মা-বাবার প্রতি সদাচরণ

মূল : ড. সাউদ ইবনে ইব্রাহীম আশ-শুরায়িম ।। ভাষান্তর : তামিরুল ইসলাম | শুক্রবার , ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

মানুষ হিসেবে আমাদের এমন কিছু দায়িত্ব রয়েছে যা অন্য কোনো প্রাণীর নেই। এটা শুধু দায়িত্ব না বরং কর্তব্যও। যে পালন করেছে সে দায়িত্ব বা কর্তব্যটুকু আদায় করেছে। এতে দায়মুক্তি বা ঋণশোধের কোনো অবকাশ নেই। আর যে এই দায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সে নিজের জন্য ধ্বংসের দোয়ার খুলে দিয়েছে। যে এর পরিপূর্ণ গুরুত্ব দিয়েছে সে নিজের জন্য সফলতার দ্বার উন্মোচন করেছে। তার জীবন সদা রহম ও বরকতময় হবে। আর তার জন্য জান্নাতের একটি দরজা খুলে দেওয়া হবে। এটাই যেনো তার সফলতার দরজা, যে তার প্রবেশের অধিকার নিজেরই উপর ন্যস্ত।
মা-বাবা সন্তানের মুখে হালকা হাসি ফুটাতে কতো যে কসরত করে তা বলার প্রয়োজনীয়তা আমি মনে করছি না। নিজে না খেয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে অথচ সন্তানের খাবারটা ঠিকই হাজির করছে। সেই পুরনো কাপড় আর সবকিছু যেনো তাদের জন্য পুরনোই হয় না। সন্তানের চাওয়া-পাওয়াগুলো তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নিজে কাঠফাটা রোদে কাজ করে আর সন্তানের জন্য একটি ছায়ার ব্যবস্থার কথা চিন্তা করে দিন পার করে। আর সন্তানের প্রতি মায়ের মনের অবস্থা নিয়ে আল্ল্লাহ তায়ালা নিজেই বর্ণনা করেন, এদিকে মুসার মায়ের মন ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল (অর্থাৎ, শিশু মুসার মা যখন জানতে পারলেন তাঁর কলিজার টুকরা শত্রুর হাতেই গিয়ে পড়েছে)। তারপর বাবার চোখে সন্তানের ভালোবাসা নিয়ে কোরআনুল কারিম চমৎকার একটি বর্ণনা দিয়েছে, আর তার চোখ দুটি দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে সাদা হয়ে গিয়েছিল এবং তার হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল (হারিয়ে যাওয়া ইউসুফের খোঁজে)। এসব কিছু মা-বাবার সন্তানের প্রতি আঘাত ভালোবাসার নিদর্শন। (বাবা-মা যখন বার্ধক্যে উপনীত হবে) তখন তাদেরকে উফ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো। আর তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সাথে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত করো এবং দোয়া করো, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে, তেমনি আপনিও রহমতের আচরণ তাদের প্রতি করুন এ ছিলো সন্তানের প্রতি কোরআনের উপদেশ বাণী।
মা-বাবার প্রতি বিনয়ী হলে আল্লাহ তায়ালা আমল কবুল করেন এবং পেরেশানি থেকে মুক্তি দেন। এই বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে অতি কষ্টে গর্ভ ধারণ করেছে এবং অতি কষ্টে তাকে প্রসব করেছে। তাকে গর্ভে ধারণ ও দুধ ছাড়ানোর মেয়াদ হয় ত্রিশ মাস। সে যখন তার পূর্ণ সক্ষমতায় পৌঁছে এবং চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হয়, তখন বলে, হে প্রতিপালক! আমাকে তাওফীক দান করুন, যেন আপনি আমাকে এবং আমার পিতা-মাতাকে যে নিয়ামত দিয়েছেন তার শোকর আদায় করতে পারি এবং এমন সৎকর্ম করতে পারি, যাতে আপনি খুশি হন এবং আমার জন্য আমার সন্তানদেরকেও সেই যোগ্যতা দান করুন। আমি আপনার কাছে তাওবা করছি এবং আমি আনুগত্য প্রকাশকারীদের অন্তর্ভুক্ত। এরাই তারা, আমি যাদের উৎকৃষ্ট কাজসমূহ কবুল করব এবং তাদের মন্দ কাজসমূহ ক্ষমা করব। ফলে তারা জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হবে, তাদেরকে যে সত্য প্রতিশ্রুতি দেওয়া হত তার বদৌলতে (সুরা আল আহকাফ ১৫-১৬)।
ওমর (রা.) একবার হযরত ওয়াইস আল ক্বরনি বিষয়ে বলেন, আমি রাসূলুল্ল্লাহ সা. কে বলতে শুনেছি, তোমাদের নিকট ওয়াইস ইবনে আমের আসবে তাঁর একটা বৃদ্ধ অসুস্থ মা আছে, সে তাঁর মায়ের সেবা করত; আমি আল্ল্লাহর নামে কসম করে বলছি, তোমাদের মাঝ থেকে কেউ যদি তাঁর দেখা পায় সে যেনো নিজের জন্য তাঁর নিকট মাগফিরাতের দোয়া প্রার্থনা করে (মুসলিম শরিফ)। রাসূলুল্ল্লাহ সা. এখানে বুঝাতে চেয়েছেন যে, যারা মা-বাবার সেবা করে তাদের দোয়া আল্ল্লাহ তায়ালা কবুল করেন।
বাবা-মার ভালোবাসার উপর আর কারো ভালোবাসা নেই। তারা তোমাকে নিজের জীবনের চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসে। তুমি যা চাও তা দিতে না পারলেও তাদের যা আছে অন্তত তাদিয়ে তোমাকে খুশি রাখবে। এটা যদি বুঝে থাকো তাহলে শোনো, মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহার এটার একটা ধারাবাহিকতা আছে, তুমি তাদের সাথে যেমন করবে তোমার সন্তানরাও ঠিক তেমন আচরণ করবে। সুতরাং মা-বাবার সেবার ক্ষেত্রে কোনো কার্পণ্যতা করা উচিত না। হযরত উসামা ইবনে যায়েদ রাযি. একবার আস্ত একটি খেজুর গাছ কাটছিলেন, (আরব মরুতে একটি খেজুর গাছের চারা গজিয়ে বড় করা হাজার বছরের ফল দেওয়ার কত কষ্ট তা সবার জানা) সবাই জিজ্ঞেস করছিলো, তুমি এরকম বোকামি কেনো করছো?! হযরত উসামা রযি. বলেন, আমার মা খেজুরের মজ্জা খেতে চেয়েছেন, তাঁর চাওয়ার উপরে দুনিয়াতে আমার আর কিছু নেই। তারপর হযরত সুফিয়ান সাওরি রহ. বলেন, আমি কখনো আমার বাবার সাথে কঠোর আচরণ করিনি। আমাকে তিনি কখনো ডাকলে আমি নফল নামাজে থাকলে নামাজ ভেঙ্গে তাঁর ডাকে সাড়া দিই। হযরত ওমর ইবনে যার রহ. বলেন, যখন তাঁর সন্তান মারা যায় তখন তাকে তাঁর ছেলের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি বলেন, আমার ছেলে দিনে আমার পিছেপিছে হাঁটতো, রাতে আমার সামনে হাঁটতো আর কখন এমন কোনো ছাদে উঠতো না যে ছাদের নিচে আমি আছি। এসব ছিল সাহাবা আর আমাদের পূর্বসূরীদের মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহারের দৃষ্টান্ত। এরপর বর্তমান যুগের চিত্রপট সমপূর্ণ এর বিপরিত। মানুষ মা-বাবাকে বোঝা মনে করে, তাদের সাথে সবধরণের নিকৃষ্ট আচরণ করে। নিজের বন্ধু-বান্ধব বা স্ত্রীদেরকে তাদের চেয়ে বেশ গুরুত্ব দেয়। আমি তোমাদের এগুলো থেকে নিষেধ করছি। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। তারা কি জানেনা এইসব কঠোর আচরণ কতবড় পাপ? কত বড় অন্যায়? এতো মস্তবড় কবিরা গুনাহ। রাসূলু্লল্লাহ সা. এই সমপর্কে বলেন, আমি তোমাদের বলবো সবচেয়ে বড় পাপ কী? এভাবে তিনবার বলেন। তারপর সাহাবা রাযি. বলেন, ইয়া রাসূলাল্ল্লাহ! অবশ্যই। তারপর তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহ হচ্ছে আল্ল্লাহর সাথে শিরিক করা, মা-বাবার সাথে কঠোর আচরণ করা এবং মিথ্যা কথা বলা (বোখারি, মুসলিম)।
সুতরাং এখান থেকে শিক্ষা নিন। মানুষ যেমন আচরণ করে, সে তার প্রতিদানও তেমন পায়। খারাপ আচরণ করলে তাঁর ভবিষ্যতও খারাপ হবে। এরকম হাজারো উদাহরণ ইতিহাস পেশ করেছে। বাবা-মা সন্তানদের সুন্দরভাবে লালন-পালন করেছে, শিক্ষা-দীক্ষাও দিয়েছে। নিজে শীতের রাতে ভেজা জায়গায় শুয়ে সন্তানকে শুকনো ও গরম জায়গায় রেখেছে। সন্তানরা যখনি বিপদে পড়ে বাবা-মা সন্তানের জন্য ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আর এরকম মা-বাবার সাথে অসৎ আচরণ কিভাবে মাপ হবে বলেন? মা-বাবার সাথে দুর্ব্যবহার সমুদ্র পরিমাণ পানি দিয়ে ধোয়ে দিলেও পরিষ্কার হবেনা। আর তাওবা করেও এর ক্ষমা পাওয়া যাবে না। এর একমাত্র উপায় হচ্ছে, মা-বাবার সেবা করা, তাদের দেখাশোনা করা এবং তাদেরকে ভালো আহার পোশাক পরিচ্ছেদ দেওয়া। আর মা-বাবাদের উচিত নিজের সন্তানদের দেখাশোনার ক্ষেত্রেও সাম্যতা বজায় রাখবে। কাউকে বেশি ভালোবাসা বা গুরুত্ব দেয়া বা কাউকে কম এমন যেনো না হয়। যেনো সন্তানরাও মা-বাবাকে সমানভাবে দেখে, ভালো আচরণ সবার কাছ থেকে যেন পায়। তাই সাবধান যেনো কোনো বাবা-মা সন্তান থেকে কোনো খারাপ আচরণ না পায়। কেনো না মা-বাবা সন্তানদের জন্য কখনো বদ দোয়া দেয় না। আর যদি দিয়ে দেয় তাহলে তার জন্য ধ্বংস অবধারিত। আর নিজেকে সাবধানে রাখো যেনো তাদের মুখ থেকে উফ শব্দটি বের হয়ে তোমাদের ধ্বংসের কারণ না হয়। যদি উফ শব্দটি শুনতে ছোট কিন্তু এর বরবাদি পুরা জীবনের সুখ ছিনিয়ে নিবে। হযরত উরুয়াহ ইবনে যুবাইর রযি. বলেন, ‘যে মা-বাবার সাথে চোখ বড় করে কথা বলেছে সেও এই ধ্বংসের সামিল’।
তারপর স্ত্রীরাও যেনো তার স্বামীকে বাবা-মার সাথে ভালো আচরণে সাহায্য করে। যেনো এতে একে অপরের সহায়ক হয়। যারা এরকম বাবা-মার সাথে সদ্ব্যবহারের জন্য নিজের স্বামীকে বা স্বামী নিজের স্ত্রীকে সাহায্য বা সুযোগ করে দেয় না তারা অতিব নিকৃষ্ট জাতি। আল্ল্লাহ তায়ালা সবাইকে আমল করার তাওফিক দিন। আমিন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশেফালী ঘোষ : আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তি শিল্পী
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা