মাতামুহুরী নিয়ে অধীর অপেক্ষা

খননে জাইকার আগ্রহ, আশায় চকরিয়া-পেকুয়াবাসী

চকরিয়া প্রতিনিধি | শনিবার , ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৮:১২ পূর্বাহ্ণ

প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে লাগাতার দুদিন ভারী বর্ষণ হলেই মাতামুহুরী নদীর তীরবর্তী কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। একই সাথে উজানেও যদি ভারী বর্ষণ হয়, তাহলে যোগ হয় ভোগান্তির নতুন মাত্রা। ভয়াবহ বন্যা লণ্ডভণ্ড করে দেয় চকরিয়ার জনপদ। এতে প্রতি বন্যায় কম করে হলেও শত কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়।

 

শুধুমাত্র এই অবস্থা অব্যাহতভাবে চলে আসছে মাতামুহুরী নদীর তলদেশ একেবারে ভরাট হয়ে যাওয়াসহ নদীর দুই তীরের ভয়াবহ ভাঙনের কারণে। বর্তমানে নদীর অন্তত শতাধিক স্থানে জেগে উঠেছে ভরাটচর।

চকরিয়া উপজেলা প্রশাসনের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র নিরূপণ অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০১৫ সালে ১৫ দিনের ব্যবধানে পর পর চারবার ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। এতে বিগত ৪০ বছরের ইতিহাসের রেকর্ড ভঙ্গ করে চার দফা বন্যায় চকরিয়া উপজেলার অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন এবং পৌরসভার একাংশের গ্রামীণ জনপদে বাড়ির চালা পর্যন্ত ডুবে থাকায় একনাগাড়ে ১৫ দিনের বেশি সময় ধরে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটের মধ্যে পড়েছিল এখানকার মানুষ।

স্মরণকালের সেই লাগাতার ভয়াবহ বন্যায় ভুক্তভোগী মানুষের বসতবাড়ি বিলীন হওয়া ছাড়াও কৃষি, মৎস্য, গ্রামীণ অবকাঠামো, সড়কমহাসড়কসহ বিভিন্ন দপ্তরের অন্তত ২০০০ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়। এছাড়া গত ১৫ বছরে অন্তত ১০ হাজার বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলিন হয়েছে বন্যা ও ভাঙনের কবলে পড়ে।

সূত্র অনুযায়ী, এর এক বছর পর অর্থাৎ ২০১৭ সালেও ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয় চকরিয়ায়। সেই বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০১৫ সালের তুলনায় কম হলেও দুর্ভোগ পিছু ছাড়েনি চকরিয়াপেকুয়ার মানুষদের। একইভাবে প্রতি বছর বর্ষায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে সবকিছুই চুরমার করে দিচ্ছে তাদের। বিপরীতে চকরিয়াকে বন্যামুক্ত রাখতে এখনো কোনো টেকসই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে।

পার্বত্য অববাহিকার ১৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মাতামুহুরী নদীর তলদেশ খননসহ দুই তীর টেকসইভাবে সংরক্ষণের কাজ নিজেদের খরচে সম্পন্ন করে দেওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা)

সাম্প্রতিক সময়ে জাইকার এই প্রস্তাবনার বিষয়টি দৈনিক আজাদীকে সবিস্তারে তুলে ধরা হলে আশার সঞ্চার হয় চকরিয়ার মানুষের মধ্যে। একইসাথে জাইকার প্রস্তাবটি গ্রহণ করার জন্য জাতীয় সংসদেও উত্থাপন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য জাফর আলম। এই অবস্থায় মাতামুহুরী নদীর শাসন প্রক্রিয়া কবে শুরু হচ্ছে, সেই অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে রয়েছেন এখানকার মানুষ।

এই প্রসঙ্গে চট্টগ্রামস্থ চকরিয়া সমিতির প্রধান উপদেষ্টা ও মাতামুহুরী নদীতীরের বাসিন্দা চকরিয়ার কাকারার বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন কন্ট্রাক্টর দৈনিক আজাদীকে বলেন, জাইকার প্রস্তাবটি গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

প্রস্তাবটি গ্রহণের মধ্য দিয়ে যদি মাতামুহুরী নদী শাসন হয়ে যায়, তাহলে শতবছরের দুঃখ ঘুচবে এখানকার মানুষের। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে মানুষকে আর হারাতে হবে না ভিটেবাড়ি, সহায়সম্পদ। একইসাথে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে কৃষিক্ষেত্রেও।

এই বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড কঙবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাঈফ আহমেদ আজাদীকে বলেন, জাইকার প্রস্তাবটি কোনোভাবে হাতছাড়া করার মতো নয়। যেহেতু জাইকা নিজেদের খরচে এই বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে, তাই সেটি সরকার গ্রহণ করতে পারে। এ নিয়ে ঊর্ধ্বতন মহলে আলোচনা চলছে।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেন, ২০১৫ সালের সেই ভয়াবহ বন্যার পর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ৫ লাখ মানুষকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে বিশেষ বরাদ্দ দাবি করে ১৩ দফা প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছিল সরকারের কাছে। সেই প্রস্তাবনার অন্যতম ছিল মাতামুহুরী নদীর দুই তীর সংরক্ষণ এবং পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং।

কিন্তু সেই ১৩ দফা প্রস্তাবনার একটিও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি নানা কারণে। এতে ভয়াবহ বন্যায় সবকিছু চুরমার করে দিচ্ছে। তাই জাইকার প্রস্তাবে যাতে সাড়া দেওয়া সংক্রান্তে ঊর্ধতন মহলে আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে।

কঙবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান সম্প্রতি চকরিয়ার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সেই সভাতেও মাতামুহুরী নদীর খনন ও দুই তীর সংরক্ষণের বিষয়ে জোরালো দাবি উঠে। তখন জেলা প্রশাসক আশ্বস্ত করেন বিষয়টি নিয়ে তিনি কাজ শুরু করবেন, যাতে চকরিয়াবাসীর দীর্ঘদিনের এই দাবি পূরণ হয়।

এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কঙবাজার১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, সময় অপচয় না করে জাইকার প্রস্তাবে দ্রুত সাড়া দিতে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে সংসদেও তুলেছি বিষয়টি।

আশা করছি এই বিষয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ত্বড়িৎ পদক্ষেপ নেবে। আর মাতামুহুরী নদী শাসন হলে গেলে প্রতি বছর বর্ষায় আর বন্যার মুখোমুখি হতে হবে না চকরিয়াপেকুয়াবাসীকে। এতে প্রতি বর্ষায় হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা পাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদম ফুরিয়ে এখন হাঁটার পথ ধরেছে বিএনপি : তথ্যমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা