মাদকাসক্তি প্রতিরোধে চাই সামাজিক সচেতনতা

পারভেজ আহমেদ | রবিবার , ২৬ জুন, ২০২২ at ৫:২৫ পূর্বাহ্ণ

সমাজের দুই একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। কিছুদিন পর স্কুল শেষ করবে। এরইমধ্যে ছেলের রাতজাগা, দিনভর ঘুমিয়ে থাকা, খাওয়া-দাওয়ার প্রতি অনীহা, মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক আচরণ, কথায় কথায় পরিবারের সদস্যদের সাথে রাগারাগি করা এগুলো অভিভাবকদেরকে ভাবিয়ে তুললো। বেশ কিছুদিন খেয়াল করার পরে তাঁরা দেখলেন ছেলে লুকিয়ে লুকিয়ে কোনো একটা জিনিস করছে। পিতা মাতা কোনো ভাবে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারছেন না। বেশ অনেকদিন পরে খুব গোপনীয়তার শর্তে পরিচিত দুই একজনের সাথে আলাপ করে বুঝলেন ছেলে কোনো একটা নেশা শুরু করেছে। পিতা-মাতার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এত যত্ন নিয়ে লালন-পালন করা ছেলে নেশা শুরু করেছে এখন কী করা যায়। ঠিক উল্টো দিকের আরেকটা ঘটনা: নিম্নবিত্ত পরিবার।

মা-বাবা দুজনেই চাকরি করেন। ছেলে কোনো রকমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। পরিচিত একজনকে বলে অনেক কষ্টে তাকে একটি ওয়েল্ডিং ওয়ার্কশপ এ চাকরি দেওয়া হয়েছে। মা-বাবা মোটামুটি খুশি। অন্ততপক্ষে ছেলের ইনকাম পরিবারে কিছুটা হলেও স্বচ্ছলতা দেবে। বছর দুয়েক পরে দেখা গেল ছেলে বেতনের টাকা তো দেয় না, উপরন্তু সাপ্তাহিক ছুটির দিন মা-বাবা থেকে টাকা খুঁজে। এক পর্যায়ে ছেলে চাকরিতে যাওয়াটা অনিয়মিত হয়ে গেল, শেষমেষ চাকরিটা চলে গেল।

ইতিমধ্যে পাড়া-প্রতিবেশী ছেলের ব্যাপারে মা-বাবাকে অভিযোগ দেওয়া শুরু করলো, আজকে এর কাছ থেকে ধার করেছে, কালকে ওর কাছ থেকে ধার করেছে আজকে এই বাসার বালটিটা নিয়ে গেছে, কালকে ওই বাসার ডেকছিটা নিয়ে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এলাকার কিছু মুরুব্বীরা বললো ছেলে যে নেশা করছে সেটা নিশ্চিত। এই হচ্ছে মাদকাসক্তির অবস্থা। মাদকাসক্তি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। কী উচ্চবিত্ত বলেন নিম্নবিত্ত বলেন, কিশোর বলেন, যুবক বলেন অথবা বয়স্ক লোক বলেন এদের অধিকাংশই কোনো না কোনো ভাবে মাদক ব্যবহারের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছেন। প্রথমদিকে কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে অথবা কোনো কোনো প্রচলিত ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে যেমন: ইয়াবা খেলে সারারাত জেগে পড়া যায় অথবা অমুক নেশা করলে কিছুটা স্লিম হওয়া যায়, দীর্ঘক্ষণ যৌন মিলন করা যায় এই সমস্ত ভুল ধারণা যুবসমাজকে নেশার দিকে টানছে।

কিন্তু একবার নেশা ধরার পরে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন এবং এই নেশার কবল থেকে সহজে উঠে আসতে পারেন না। সমাজের নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত কেউ এই সমস্যা থেকে বাঁচতে পারছেন না। ক্রমান্বয়ে শহর থেকে গ্রামে এই সমস্যা ছড়িয়ে পড়ছে। আসলে সমস্যাটা আমাদের তথা বাংলাদেশের সৃষ্টি না। সমস্যাটা অনেকটা আন্তর্জাতিক। আমরা চাই বা না চাই মাদকদ্রব্য চোরাচালানের সবচেয়ে একটা বড় রুট হচ্ছে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশ। কেননা আমাদের একদিকে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল (যা বার্মা, থাইল্যান্ড নিয়ে বিস্তৃত) আরেকদিকে গোল্ডেন ক্রিসেন্ট (যা আফগানিস্তান ইরান নিয়ে বিস্তৃত)।

