মিলিটারি আসেনি

শিবুকান্তি দাশ | বুধবার , ৩১ মার্চ, ২০২১ at ৬:৪৬ পূর্বাহ্ণ

জুন মাসের মাঝামাঝি সময়। বর্ষাকাল। গ্রামে মিলিটারি আসবে আসবে শোনা যাচ্ছিল। কোন দিন আসে কেউ বলতে পারে না। গ্রামের কিছু চেনা লোক রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছে। তারা দিনকে দিন গ্রামের মানুষের উপর জুলুম করে যাচ্ছে। কথায় কথায় মিলিটারির ভয় দেখায়। তাদের ভয়ে গ্রামের মানুষ অস্থির। থানা সদরে মিলিটারি ক্যাম্প করেছে।
গ্রামের মাথা ধীরেন জেঠা। তিনি ইশকুল শিক্ষক। সবাই তাকে মান্য করে চলে। তার কাছে সবাই প্রতিদিন যুদ্ধের খবর জানতে আসে। সেই মার্চের শুরু থেকেই বলতে গেলে ইশকুল বন্ধ। ধীরেন জেঠা তারপরও প্রতিদিন ইশকুলে যায়। একা একা ইশকুলে থাকাটা বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই পরিবার থেকে তাকে ইশকুলে যাওয়া বারণ করে দিয়েছে। সেই থেকে ঘরবন্দি।
গ্রামের এক দুরন্ত কিশোর পিন্টু। সে ক্লাস এইটে পড়ে। ইশকুল বন্ধ থাকায় পাড়ার বন্ধুদের নিয়ে সারাদিন মাঠে মাঠে খেলাধুলা, পাখি ধরা এটা ওটা নিয়ে সময় পার করে। মা বাবার বারণ তো শোনেই না, উল্টো বাবা মাকে জ্ঞান দেয়। বলে কি আমি যুদ্ধে যাবো। পাকিস্তানি মিলিটারি গুলোকে গুলি করে শেষ করে দেবো।
মা চিৎকার করে এসব কথা না বলতে বারণ করে। কে শোনে কার কথা। দেয় এক দৌড়।
আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। যে কোন সময় ঝুবঝুব বৃষ্টি আসতে পারে। পিন্টুর বাবা হরেন কাকা মাঠের দিকে পা বাড়ায় গরু আনতে। গরুটাকে একটু চড়ালেও হয়। ছেলেটা যে কি হবে জানি না। বির বির করে বলতে থাকে কাকা।
পিন্টুর বাপ কই চললে। বাদশা মিয়া জানতে চাইল।
কই আর যাই। মাঠে গরুটা সকাল থেকে বাধা। বৃষ্টি আসতে পারে তাই —-
কিছু কি শোনছো ?
কি ভাইজান। কোন খারাপ খবর। পিন্টু বাবা বাদশা মিয়াকে জানাই।
আরে থানা সদরে তো মিলিটারি ক্যাম্প গড়েছে। শোনতাছি যে কোন দিন গ্রামেও আসতে পারে।
তা তো শোনতাছি ? সবাইকে তো এবার গুলি করে মারবে।
সেই তো চিন্তা, গ্রামের মানুষকে কি ভাবে বাঁচানো যাবে ভাবতেছি। তো যাচ্ছি ধীরেন মাস্টারের বাড়ি। তুমিও আইসো কিন্তু।
বাদশা মিয়াও গ্রামের মাথাদের একজন। তবে ধীরেন মাস্টারকে মান্য করে সবার মতো তিনিও। সুখে দুখে সবাই ধীরেন মাস্টারের কাছে ছুটে যায়। তিনি যে সিদ্ধান্ত জানান তা সবাই মেনে নেয়।
মাষ্টার সাব বাড়ি আছেন ?
কে,কে। আছি তো। বলেই ধীরেন জেঠা ঘরের বাইরে আসে। দেখে বাদশা মিয়া।
আরে আসেন আসেন বলে বারান্দায় পিঁড়িতে বসতে দেয় বাদশা মিয়াকে।
এ সময় হরেন কাকাও পৌঁছে যায়। গ্রামের আরো দুইজন মাথা কানাই জেঠা ও হাসমত মেম্বারও হাজির। সবাই বসে যুদ্ধের অনেক কথা আলোচনা করলেন।
বাদশা মিয়া বললেন মিলিটারি গ্রামে তো আসবেই। রাজাকাররা যে ভাবে হাব ভাব দেখাচ্ছে তাতে তো সুবিধে মনে হচ্ছে না।
তা তো সবাই অবগত। এখন আমাদের কি করতে হবে। মিলিটারির গুলি থেকে বাঁচার উপায়টা কন। হরেন কাকার আকুতি ।
মেম্বার সাব আপনে কি কন, কি বুঝতেছেন ? বাদশা মিয়া বলেন।
আমাগো চেয়ারম্যান সাব তো সেই যে ২৬ মার্চ শহরে গেলো আর তো ফিরে নাই। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর পাইয়া আরো কি খবর জানতে যাচ্ছেন বইলা সেই যে গেলো আর তো কোন খবর পাই না। এখন মুরশিদ মেম্বার তো নিজেকে চেয়ারম্যান বইলা বেড়াই। তার সাথে গ্রামের শুক্কুর,নজির, মুন্সিও আছে। ওরা শান্তি কমিটি না কি গঠন করেছে। গ্রামের যুবকদেরকে জোর করে রাজাকার বাহিনীর সদস্য বানাইতেছে। আমাকেও ডেকেছিল।
কও কি ?
আমার সাফ জবাব, বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতা ঘোষণা কইরা দিছে এখন যা যা করার তা আমাদের করতে হবে।গ্রামে কোন রাজাকার বাহিনী হইব না।
এই জন্যই তো সবাই মাস্টার সাবের কাছে আইলাম। বাদশা মিয়া বললেন।
দেখো এখন দেশের যে অবস্থা তাতে যে কোন সময় বিপদ আসতে পারে। এখন আমাদের কাজ হবে মুক্তিদের সাথে যোগাযোগ করা। তাদের মাধ্যমে মিলিটারিদের খোঁজ খবর করা। সেই ভাবেই আমদের প্রস্তুুতি নিতে হবে। বিশেষ করে মেয়েদের আর ছোট ছোট বাচ্চাদের নিরাপদে সরিয়ে রাখার কাজটা। ধীরেন জেঠা মতামত দেয়।
আত্নীয় স্বজনদের বাড়িতে মেয়েদেরকে রেখে আসলে কেমন হবে মাস্টার সাব। হরেন কাকা বলেন।
এটা খুবই উত্তম প্রস্তাব। বাদশা মিয়া জবাব দেয়। আমরা এ কাজটা কালকে থেকে গোপনে সবাইকে বলে দিই। তারপর অন্য সিদ্ধান্ত।
বাদশা মিয়ার কথাটা সবাই মেনে নিয়ে বৈঠক থেকে উঠতে যাবে এমন সময় হাজির হয় বিমল কাকা। তিনি একটি রাজনৈতিক দলেরও নেতা। তিনি থানা সদর থেকে আসছেন। বাড়িতে না গিয়ে চলে আসেন এখানে। উনাকে দেখে সবাই আবার বসলেন। তিনি খবর পেয়েছেন আগামী শুক্রবার রাতে মিলিটারি গ্রামে আসতে পারে। আর মাত্র তিনদিন বাকি।
পিন্টুর বন্ধুরা ইশকুলের মাঠে প্রতিদিন খেলাধুলা করে। সেখানে পরিচয় হয় কলেজ পড়ুয়া গ্রামের আনিস, বাসু,অলকের সাথে। তারা মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছে নদীর পাড়ে। আগ্রহী হয়ে উঠে পিন্টু ও তার বন্ধুরাও। কথায় কথায় চূড়ান্ত হয়ে যায় ট্রেনিং নেয়ার। তারাও গ্রামে মিলিটারি আসার কথাটা মাথায় নিয়ে প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেয়।
