মাতৃমৃত্যুর দুই প্রধান কারণ খিঁচুনি ও রক্তক্ষরণ

চমেক হাসপাতাল গাইনি বিভাগের তথ্য প্রসবকালীন ঝুঁকি এড়াতে যা করতে হবে

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২৬ জুন, ২০২২ at ৫:৩৩ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বছরে ৩৭ লাখের বেশি শিশু জন্ম নেয়। আর সন্তান জন্মদান করতে গিয়ে এখনো প্রতি এক লাখের মধ্যে ১৬৫ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। যদিও ১৯৯০ সালে মাতৃমৃত্যুর এই হার ছিল ৫৭৪। প্রতি দশকে এই হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ২০০১ সালে ৩৮৪ এবং ২০১৫ সালে প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ১৭৬। সর্বশেষ ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী- এই সময়ে সন্তান জম্মদান করতে গিয়ে প্রতি এক লাখের মধ্যে ১৬৫ জন মায়ের/প্রসূতির মৃত্যু হচ্ছে বাংলাদেশে।

চিকিৎসকদের মতে, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে কোনো নারীর প্রাণহানি ঘটলে তা মাতৃমৃত্যু বলে বিবেচিত হয়। গর্ভধারণজনিত জটিলতা, প্রসবকালে এবং প্রসব-পরবর্তী ৪৫ দিনের মধ্যে কোনো মায়ের প্রাণহানি ঘটলে তা মাতৃমৃত্যু হিসেবে ধরা হয়। আর এক লাখ গর্ভধারণে নারী মৃত্যুর সংখ্যাকে মাতৃমৃত্যুর হার হিসেবে গণ্য করা হয়।

তথ্য বলছে, মাতৃমৃত্যুর হারে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশ কিছু কারণে দেশে মাতৃমৃত্যু কমেছে। বিশেষ করে নারীর শিক্ষায় দেশ এগিয়েছে। তাতে সচেতনতাও বেড়েছে। এছাড়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার আওতাও দিন দিন বেড়েছে। এর আওতায় প্রসব-পূর্ব, প্রসবকালীন এবং প্রসব-পরবর্তী সেবার পরিধি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন ও দাতা সংস্থা, এনজিওসহ বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান/সংগঠন মাতৃমৃত্যু হার কমাতে কাজ করছে। এসব কিছু মাতৃমৃত্যু কমাতে ভূমিকা রেখেছে।

তবে এরপরও প্রতি এক লাখে ১৬৫ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে দেশে। প্রসবকালীন খিঁচুনি ও প্রসবজনিত রক্তক্ষরণই মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের গাইনী বিভাগের গত এক বছরে (২০২১ সালের) মাতৃমৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনায় এ তথ্য পাওয়া গেছে।

গাইনী বিভাগের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১ সালে চমেক হাসপাতালের গাইনী বিভাগে প্রসবজনিত কারণে মোট ৬৭ জন মায়ের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ জন মায়ের মৃত্যু হয়েছে খিঁচুনির কারণে। শতকরা হিসেবে এটি সর্বোচ্চ ৪৪ শতাংশ। এরপরই বেশি সংখ্যক মায়ের (১৬ জনের) মৃত্যু হয়েছে প্রসবজনিত রক্তক্ষরণে। শতকরা হিসেবে এটি ২৩ শতাংশ। এছাড়া প্রসবজনিত সংক্রমণে মৃত্যু হয়েছে ১৪ শতাংশের (৭ জন)।

খিঁচুনি, রক্তক্ষরণ ও সংক্রমণের কারণেই বেশি সংখ্যক মাতৃমৃত্যু হচ্ছে জানিয়ে চমেক হাসপাতালের গাইনী বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার আজাদীকে বলেন, প্রসবকালীন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে প্রসূতির খিঁচুনি দেখা দিতে পারে। আর খিঁচুনি উঠে গেলে প্রসূতির মৃত্যু ঝুঁকিও বাড়ে। বিশেষ করে প্রসবের আগে খিঁচুনিতে বেশি সংখ্যক মায়ের মৃত্যু ঘটে। এর বাইরে প্রসবজনিত রক্তক্ষরণ ও সংক্রমণের কারণেও প্রসূতির মৃত্যু হতে পারে। মা ও নবজাতকের মৃত্যু ঝুঁকি কমাতে নির্ধারিত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রসব করানো খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে হলে গর্ভধারণ পূর্ববর্তী সেবা, গর্ভকালীন সেবা, প্রসবকালীন সেবা এবং প্রসব পরবর্তী সেবার ওপর জোর দেয়ার কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. সাহেনা আক্তার।

একজন মায়ের প্রসব পরবর্তী সেবাও গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে চমেক হাসপাতালের গাইনী বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডা. কামরুন্নেছা রুনা বলেন, প্রসব পরবর্তী সময়েও মায়ের নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে প্রসব পরবর্তী ৬ সপ্তাহ সময়কালে রক্তক্ষরণ, জরায়ুতে সংক্রমণের মতো জটিলতাগুলো প্রসূতি মাকে মৃত্যু ঝুঁকিতে ঠেলে দেয়। এছাড়াও মূত্রাশয়, শ্বাসনালীর সংক্রমণ, রক্ত নালীতে রক্ত জমাট বাঁধা, মানসিক বিষন্নতা ইত্যাদি জটিলতাও দেখা দিতে পারে। তাই প্রসব পরবর্তী সেবাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রসব করানোর পরামর্শ দিয়ে এই দুই গাইনী চিকিৎসক বলছেন, প্রসবকালীন একজন প্রসূতির বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন বিলম্বিত প্রসব, বাঁধাগ্রস্ত প্রসব। এসব জটিলতা জরায়ু ফেটে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এছাড়াও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণসহ আরো নানা জটিলতা বাড়িতে সন্তান প্রসবের কারণেই হয়ে থাকে। ইউনিসেফের এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, কোনো চিকিৎসক বা দক্ষ ধাত্রী ছাড়া বাড়িতে প্রসবের কারণেই অধিকাংশ প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হয়।

এজন্য নির্ধারিত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রসব করানো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রসব করানো হলে প্রসূতি মা ও শিশু উভয়ের মৃত্যু ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। প্রসবকালীন বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিলেও চিকিৎসক দ্রুত চিকিৎসার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু বাসা-বাড়িতে হলে এটি সম্ভব হয় না। জটিলতা দেখা দিলে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিতে অনেক দেরি হয়ে যায়। এতে করে মা ও শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ে। তাই প্রসূতিকে অবশ্যই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে প্রসব করানোর পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার ও অধ্যাপক ডা. কামরুন্নেছা রুনা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের পর সবচেয়ে আনন্দের দিন : তথ্যমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধপদ্মা সেতু চালু হওয়ায় খুশি বিশ্বব্যাংক