মাদক তৈরীর কারখানা হচ্ছে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল এবং গোল্ডেন ক্রিসেন্ট। যুগে যুগে এই এলাকাগুলোতে মাদকদ্রব্য চাষ করা হচ্ছে, প্রসেস করা হচ্ছে এবং এগুলো বিভিন্ন দেশে পাচার করা হচ্ছে। সারা বিশ্বব্যাপী মাদকদ্রব্যের ব্যবসা হচ্ছে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। এই অবৈধ ব্যবসার সাথে যারা জড়িত তারা রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার এই ব্যবসা থেকে সহজে সরে আসতে পারে না। তাই সরকার বাধা দিলেও তারা যেকোনো মূল্যে মাদকদ্রব্য পাচারের জন্য নতুন নতুন রুট /নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে। আপনি সড়কপথে অবরোধ করলেন তারা নৌপথ বেছে নেয়, ক্ষেত্রবিশেষে তারা গহীন জঙ্গল দিয়ে, পাহাড় দিয়ে হলেও এই মাদকদ্রব্য গুলো পরিবহন করে। এই মাদকদ্রব্য পাচারের জন্য তারা শিশু ও নারীকে ব্যবহার করে। প্রয়োজনে নারীকে গর্ভবতী দেখিয়ে, অনেক সময় পেটের ভিতরে নেশাদ্রব্য ঢুকিয়ে নিয়ে, বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে তারা মাদকদ্রব্য পাচার করে থাকে। বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো এদের বিরুদ্ধে যতই অভিযান চালাক না কেন তারা কিছুদিন বন্ধ রাখলে ও পরবর্তীতে অন্য উপায়ে অন্যদিক দিয়ে আবার শুরু করে। এজন্য পৃথিবীর কোনো দেশেই মাদককে পুরোপুরি নির্মূল করা যায় না। যার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখনো মাদকদ্রব্য অন্যতম একটা সমস্যা। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য যা করা যায় তা হলো মাদকদ্রব্যের পাচার নিয়ন্ত্রণ করা অর্থাৎ হ্রাস করা।
সাধারণত প্রত্যেক দেশের সরকার তিনটি কৌশল এর ভিত্তিতে কাজ করে। তা হলো মাদকদ্রব্যের পাচার নিয়ন্ত্রণ করা, মাদক দ্রব্যের চাহিদা হ্রাস করা এবং মাদকদ্রব্যের ক্ষতি হ্রাস করা।

মাদকদ্রব্যের পাচার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকারি সংস্থা যেমন আমাদের দেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে এটা কে নিয়ন্ত্রণ করেন। চাহিদা এবং ক্ষতি হ্রাস করার ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কিছুটা ভূমিকা থাকলেও এই ক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করাটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সমাজের সর্বস্তরের মানুষগুলোকে এই প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে, সমাজকে মাদকের ক্ষতিকর দিক গুলো জানানোর মাধ্যমে চাহিদা হ্রাস করা যেতে পারে এবং ক্ষতি হ্রাস করা যেতে পারে।

অতএব আমরা যারা সাধারণ মানুষ আমরা সমাজ থেকে মাদকদ্রব্য নির্মূল করবো এই অবাস্তব চিন্তা না করে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে মাদকদ্রব্যের বিস্তার রোধ করতে পারি। সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সিভিল সোসাইটিকে নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা, প্রত্যেকটি ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মাধ্যমে শিক্ষকমণ্ডলী, মসজিদের ইমাম সাহেব, এলাকার মুরব্বিদের নিয়ে উঠান বৈঠকের আয়োজন করা, স্কুল-কলেজে নিয়মিত সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করা যেতে পারে। আসুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তুলি।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা আর্ক ফাউন্ডেশন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএসো বৃষ্টিতে, এসো সৃষ্টিতে
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে