মাক্বামে মাহমুদ : বিশ্বনবীর শ্রেষ্ঠত্ব এবং তাঁর উম্মতেরও শ্রেষ্ঠত্ব

ফখরুল ইসলাম নোমানী | শুক্রবার , ২১ জানুয়ারি, ২০২২ at ১১:২৮ অপরাহ্ণ

যাবতীয় প্রশংসা কেবলই আল্লাহ তাআলার যিনি সমগ্র জগতের মালিক ও রব। আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর, যিনি সমস্ত নবীগণের সরদার ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। আরও নাযিল হোক তার পরিবার-পরিজন ও সমগ্র সাথী-সঙ্গীদের ওপর।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কিয়ামতের বিভীষিকাময় মুহূর্তে তাঁর প্রিয় রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘শাফায়াত’ করার জন্য অনুমতি দিবেন। অনুমতি পেয়ে রাসুল (সা.) তাঁর প্রিয় উম্মতদের জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য মহান জাতেপাক পরম দয়ালু আল্লাহর নিকট শাফায়াত করবেন। মুফাসসিরগণের মতে-যে স্থানে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর উম্মাতদের জন্য ‘শাফায়াত’ করবেন ঐ-স্থানকে ‘মাক্বামে মাহমুদ’ বলে। কিয়ামত ময়দানে হিসাব নিকাশের প্রাক্কালে আল্লাহপাকের ‘আরশ কুরসি’ সংলগ্ন কিংবা ‘আরশ’ সংলগ্ন বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের স্থান হলো ‘মাক্বামে মাহমুদ’।
অতি সম্মানীয় স্থান ‘মাক্বামে মাহমুদ’ লাভের সৌভাগ্য কেবল সাইয়েদুল মুরসালীন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরই হবে। অন্য কোনো নবী রাসুল এ স্থান লাভ করবেন না। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এটি বিশ্বনবীর শ্রেষ্ঠত্ব এবং তাঁর উম্মাতেরও শ্রেষ্ঠত্ব।
কুরআন মাজীদে মাক্বামে মাহমুদ প্রসঙ্গ: পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহপাক ‘মাক্বামে মাহমুদ’ প্রসঙ্গে বলেন, ‘রাত্রির কিছু অংশ কোরআন পাঠসহ জাগ্রত থাকুন। এটা আপনার জন্যে অতিরিক্ত। হয়ত বা আপনার পালনকর্তা আপনাকে মোকামে মাহমুদে পৌঁছাবেন। (সুরা বনী ইসরাঈল : আয়াত : ৭৯)। এ আয়াতস্থিত ‘মাক্বামে মাহমুদ’ই কিয়ামত ময়দানের ‘শাফায়াতের’ স্থান। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লাহ ইবনে জারীর বলেন, ‘অধিকাংশ আহলে তাবীলের মতে ‘মাক্বামে মাহমুদ’ হলো যেস্থানে দাঁড়িয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের দিন মানবজাতির জন্য ‘শাফায়াত’ করবেন। শাফায়াতের উদ্দেশ্য হল বিভীষিকাময় ভয়াবহতা থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করা, আযাবের কষ্ট থেকে প্রশান্তি দেয়া। (তাফসীরে তাবারী)।
মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আশ শাওক্বানী (রহ.) বলেন, ‘সুরা বনী ইসরাঈলের ৭৯ নং আয়াতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাকামে মাহমুদের ওয়াদা দেয়া হয়েছে। মাকামে মাহমুদ শব্দদ্বয়ের অর্থ, প্রশংসনীয় স্থান। এই মাকাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যেই, বিশেষভাবে নির্দিষ্ট অন্য কোনো নবীর জন্যে নয়। এর তাফসীর প্রসঙ্গে বিভিন্ন উক্তি বর্ণিত আছে। সহীহ হাদীস সমূহে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে যে, এ হচ্ছে ‘বড় শাফাআতের মাকাম’। (ফাতহুল কাদীর)।
হাদীস শরীফে মাক্বামে মাহমুদ প্রসঙ্গ: সহীহুল বুখারীতে এসেছে, ‘হাশরের ময়দানে যখন সমগ্র মানব জাতি একত্রিত হবে এবং প্রত্যেক নবীর কাছেই শাফয়াতের দরখাস্ত করবে, তখন সব নবীই শাফায়াত করতে অপারগতা প্রকাশ করবেন। তখন কেবল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাই সমগ্র মানবজাতির জন্যে শাফায়াত করবেন। এ সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ কিয়ামতের দিন লোকেরা দলে দলে বিভক্ত হবে। প্রত্যেক উম্মত তার নিজের নবীর কাছে যাবে। তারা বলবে, হে অমুক (নবী)! আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য শাফায়াত করুন। হে অমুক (নবী)!! আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য শাফায়াত করুন। (কিন্তু তারা কেউ শাফায়াত করতে রাযী হবেন না)। শেষ পর্যন্ত শাফায়াতের দায়িত্ব এসে পড়বে নবী (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর উপর। আর এই দিনেই আল্লাহ তাকে মাকামে মাহমুদে দাঁড় করবেন।’ (সহীহুল বুখারী: হাদিস: ৪৭১৮)।
হযরত কাব বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কিয়ামতের ময়দানে সকল মানুষ পুনরুত্থিত হবে আমি এবং আমার উম্মত একটি ঊঁচু জায়গায় দাঁড়াব। আমার রব আমাকে সবুজ পোশাকে সজ্জিত করবেন, অতঃপর তিনি আমাকে অনুমতি দিবেন, আমি তাঁর ইচ্ছায় কথা বলবো। আর ঐ স্থান হলো মাক্বামে মাহমুদ। (মুসনাদে আহমদ: ৪৫৬/৩, মাজমাউজ যাওয়ায়েদ: ৫৪/৭)।
তাফসির এর মাক্বামে মাহমুদ প্রসঙ্গ: আলোচ্য আয়াতে নবী করিম (সা.)-কে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতে বলা হয়েছে। রাতের শেষভাগে ঘুম থেকে উঠে যে নামাজ আদায় করা হয়, তাকে তাহাজ্জুদের নামাজ বলা হয়। আয়াতে আরো বলা হয়েছে, তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করলে মহান আল্লাহ মহানবী (সা.)-কে মাকামে মাহমুদ তথা মর্যাদার উচ্চ স্তরে সমাসীন করবেন। এ আয়াতের অধীনে তাফসিরবিদ ইবনে জারির (রহ.) লিখেছেন, মাকামে মাহমুদের ব্যাখ্যায় তাফসিরবিদদের মধ্যে মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়। বেশির ভাগ তাফসিরবিদের মতে, মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন মহানবী (সা.)-কে উম্মতের জন্য সুপারিশ করার সুযোগ দেবেন। ইসলামের পরিভাষায় এটাকে শাফাআত বলা হয়। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.)-এর কাছে মাকামে মাহমুদের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন, এটি হলো শাফাআত। (তিরমিজি, হাদিস : ৩১৩৭)।
আরবি অভিধানবিদ ইবনুল আসির ‘আন-নিহায়া’ গ্রন্থে লিখেছেন, হাদিসের মধ্যে দুনিয়া ও আখিরাত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শাফাআত শব্দটি বারবার আলোচিত হয়েছে। এর অর্থ অন্যায় ও অপরাধ থেকে পরিত্রাণের ব্যাপারে আবেদন-নিবেদন করা। ইসলামী আকিদা-বিশ্বাস মতে, শাফাআত বা সুপারিশের পূর্ণ মালিকানা আল্লাহর। ইরশাদ হয়েছে, ‘বলে দাও, সব শাফাআত আল্লাহর ক্ষমতাধীন’। (সুরা : জুমার, আয়াত : ৪৪)
তবে কোরআন ও হাদিস থেকে জানা যায়, মহানবী (সা.) ও তাঁর উম্মতের বিশেষ ব্যক্তিদের শাফাআত বা সুপারিশ করার বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হবে। এ ধরনের শাফাআতের দুটি শর্ত আছে-
এক. আল্লাহর পক্ষ থেকে শাফাআতকারীর জন্য শাফাআত করার অনুমতি থাকতে হবে। যেমন-মহান আল্লাহ বলেন, ‘কে আছে এমন, যে তাঁর (আল্লাহর) কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া শাফাআত করবে?’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৫৫)
