মা

প্রদীপ নন্দী | শুক্রবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২০ at ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ

শহরে লকডাউন। বিকেলের আলোটা ম্লান হতে চলেছে। সন্ধ্যা নামে নামে। রাস্তার বাতিগুলো তখনো জ্বলে উঠে নাই। রাস্তাঘাট অনেকটা ফাঁকা। দোকানপাট প্রায় বন্ধ। করোনায় আতঙ্কগ্রস্ত লোকজন ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে । অচিনবাবু চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব থেকে চেরাগী পাহাড় হয়ে ডিসি হিলের ফুটপাত ধরে বাসার উদ্দেশ্যে হাঁটছিলেন । ডিসি হিলের প্রধান ফটকের কাছে এলে শিশুর বুক ফাঁটা অবিরাম কান্নায় অচিনবাবুকে থামতে হলো। নিস্তব্ধ ডিসি হিলের ভিতরে কান্নার শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। গাছের সবুজ পাতাগুলো ঝিমুচ্ছে। অচিনবাবু চারিদিকে তাকালেন। ডিসি হিলের ভিতরে চোখ পড়তেই দেখতে পেলেন, ফটকের কাছে মায়ের ছড়ানো দুই উরুর মত সিরিষ গাছের দুই মোটা শিখরের মাঝখানে পাঁচ-ছয় মাসের এক শিশু সন্তান বুক চাপড়িয়ে নিরবচ্ছিন্ন কণ্ঠে কান্না করছে। শিশুটির কান্নায় অচিনবাবু বিচলিত হয়ে উঠেন। শিশুটির প্রতি দৃষ্টি দিতেই শিশুটির প্রতি তার মায়া জাগে। তিনি চারিদিকে তাকালেন, কাউকে দেখতে পেলেন না। এক অদৃশ্য মায়ার টানে অচিনবাবু শিশুটির কাছে চলে এলেন। শিশুটির কান্না থামাতে তার মনে তোলপাড় শুরু হয়। কাগজে শিশুদের নিয়ে প্রচারিত নানা খবর পাঠ অচিনবাবুকে শিশু হিতোইশি করে তোলে। কাগজে নিয়মিত দেখা যায়, নালা-নর্দমায়,ডাস্টবিনে নবজাত শিশু বর্জ্য হয়ে পড়ে থাকার খবর, অভাবের তাড়নায় কোলের শিশুকে রাস্তার ধারে রেখে পিতা-মাতা অন্তর্ধান হওয়ার নানা খবর। মানব শিশুর প্রতি মানুষের অমানবিক আচরণ অচিন বাবুকে ব্যথিত করে। তাই কান্না থামিয়ে অবুঝ শিশুটিকে সান্ত্বনা দিতে তার করুণা হয়। কাছে যেতেই অচিনবাবু চম্‌কে উঠলেন। কেউ যদি তাকে শিশুচোর ভাবে।
তিনি তো খবরের শিরোনামে এইটাও দেখেছেন, অসহায় শিশুকে করুণা দেখাতে গিয়ে শিশুচোর অপবাদে মানুষকে নাজেহাল হতে। শিশু প্রেমিক অচিনবাবু বিব্রতবোধ করেন। তিনি বার বার চারিদিকে তাকালেন্‌। কাউকে দেখতে পেলেন না্‌। তার বিগলিত মন শিশুটির মায়ায় জড়িয়ে পড়ে। তাই তিনি নতুন করে ভাবতে শুরু করেন, কারা শিশুটাকে এখানে রেখে গেল? কেনই বা রেখে গেল? মনের নানা প্রশ্ন মানবিক অচিন বাবুকে বিব্রত করে তোলে। তিনি শিশুটার কান্নার কারণ খুঁজতে থাকেন। তিনি আপন মনে বিড় বিড় করে বলেন, ক্ষিধে পেলে শিশুরা স্বভাবত কান্না করে। কথায় বলে, না কাঁদলে শিশু দুধ পা্‌য় না। হয়ত তাই, শিশুটির মা কোথায় গেছে শিশুটা ক্ষুধার তাড়নায় কান্না জুড়েছে। খানা পেলে হয়ত কান্না থেমে যাবে। অচিন বাবু নিজের ডান হাতখানি কাঁধে ঝুলানো ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। সকালের নাস্তার জন্য নেয়া রুটিখানি বের করে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে শিশুটির সামনে গিয়ে বসেন। অতি যত্ন সহকারে রুটিখানি শিশুটির দিকে বাড়িয়ে দেন। কিন্তু কী অবাক কাণ্ড না ঘটে গেল। শিশুটি ক্রোধে রোষে থাবা মেরে অচিনবাবুর হাত থেকে রুটিটা মাটিতে ফেলে দেয়। সাথে সাথে উচ্চৈঃ স্বরে কেঁদে উঠে। অচিনবাবু শিশুটির কাণ্ড দেখে হতভম্ব হয়ে যান। তিনি নির্বাক দৃষ্টিতে শিশুটার দিকে চেয়ে থাকেন। শিশুটি হাত দুটো নেড়ে নেড়ে ডানে বামে কাকে খুঁজে । চোখের জল নাকের পানি এক হয়ে বুকের উপর ঝরছে। সূতায় বাঁধা গলার মাদুলিটা ভিজে গেছে। নির্বাক অচিনবাবু মাটি থেকে রুটিখানি খুঁড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ান। নিরাশ মন নিয়ে তিনি পিছনে সরে আসেন। শিশুটার উপর তার রাগ জমে। পরাভূত মন নিয়ে তিনি গেটের কাছে ফিরে যান। রাস্তার দিকে চোখ রাখতেই দেখতে পান, এক অভাবী মহিলা পানির বোতল হাতে হন্তদন্ত হয়ে গেটের দিকে ছুটে আসছে। তার সামনে দিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে শিশুটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ছেঁড়া আঁচলের মাথায় সন্তানের মুখ মুছাতে থাকে। গালে কয়েকটা স্নেহের চুমু দিতেই শিশুটা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে পরম সুখে কাঁধে মাথা রাখে। কয়েকটা হিক্কা তুলে কান্না থামিয়ে দেয়। ডিসি হিলে নিস্তব্ধতা নেমে আসে।
এতক্ষণে অচিন বাবু শিশুটির কান্নার কারণ খুঁজে পেলেন। তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে ভাবেন, শিশুর শান্তি-সুখের স্বর্গ, নিরাপদ গৃহ, তার মায়ের বুকখানি পেতে এতক্ষণ সে বুক ফাঁটিয়েছে। শিশুরা শুধু খাবারের জন্য কান্না করে না। একটি শীতল বুকের পরশ পেতে বুক ভাঙে। সেই শীতল বুক হলো গর্ভধারিণী মমতাময়ী মায়ের বুক। যার স্পর্শ তার সব ক্ষুধা-তৃষ্ণা মিটিয়ে দেয়। অচিনবাবু আবার শিশুটির কাছে যায়। রুটিখানি মায়ের হাতে দিয়ে বলেন, বাচ্চাকে খেতে দিও।
রাস্তার লাইটগুলো জ্বলে উঠল। অচিনবাবু নিজের পথ ধরেন। তার কানে বাজে বাউলের সেই সুর- এক নাড়িতে বাঁধা দু’জন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছি
পরবর্তী নিবন্ধঅন্তর্বাস এক নিমিষে হয়ে যাও ডেথ এডার