ধীরেন জেঠা আর বাদশা মিয়া মিলে সিদ্ধান্ত নেয় শুক্রবার সন্ধ্যা হতেই সবাই নৌকায় উঠে যাবে। শুকনো খাবার সাথে রাখা হবে। এ জন্য দশটা বড় নৌকা ভাড়া করে আনা হয়। যেই কথা সেই কাজ। এদিকে পিন্টুরাও গ্রামের প্রবেশের তিন পথে পাহারায় বসায়। এ খবরটাও ধীরেন জেঠাদের দেয়া হয়। বিমল কাকা খবরটা নিয়ে আসে।
চারদিকে থ্‌ই থই জল। গ্রামের দক্ষিণে সব নৌকা রাখা হয়েছে। থানা সদর থেকে আসার পথ পশ্চিম দিকের বড় রাস্তা্‌টা। সেটাও জলে ডুবে গেছে। রাস্তার উপর কোমর সমান জল। গ্রামের রাজাকাররা কিছুই বুঝতে পারেনি। পিন্টুদের দলটা তিন ভাগে ভাগ হয়ে আছে। মিলিটারি গ্রামে প্রবেশের মুখেই প্রতিরোধ করবে।
রাত বাড়তে থাকে। গ্রামে কোন সাড়া শব্দ নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। নৌকায় কোন শব্দ নেই। মাঝে মাঝে পাট ক্ষেত থাকাতে নৌকাগুলো দেখায় যাচ্ছে না। কারো চোখে ঘুমও নেই।
বাইনোকোলারে অনেক দূরে দুটো নৌকা দেখে পিন্টুদের দল। তারা বোঝার চেষ্টা করছে নৌকা দুটো গ্রামে আসছে না অন্য দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ এমন জোড়ে বৃষ্টি আসলো যেন সব কিছু ভেসে নিয়ে যাবে। নৌকাগুলো বার বার দুলে উঠছে। লোকজন সব ভয়ে জড়োসড়ো। ধীরেন জেঠা ও বাদশা মিয়া সবাইকে ভরসা দিয়ে যাচ্ছে। পিন্টুদের দলটা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে থাকাতে খুব ধীরস্থর ধীরেন জেঠা, বাদশা মিয়া, বিমল কাকারা।
এভাবে কখন যে ভোরের আযানের সময় হয়ে গেছে কেউ টেরই পায়নি। ভোরের আলো ফুটতে ফুটতেই থানা সদর থেকে নৌকায় করে আসে মুক্তিযোদ্ধাদের ইনফরমার কালু শেখ ও আরো কয়েকজন। তারা সারারাত মিলিটারিদের অবস্থান লক্ষ্য রাখছিল। সন্ধ্যা থেকে আকাশে মেঘ দেখে বৃষ্টি নামতে পারে ভয়ে মিলিটারিরা গ্রামে আসার সিদ্ধান্ত বাতিল করে আগেই। গ্রামের রাজাকাররা মিলিটারিদের সাথেই ছিল। কিন্তু উপর থেকে মিলিটারিদের নির্দেশ আসে জালালীহাট রেল স্টেশন দখল করে ট্রেনের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার। যে কারনে ভোরে মিলিটারিরা তাঁবু ঘুটিয়ে নিয়েছে। এদিকে সন্দেহজনক ঘোরাঘুরি করতে দেখে পিন্টুদের দলের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় অস্ত্রধারি দুইজন রাজাকার। খবরটা সকাল হতেই সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে মিছিল করে পিন্টুদের ক্ষুদে বাহিনী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনেতার ডাকে
পরবর্তী নিবন্ধকিছু জানা কিছু অজানা