মানুষ বন্ধক রেখে মাদক পাচার

জড়িত ২৪ জনকে খুঁজছে পুলিশ

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ১৬ মার্চ, ২০২২ at ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ

মাদকের চালান যাতে ধরা না পড়ে এবং টাকা মার না যায় সেজন্য মানুষ বন্ধক রেখে চলছে মরণ নেশা আইস ও ইয়াবার পাচার। পাশাপাশি শত্রুতামূলক ভাবে কেউ যেন উল্লেখিত মাদকের চালান ধরিয়ে দিতে না পারে সেজন্য বর্তমানে এ কৌশল অব্যর্থ বলে মনে করছে মূল কারবারিরা। এছাড়া অর্থ সংকটে পড়লেও এমন অভিনব কৌশলে ‘বাকি’তে আইস ও ইয়াবা দিচ্ছে কারবারিরা। গত বছর নভেম্বরে ঢাকার হাতিরঝিল থানার একটি অপহরণ মামলার তদন্তে গিয়ে মানুষ বন্ধক রেখে মাদক পাচারের ঘটনা আলোচনায় আসে। ওই ঘটনার পর দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে আরও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। গ্রেপ্তার করা হয় মানুষ বন্ধক রেখে ইয়াবা বেচাকেনা চক্রের চার সদস্যকে। খোঁজ পেয়েছে এর সাথে জড়িত একটি সংঘবদ্ধ চক্রের। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, মাদকের টাকা পরিশোধ হয়নি, কৌশলে ডেকে নিয়ে আটকে রেখেছে এমন কেস আমরা কয়েকটি পেয়েছি। সমঝোতার ভিত্তিতে মানুষ বন্ধক রেখে ইয়াবা কারবারের বিষয়টি নিয়ে আরও তদন্ত করে দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মাদক কারবারিরা টাকা লেনদেনে এখন বেশি সতর্ক। চট্টগ্রাম নগরীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যাওয়া কারবারিরা নিজেরাই চালান নিয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে ধরা পড়লে মাদকের টাকা পরিশোধ করতে হয় না। মাদকের চালান যাতে ধরিয়ে দিতে না পারে সেজন্য কৌশল হিসেবে কক্সবাজার ও টেকনাফের মূল কারবারিরা ওই কারবারির সহযোগীকে বন্ধক রেখে দেয়। চালান গন্তব্যে পৌঁছলে বা বাকি রেখে যাওয়া টাকা পাঠালে সহযোগীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আবার টেকনাফে মাদকদ্রব্য নিতে আসা কারবারিরা টাকার সংকটে পড়লে তাদের সহযোগীদের বন্ধক রাখে। এটা হয় সমঝোতার ভিত্তিতে। পুলিশ সূত্র জানায়, গত বছর হারুন অর রশিদ নামে এক ব্যক্তি রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ২ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সামির ওরফে লাদেন নামে এক বন্ধুর সঙ্গে সম্রাট ওরফে ফরহাদ কঙবাজার বেড়াতে যান। তারপর থেকেই তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে সাইফুল নামে এক ব্যক্তি তাকে ফোন করে ফরহাদকে অপহরণ করা হয়েছে বলে জানান। জীবিত ফেরত পেতে তারা ফরহাদের বাবার কাছে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দাবি করেন। প্রাথমিকভাবে অপহরণকারীদের বিকাশে ১০ হাজার টাকাও পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে বিষয়টি থানা পুলিশকে জানালে মামলা করতে বলা হয়। মামলার পর থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা বিভাগের তেজগাঁও জোনাল টিমও ছায়া তদন্ত শুরু করে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহাদাত হোসেন বলেন, অপহরণ মামলা তদন্ত করতে গিয়ে তারা তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় কঙবাজারের টেকনাফ থানাধীন সাবরাং এলাকা থেকে গত ২ অক্টোবর ফরহাদকে উদ্ধার করেন। একই সঙ্গে অপহরণকারী চক্রের তিন সদস্য সাব্বির আহমেদ, সাদ্দাম হোসেন ও নুরুল আমিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে ফরহাদকে বন্ধক রেখে লাদেন নামে তার সেই বন্ধু টেকনাফ থেকে ইয়াবা পাচার করেছিল। লাদেনকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, অর্থ সংকটে থাকায় তিনি ফরহাদকে বন্ধক রেখে টেকনাফ থেকে দুই হাজার পিস ইয়াবা এনেছিলেন। ঢাকায় এনে সেসব ইয়াবা বিক্রি করে টাকা দিয়ে ফরহাদকে ছাড়িয়ে আনার কথা ছিল। কিন্তু ইয়াবা বিক্রির টাকা যথাসময়ে হাতে না পাওয়ায় বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। তবে ফরহাদের দাবি তাকে অপহরণ নয় আটকে রাখা হয়েছিল। ২৫ দিন তাকে আটকে রাখা হয় টেকনাফের গহীন এলাকায়।
একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে সাতকানিয়ার এক কিশোরের ক্ষেত্রেও। টেকনাফে মাদকের পাইকারি কারবারির কাছ থেকে বাকিতে ইয়াবা কিনে ‘বন্ধক’ রাখা হয়েছিল কিশোর মিনহাজকে। সাতকানিয়ার ইয়াবা কারবারি আনোয়ার বাকিতে আনা ইয়াবা বিক্রির টাকা শোধ করে ‘বন্ধক’ হিসেবে রাখা কিশোরকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে এমন শর্তে তারই প্রতিবেশী মিনহাজকে রেখে এসেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আনোয়ার প্রতিশ্রুত টাকা শোধ করেননি। আর নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর ১৬ বছর বয়সী মিনহাজেরও এখন আর খোঁজ মিলছে না। ছেলেকে বাঁচাতে মুক্তিপণ হিসেবে ৩২ হাজার টাকা অপহরণকারীদের দেন মা খুরশীদা বেগম। কিন্তু তাতেও মুক্তি মেলেনি মিনহাজের। এ বিষয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হলেও কোনো লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ছেলে অপহরণের ঘটনায় মামলা করেন মিনহাজের মা।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, বন্ধক রেখে মাদক পাচারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে অন্তত দুই ডজন ব্যক্তি। তাদের সবার নামেই অন্তত অর্ধডজন মামলা রয়েছে। তাদের খুঁজছে পুলিশ।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান বলেন, আমরা কিছু জিম্মির ঘটনা পেয়েছি। ইয়াবা বিক্রির পাওনা টাকা আদায় করতে গিয়ে আটকে রাখার ঘটনায় বেশ কিছু লোককে ধরা হয়েছে। ইয়াবা ব্যবসায়ীরা নিত্য-নতুন কৌশলে ব্যবসার চেষ্টা করে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে আসছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
পরবর্তী নিবন্ধকিয়েভে জারি হচ্ছে কারফিউ, ‘সময়টা বিপজ্জনক’