার কারণ এটি। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদের লেখা থেকে জানা যায়, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মৌলভী সৈয়দ আহমদ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম ও মোসলেম উদ্দিন আহমদ ঢাকায় ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে মৌলভী সৈয়দ ক্ষিপ্ত হন। তাৎক্ষণিকভাবেই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। খুনিদের প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন’।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মৌলভী সৈয়দ চট্টগ্রামে তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামের চেষ্টা করেন। এসময় তিনি অবিবাহিত ছিলেন। প্রতিরোধ সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ায় তিনি বিবাহের কথা চূড়ান্ত হলেও বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত নেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে ১৯৭৫ সালে ৩ নভেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে রক্তপাতহীন এক অভ্যূত্থানে জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা হয়। এই অভ্যূত্থানের পক্ষে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মিছিলে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন মৌলভী সৈয়দ আহমদ। ৭ নভেম্বর পাল্টা অভ্যূত্থানে খালেদ মোশারফ নিহত হলে মৌলভী সৈয়দ বেশ কয়েকজন সঙ্গী সহ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ভারত থেকে আসা-যাওয়া করে দেশের অভ্যন্তরে সহকর্মীদের নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন। এ সময় তাঁরা হঠাৎ কোনো জায়গায় আক্রমণ করতেন। এসময় নিউ মার্কেট সংলগ্ন সড়কে, দামপাড়াস্থ পুলিশ লাইনসহ কয়েক স্থানে গ্রেনেড হামলায় তিনি নেতৃত্ব দেন। এসব সংগ্রামে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও পটিয়ার এস.এম ইউসুফ জড়িত ছিলেন। তৎকালীন সামরিক সরকারকে বাধাগ্রস্ত করতে তিনি এসব কর্মকাণ্ড চালাতেন। ১৯৭৩ সালের সংসদের এমপিদের নিয়ে তিনি প্রবাসী সরকার গঠনের চেষ্টা করেন। এতে তিনি ব্যর্থ হন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধ সংগ্রাম করার সময় মৌলভী সৈয়দ ডবলমুরিং থানার উত্তর আগ্রাবাদের সৈয়দ বাড়ির সৈয়দ আবু সিদ্দিকের ঘরে থাকতেন। সৈয়দ আবু সিদ্দিক তাঁকে প্রতিরোধ সংগ্রাম করতে আশ্রয় ও সহযোগিতা দিয়েছিলেন। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের এক পর্যায়ে ১৯৭৬ সালের ৭ নভেম্বর সামরিক সরকার মৌলভী সৈয়দ ও তার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা-১, মামলা-২, মামলা-৩ নামে তিনটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় মৌলভী সৈয়দকে প্রধান আসামী ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ২ নম্বর আসামী করা হয়। এই মামলায় এডভোকেট শ্যামল প্রসাদ সেন, সৈয়দ আবু সিদ্দিক, আবু সিদ্দিকের দুই সন্তান সৈয়দ আবদুল গণি, সৈয়দ মাহমুদুল হক, মোহাম্মদ জাকারিয়া, ইঞ্জিনিয়ার দিপেশ চৌধুরী, এডভোকেট সালাউদ্দিন, মোহাম্মদ ইউনুছ, কেশব সেন, পিযুশ, নায়েক শফিসহ ১৫/১৬ জনকে আসামী করা হয়। এদের মধ্যে কেশব সেন ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ছাড়া অন্যরা গ্রেফতার হন। উল্লেখ্য ভারতের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার পরাজিত হলে মোরারজি দেশাই ক্ষমতায় আসে। বাংলাদেশের জিয়ার সরকারের সাথে মোরারজি দেশাই সরকারের এক চুক্তিবলে ময়মনসিংহ বর্ডার দিয়ে ভারত থেকে মৌলভী সৈয়দ আহমদ ও তাঁর সহকর্মীদের বাংলাদেশে প্যুশব্যাক করা হয়। বর্ডার থেকে মৌলভী সৈয়দ ও বগুড়ার খসরু সহ অনেককেই গ্রেফতার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যাওয়ার পর জি.জি.এফ.আই এর জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেনা গোয়েন্দা সংস্থা জি.জি.এফ.আই এর জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে অমানবিক নির্যাতন করে বিনা বিচারে ১৯৭৭ সালের ১১ আগস্ট বগুড়ার খসরু ও চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দকে হত্যা করা হয়। মৌলভী সৈয়দকে হত্যার পর তার পিতাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে লাশ সনাক্ত করান। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তত্ত্বাবধানে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম থেকে লঞ্চ যোগে মৌলভী সৈয়দের লাশ বাঁশখালীতে নেওয়া হয়। পুলিশ, বিডিআর ও আর্মির উপস্থিতি সত্ত্বেও বাঁশখালীতে মৌলভী সৈয়দের জানাযায় মানুষের বিশাল সমাবেশ হয়। মৌলভী সৈয়দকে দাফন করার পর প্রায় ১ মাস পুলিশ তাঁর কবর পাহারা দিয়ে রাখে। যাতে জনগণ বা মৌলভী সৈয়দের অনুসারীরা হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ কিংবা জনমত সৃষ্টি করতে না পারে।
মৌলভী সৈয়দের রাজনৈতিক দর্শন ছিল ভিন্নমাত্রার। তিনি ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য থেকেই এই দর্শন লাভ করেছিলেন। ছিলেন বিরল রাজনৈতিক আদর্শ। মৌলভী সৈয়দ প্রথম দিকে মাদ্‌রাসায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরে চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। নিজস্ব দর্শনের কারণে তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে নক্ষত্রের মতো দেদিপ্যমান ছিলেন। তিনি ছিলেন জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর বিশ্বস্ত কর্মী। মৌলভী সৈয়দ চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি থাকাকালে চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মৌলভী সৈয়দ বাকশালের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। মৌলভী সৈয়দ জনসত্তরের গণআন্দোলনে চট্টগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের মাঝে অগ্রভাগে ছিলেন। তিনি খুবই সাহসী ছিলেন। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহরে সাহসী অপরেশন পরিচালনাকারী দলগুলোর নেতৃত্ব দেন মৌলভী সৈয়দ। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহরে কয়েকটি সফল অভিযান তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।
মেধা, যোগ্যতা ও জাতির প্রতি দায়বোধ থেকে তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। শ্রমিক রাজনীতিতেও তিনি সফল সংগঠক ছিলেন। শ্রমিক নেতা হিসেবে তিনি জাতীয় পর্যায়ে খ্যাতি অর্জন করেন। জাতীয় নেতা শেখ ফজলুল হক মনি তাঁকে শ্রমিক রাজনীতিতেই থেকে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি রাজনীতির উপর অধ্যয়ন করতেন। এজন্য ব্যক্তিগত লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। সংগীত চর্চা করতেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে জীবন উৎসর্গ করে তিনি দেশ প্রেমিক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছেন। জীবন দিয়ে জাতির পিতার রক্তঋণ শোধ করেছেন। বাঙালির জাতীয় বীরের মর্যাদাসীন হয়েছেন। চট্টলবীর মৌলভী সৈয়দ আহমদ যুগে যুগে হত্যা-ষড়যন্ত্রের রাজনীতির বিরুদ্ধে বিপ্লবী প্রেরণা হয়ে থাকবেন।
লেখক: সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচলুন শুধুই নিজের কথা ভাবি
পরবর্তী নিবন্ধমূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কমাতে হবে আমদানি নির্ভরতা