দুই. যার জন্য শাফাআত করা হবে তার ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা শুধু তাদের জন্য সুপারিশ করে, যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ২৮)
মাক্বামে মাহমুদ ও শাফায়াত : আল্লাহর অনুমতিতে মহানবী (সা.) কিয়ামতের দিন শাফাআত করবেন। বিষয়টি একাধিক হাদিসে এসেছে। আদম বিন আলী (রহ.) বলেন, আমি ইবনে ওমর (রা.)-কে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন সব মানুষ নিজ নিজ নবী-রাসুলের পেছনে পেছনে দলে দলে চলতে থাকবে। তারা বলতে থাকবে, ‘হে নবী, আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। হে নবী, আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন’। এভাবে বলতে বলতে শাফাআত বা সুপারিশের দাবি মহানবী (সা.) পর্যন্ত পৌঁছবে। তিনি যে সুপারিশের ক্ষমতা পাবেন, এটাই ‘মাক্বামে মাহমুদ’। মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন মহানবী (সা.)-কে তা দান করবেন। (বুখারি, হাদিস : ৪৪৪১)। এটি বিশ্বনবীর শ্রেষ্ঠত্ব এবং তাঁর উম্মাতেরও শ্রেষ্ঠত্ব।
সুপারিশের অধিকার: এখানে শাফায়াত বা সুপারিশের অর্থ হলো বৃহত্তর সুপারিশ-যা করতে বড় বড় রাসুলরাও অপারগতা প্রকাশ করবেন। নতুবা সব নবী-রাসুল ও মুমিনদের বিশেষ শ্রেণিকে আল্লাহ কিয়ামতের দিন সুপারিশের অধিকার দেবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) কিয়ামত দিবসে সমগ্র সৃষ্টির জন্য সুপারিশ করবেন এবং এ কাজের মাধ্যমে তিনি প্রতিশ্রুত ‘মাকামে মাহমুদ’ (সম্মানিত স্থান) অর্জন করবেন। অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক নবীর জন্য বিশেষ একটি দোয়ার অধিকার আছে, যা কবুল করা হবে। প্রত্যেক নবীই তাঁর দোয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করেছেন (দুনিয়াতেই তা চেয়েছেন)। আর আমি আমার সে দোয়া কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের শাফায়াতের জন্য মুলতবি রেখেছি। আমার উম্মতের যে ব্যক্তি শিরক না করে মারা যাবে, ইনশাআল্লাহ ! সে তা লাভ করবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৩০৪)
অন্য হাদিসে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমি আদম সন্তানদের নেতা হব এবং তাতে অহংকারের কিছু নেই। আমিই প্রথম ব্যক্তি হব, কিয়ামতের দিনে যার কবর উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে এবং তাতে অহংকারের কিছু নেই। আর আমিই সর্বপ্রথম সুপারিশকারী এবং আমিই প্রথম ব্যক্তি, যার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। তাতে আমি অহংকার করি না। আর কিয়ামতের দিন আল্লাহর প্রশংসার পতাকা আমার হাতে থাকবে। আর এ নিয়ে আমি অহংকার করি না।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪৩০৮)
পরিশেষে: আল্লাহপাক আমাদেরকে সুন্নাতে রাসুলের অনুসরণ করে তাঁর প্রিয় রাসুল (সা.) এর শাফায়াত লাভ করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহ আমাদের সকলকে রাসূল (সা.) এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠানোর তৌফিক দিন। সকলেই পড়ি, ‘আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মদ, ওয়ালা আলেহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া সাল্লাম।”
লেখক : হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস, এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅধ্যক্ষ আল্লামা মুসলেহ উদ্দিন স্মরণে
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা