মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কমাতে হবে আমদানি নির্ভরতা

রেজাউল করিম স্বপন | বৃহস্পতিবার , ১১ আগস্ট, ২০২২ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

চাহিদা ও যোগান সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে যে কোনো পণ্যের দাম উঠানামা করে। সহজ ভাষায় পণ্যের দাম বাড়লে টাকার মান কমে এটাই হলো মূল্যস্ফীতি। তবে ‘কোন কালপরিধিতে পণ্য সেবার মূল্য টাকার অঙ্কে বেড়ে গেলে অর্থনীতির ভাষায় তাকে মূল্যস্ফীতি বলা হয়’। সাধারণত পণ্যের দাম বেড়ে গেলে স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে ঐ পণ্য ক্রয়ে বেশি মুদ্রার প্রয়োজন কিংবা একই পরিমাণ মুদ্রা দিয়ে পণ্য কিনতে গেলে পরিমাণে কম পাওয়া যায়। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় সব দেশেই জিনিস পত্রের দাম বাড়ছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। মূল্যস্ফীতির চাপে বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষ দিশেহারা। বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতির সরকারি যে হিসাব দেয়া হচ্ছে, বাস্তবে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। সবদেশেই মূল্যস্ফীতি অব্যাহত রয়েছে এবং এর গতি ধীর হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে? দ্রব্যমূল্য কি বাড়তেই থাকবে? অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেন, একটি অর্থনৈতিক মন্দার ভেতর দিয়েই এ মূল্যস্ফীতির অবসান হতে পারে। তবে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার জন্য সুদের হার বাড়ানো শুরু করেছে।
তবে তাত্ত্বিকভাবে দুই কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। চাহিদা বৃদ্ধি ও উৎপাদন ব্যয় বাড়লে। কোভিডের ধাক্কা অনেকটা কেটে গেলে গত জানুয়ারি থেকে বিশ্বব্যাপি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক হতে শুরু করে এতে চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সরবরাহ সংকট ও উৎপাদন কম থাকায় সে সময় থেকেই বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। এরপর ২৪.২.২০২২ তারিখে রাশিয়া ইউক্রেন হামলা করলে জ্বালানি সংকট দেখা দেয়। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। আবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে গমসহ খাদ্যশস্যের সরবরাহ কমে যায়। ফলে বিশ্বে একই সময় চাহিদাজনিত ও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। যা ইতিহাসে খুব একটা দেখা যায় না। এর ফলে বিশ্বে ভোজ্য তেলের মূল্য বেড়েছে ৫০%। গমের দাম হয়েছে দ্বিগুণ। জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলে ১৭১ মা. ডলার পেরিয়েছে। প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৪ ডলার হতে বেড়ে ৪১ ডলারের কাছাকাছি হয়েছে। শিল্পের কাচামাল তুলা, ক্লিংকার, লোহা ইত্যাদির দাম বেড়েছে ৫০%- ১০০% পর্যন্ত। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, এপ্রিলে তাদের মূল্যস্ফীতি ৮.৫%, যা ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং সামনে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে এবং তা ১০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। তবে আগামী বছর থেকে এই মূল্যস্ফীতি কমে আসবে ও আগামী দুই বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশের মতো হবে বলে আশা করছে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড। যুক্তরাষ্ট্রেও এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮.৫%। তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তার ফলে অর্থনৈতিক মন্দাও দেখা দিতে পারে।
এদিকে গত জুন ‘২২ এ বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৭.৫৬%, মে ‘২২ তে ৭.৪২%। যা বিগত ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। পর্যালোচনায় দেখা যায়, মে জুন মাসে বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে খাদ্যে। এর মানে হলো খাদ্য দ্রব্যের দাম বেড়েছে বেশি। এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিলো ৬.২৯% এবং গত চার মাস ধরেই দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৬% এর বেশি। যদিও আশে পাশের দেশের তুলনায় মূল্যস্ফীতি কম। এপ্রিলে ভারতে মূল্যস্ফীতি ছিলো ৬.৭৮%, পাকিস্তানে ছিলো ১৩.৪%, শ্রীলঙ্কায় ছিলো ২৯.৮%, নেপালে ছিলো ৭.