মাতারবাড়ি গভীর সুমদ্রবন্দরের ডিজাইন তৈরির কাজ শুরু

২০২৬ সালে বন্দর নির্মাণ কাজ শেষ করার আশা বন্দরের সাথে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের বৈঠক ১৫ নভেম্বর

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ৬ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের ডিজাইন তৈরির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। জাইকার অনুমোদনের পর বিদেশী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গত ২ নভেম্বর থেকে এই কার্যক্রম শুরু করেছে। আগামী দুই সপ্তাহ প্রধানমন্ত্রীর ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পটি নিয়ে বিভিন্ন সমীক্ষা পরিচালনার পর ১৫ নভেম্বর পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে বৈঠক করবেন। একই দিনে প্রকল্পের ব্যাপারে চট্টগ্রামের গণমাধ্যম কর্মীদেরও অবহিত করার কথা রয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরুর মাধ্যমে বহুল প্রত্যাশার মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কার্যক্রম অনেকদূর অগ্রসর হলো বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম বন্দরের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড’ (সিপিজিসিবিএল) কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে ৩০ হাজার কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে ৬শ’ মেগাওয়াট করে মোট ১২শ’ মেগাওয়াটের দুইটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রকল্পটির বেশির ভাগ অর্থই প্রদান করছে জাপানের জাইকা। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে আমদানিকৃত কয়লা খালাসের জন্য বন্দরের একটি অবকাঠামোও গড়ে তুলছে তারা। এর অংশ হিসেবে টার্মিনাল, জেটি, কয়লা খালাস ও মজুতের ব্যবস্থা, সমুদ্র থেকে ওই টার্মিনাল পর্যন্ত কয়লাবাহী জাহাজ চলাচলের জন্য জন্য ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১৮ মিটার ড্রাফটের ২৫০ মিটার প্রস্থ একটি একটি চ্যানেল (খাল) খনন করা হচ্ছে। বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জেটি পর্যন্ত ১৪.৩ কিলোমিটার চ্যানেল খনন করতে গিয়ে জাইকার বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরা আবিষ্কার করেন, বাংলাদেশ চাইলেই অনায়াসে এখানে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করতে পারে। জাইকার শীর্ষ কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন। তারা বন্দর কর্মকর্তাদের বলেন, কয়লা খালাসের জন্য চ্যানেল খনন করার পাশাপাশি বাড়তি কিছু পদক্ষেপ নিলেই একটি বাণিজ্যিক বন্দর নির্মাণ করাও সম্ভব। যেখানে ১৬ মিটার ড্রাফটের জাহাজ অনায়াসে ভিড়ানো যাবে।
জাইকার প্রস্তাবনা চট্টগ্রাম বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মুগ্ধ করে। তারা বিষয়টি নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ করেন। সেখানে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার পর নতুন করে পরিকল্পনা গ্রহণের কার্যক্রম শুরু হয়। এর অংশ হিসেবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনে যা যা করা হচ্ছে তার সাথে মাতারবাড়ি এবং ধলঘাট মৌজার ১০৮০ একর ভূমি নিয়ে নতুন বন্দর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। জাইকা এই বন্দরের জন্যও প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে রাজি হয়। কয়লা খালাসের জন্য আড়াইশ মিটার প্রস্থ যে চ্যানেল গড়ে তোলা হচ্ছে তাকে আরো একশ’ মিটার বাড়িয়ে সাড়ে তিনশ’ মিটার করা হচ্ছে। কয়লা খালাসের চ্যানেল তৈরির জন্য মাতারবাড়িতে সমুদ্রে ব্রেকওয়াটার নির্মাণ করা হয়েছে। এরসাথে বাণিজ্যিক বন্দরের কার্যক্রম নির্ঝঞ্জাট করতে ৩৯৭ মিটার বাড়তি ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করার প্রয়োজন হবে।
‘মাতারবাড়ি পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ নামের এই প্রকল্পটি দেশের গভীর সমুদ্রবন্দরের ঘাটতি মেটাবে উল্লেখ করে সূত্র বলছে, ১৪ মিটারের বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানো যায় এমন বন্দরকেই গভীর সমুদ্রবন্দর বলা হয়। সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের আওতায় এই প্রকল্পের কার্যক্রম চলছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্ল্যানিং এন্ড এডমিন) মোহাম্মদ জাফর আলমকে এই প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সরকার আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে এই প্রকল্পের জন্য জাপানের নিপ্পন কোয়ে এবং দেশিয় ডিডিসি নামের একটি যৌথ কোম্পানিকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তির পর জাইকার অনুমোদনের একটি ব্যাপার ছিল। গত ১ নভেম্বর জাইকার অনুমোদন পাওয়ার পর ২ নভেম্বর থেকেই বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের যাবতীয় ডিজাইন তৈরির ব্যাপারে কার্যক্রম শুরু করে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান শুধু প্রকল্পের ডিজাইনই নয়; ব্যয় নির্ধারণ, টেন্ডার ডকুমেন্টস তৈরি এবং অবকাঠামোগত নির্মাণসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করবে। টেন্ডার প্রক্রিয়া এবং নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিয়োগের পর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কার্যক্রমও মনিটরিং এবং তদারকি করবে। পরবর্তীতে ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ থেকে শুরু করে বন্দর চালু করে দেয়ার বিষয়টি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানই সমন্বয় করবে। বন্দর চালু হওয়ার এক বছর পর পর্যন্ত এই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় সব ধরনের সাপোর্ট দিয়ে থাকবে। এজন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটিকে ২৩৪ কোটি টাকা প্রদান করা হবে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ভার মেটানোর জন্য শূন্য দশমিক এক শতাংশ সুদে যাবতীয় অর্থ জাপানের জাইকা প্রদান করছে। জাইকার এই ঋণ দশ বছর পর থেকে বিশ বছরের কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের অফিস স্থাপনসহ যাবতীয় সহায়তা বন্দর কর্তৃপক্ষ করে দিচ্ছে। আগামী ১৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে বৈঠক করে প্রকল্পটির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করবেন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরা। একই দিন বিকেলে চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের সামনেও প্রকল্পটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হবে।
‘মাতারবাড়ি পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ এর পরিচালক এবং চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (প্ল্যানিং এন্ড এডমিন) মোহাম্মদ জাফর আলম গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরু হয়েছে। গত ২ নভেম্বর থেকেই তারা কার্যক্রম শুরু করেছে। এটি এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে বিরাট অগ্রগতি বলেও তিনি উল্লেখ করেন। জাফর আলম বলেন, সরকারের ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ভবিষ্যতের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। জাইকা এই প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তাদের অনুমোদনটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গত ১ নভেম্বর এই অনুমোদন পাওয়ার পরই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
উল্লেখ্য, মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণ প্রকল্পের মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এরমধ্যে জাইকার ঋণ (প্রকল্প সাহায্য) ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। সরকারি তহবিল থেকে ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৫ লাখ টাকার যোগান দেবে। ২০২২ সালের জুন থেকেই বন্দর নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হবে। আগামী ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ের কার্যক্রম সম্পন্ন হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাত্র ৬ ভোট দূরে বাইডেন
পরবর্তী নিবন্ধসুদীপ্ত হত্যার আসামির ওপর হামলা : ৮ জন কারাগারে