২৮%। তবে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি গণনা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ আছে। তারা বলেন আশে পাশের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। এ দেশেও মূল্যস্ফীতি একই রকম হওয়ার কথা। তাদের মতে বাংলাদেশে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি ৬% নয়, আরো বেশি। গরীব মানুষের উপর মূল্যস্ফীতির চাপ ১০% থেকে ১৫% এর কম নয়। এতে দারিদ্র্য সীমার কিছুটা উপরে থাকা মানুষেরা আবার গরীব হয়ে যেতে পারে। এমনিতে করোনায় গরীব ও সীমিত আয়ের মানুষের আয় কমে গেছে। এখন তারা আরো ভোগান্তিতে পড়ছেন। সরকারের এখন সবচেয়ে বড় চ্যলেঞ্জ হলো নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা। এদিকে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে আড়াই বছর আগে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলো। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৫৪% (প্রায় ৮ কোটি) সবসময় আবার গরীব হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এদিকে সামপ্রতিক মূল্যস্ফীতিতে কিছুটা বৈচিত্র্য এসেছে। আগে ২-৪টি প্রধান ভোগ্য পণ্যের দাম বাড়লেই মূল্যস্ফীতি বাড়তো। কিন্তু এবার প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। গত এপ্রিলে সরকারি সংস্থা বিবিএস দৈনন্দিন ব্যবহার্য্য ৪৭ টি পণ্যের দাম বাড়া কমার তথ্য উপস্থাপন করে। এতে দেখা যায়, সেই বহুল ব্যবহৃত ৪৭টি পণ্যের মধ্যে এপ্রিলে ৩২টি পণ্যের দাম বেড়েছে। এই তালিকায় রয়েছে চাল, ডাল, চিনি, মাছ, মাংস, ভোজ্যতেল, দুধ, জ্বালানি, পোশাক ইত্যাদি। মাত্র ১৫ টি পণ্যের দাম অপরিবর্তিত বা কমেছে। ঐ সময় যেগুলো দাম অপরিবর্তিত ছিল, পরবর্তীতে সেগুলোর দামও বেড়েছে। ফলে দাম বাড়ার যন্ত্রণায় আছে সাধারণ মানুষ। তবে মূল্য স্ফীতি গণনায় একক পণ্য হিসাবে চালের অবদান সবচেয়ে বেশী। কারণ গরীব মানুষের আয়ের ২৫-৩০% ব্যয় হয় চাল কিনতে। এখন ভরা মৌসুমেও চালের দাম বাড়ছে। অর্থাৎ মূল্য স্ফীতির মূল কারণ পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। যদি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকানো যায়, তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হলে দেশজ পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। যদিও বর্তমানে দেশের চাহিদা পুরনের জন্য চাল ডাল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যই আমদানি করতে হয়। তাই বিদেশে দাম বাড়লে দেশেও সেই পণ্যের দাম বাড়ে, ফলে মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যায়। তবে বিদেশে দাম কমলে তার সুফল দেশের মানুষ কমই পায়। কারণ কাস্টমস আইন অনুযায়ী আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য নির্ধারণে তিন মাসের সর্বনিম্ন মূল্যকে বিবেচনায় নিয়ে ছাড় দেওয়া হয়। তাই বিশ্বে কোনো পণ্যের মূল হঠাৎ কমে গেলে তার সুফল পাওয়া যায় না।
একসময় আমাদের দেশে একটি কথার প্রচলন ছিলো। গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ। তখন প্রতিটি পরিবার ছিলো স্বয়ংসম্পূর্ণ। চাল, ডাল, তরকারি, মাছ, মুরগী, গরু, ছাগল, মসল্লাজাতীয় পণ্য, দেশীয় ফলাদি অর্থাৎ নিত্য ব্যবহার্য সব পণ্য নিজেরাই উৎপাদন করতো। ফলে দেশে বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে হতো না। কিন্তু কালের বিবর্তনে, আধুনিকতার ছোঁয়া, অলসতা ও বিলাসিতায় আমরা নিজেদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি উৎপাদন থেকে আমদানি করাতে বেশি আগ্রহী। তাই তো বিশ্বের কোথাও কোনো একটি যুদ্ধ বা রপ্তানি নির্ভর দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলেই আমাদের দেশের অবস্থা কাহিল হয়ে যায়। অথচ দেশে হাজার হাজার একর জমি অনাবাদি পড়ে রয়েছে। খোঁজ করলে দেখা যায়, এর প্রধান কারণ দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের অপ্রতুলতা, মজুরি বৃদ্ধি ও প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার না করা। উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়া, দালাল, মধ্যস্বত্ব ভোগী ও ফরিয়াদের দৌরাত্ম্য। ফলে সিজনে প্রায় সব পণ্যকে উৎপাদন খরচ থেকে কম দামে বিক্রি করতে হয় ও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে অনেক পণ্য নষ্ট হয়ে যায়। তাই দেশজ উৎপাদন বাড়ানো, যথাযথ সংরক্ষণ ও ন্যায্য মূল্যের দিকে আমাদের নজর ও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তবেই হয়ত আমরা পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো এবং মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে পারবো। মনে রাখতে হবে, উৎপাদন বাড়লে বিদেশ হতে আমদানি কম হবে। এতে বৈদেশিক মূদ্রার উপর চাপ কমবে। আর বৈদেশিক মুদ্রার উপর চাপ যত কম হবে টাকার মান তত স্থিতিশীল থাকবে। টাকার মান যত স্থিতি শীল হবে অর্থনৈতিক।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমৌলভী সৈয়দ স্মরণে
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল