মহাপ্রাণ মহীয়সী নেলী সেনগুপ্তা : বিদেশিনীর ভালোবাসা

ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া | সোমবার , ১৫ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:২১ পূর্বাহ্ণ


এই উপমহাদেশে যুগল রাজনীতিবিদদের সংখ্যা খুব বেশী নয়। যুগল রাজনীতিবিদ বলতে জীবিত অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর রাজনীতি করা। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই রাজনীতি করার ক্ষেত্রে স্বামী রাজনীতি করেন স্ত্রী গৃহবধূ। আবার দেখা যায় স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন। ভারতে রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর সোনিয়া গান্ধী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। অন্যদিকে ফিরোজ গান্ধী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না কিন্তু মিসেস ইন্দিরা গান্ধী রাজনীতি করে গেছেন। আমাদের দেশেও জিয়াউর রহমান রাজনীতি করেছেন কিন্তু তাঁর মৃত্যুর খালেদা জিয়া রাজনীতিতে এসেছেন। প্রখ্যাত পরমানু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া রাজনীতি করেননি তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতিকে ধারণ করতেন। তাঁর বেঁচে থাকা অবস্থায় আমাদের প্রিয়নেত্রী দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিপূর্ণভাবে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ছাত্রাবস্থায় শেখ হাসিনার রাজনীতিতে হাতেখড়ি।
শ্রীলংকার বন্দরনায়েক যুগল জীবিত অবস্থায় রাজনীতি করেছেন। দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ও তাঁর বিদেশিনী সহধর্মিনী মহাপ্রাণা মহীয়সী নেলী সেনগুপ্তা হলেন যুগল রাজনীতিবিদ। আমাদের প্রিয় নেতা চট্টল শার্দুল আলহাজ্ব এ.বি.এম মহিউদ্দীন চৌধুরী ও তাঁর সহধর্মিনী হাসিনা মহিউদ্দিন চট্টগ্রামের যুগল রাজনীতিবিদ।
অনেক বিদেশিনী ভারতবর্ষকে ভালোবেসে ভারতে মানবসেবা করেছেন। তন্মধ্যে মাদার তেরেসা, ভগিনী নিবেদিতা, এ্যানি বেশান্ত অন্যতম। নেলী সেনগুপ্তের প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী বলেছেন, “Srimati Nelli Sen-Gupta belongs to the select band of foreigners who made India their home and faught selflessly for the cause of India freedom by her siugle-minded service and sacrifice she won the affections of the people of India- and of BangladeshÓ (Nelie Sengupta Memorial Souvenir,1975).
বিশিষ্ট লেখক সাহিত্যিক শচীন্দ্র নাথ গুহ লিখেছেন “ইংরেজ কবলিত ভারতের মুক্তি সংগ্রামে নেলী সেনগুপ্তার অবদান ছিল ঐতিহ্যময়। তিনি ইংরেজ শাসকবর্গের অত্যাচার, অবিচার ও হুমকীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছেন তীব্র প্রতিবাদ। বিদেশিনী হয়েও এ-দেশকে আপন মাতৃভূমিরূপে গ্রহণ করে বীরাগ্রগণ্য স্বামী যতীন্দ্রমোহনের নিত্য সঙ্গিনী হয়ে শুধু যে স্বাধীনতা-সংগ্রামে বীরাঙ্গনার ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, তা নয়। ভারতীয় জাতীয় মহাসমিতির এক অতি সংকটময় ক্ষণে পুলিশ-মিলিটারীর সন্ত্রাসময় দৌরাত্ম্য উপেক্ষা করে তিনি সভানেত্রীর সুকঠিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সেদিন থেকে শ্রীযুক্তা সেনগুপ্তা ভারত বরেণ্যা”। (তথ্যসূত্র: মহাপ্রাণা নেলী সেনগুপ্তা স্মরণে চট্টগ্রাম পরিষদ স্মরণিকা ১৯৭৫)।
মহিয়সী নারী নেলী সেনগুপ্তার আন্দোলন সংগ্রাম ছিল স্বজাতির বিরুদ্ধে। সাধারণত এ ধরণের ঘটনা ইতিহাসে বিরল। নেলী সেনগুপ্তা ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ শায়ারে ১৮৮৬ সালের ১২ই জানুয়ারি জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। পিতার নাম উইলিয়াম ফ্রেড্রিক গ্রে এবং মাতা এডিথ হেনরিয়েটা গ্রে। নেলী সেনগুপ্তার ইংলিশ নাম ছিল ছিল এডিথ এলেন গ্রে।
যথীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ছিলেণ কংগ্রেস নেতা যাত্রা মোহন সেনগুপ্ত ও বিনোদিনী সেনগুপ্তের সন্তান। ১৮৮৫ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি বীর চট্টলার চন্দনাইশ উপজেলার বরমা গ্রামের ধনাঢ্য পরিবারে তাঁর জন্ম। পরিণত বয়সে পড়ালেখার জন্য কোলকাতার অভিজাত কলেজ প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। পুত্রকে আইন পেশায় ব্যারিস্টার হবার জন্য তখন ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেন ১৯০৪ সালে অর্থাৎ প্রায় ঊনিষ বৎসর বয়সে। কেমব্রিজ ডাউনিং কলেজ থেকে গ্রেজুয়েশন, এলএলবি, বার-এট-ল করেন। ইংল্যান্ড বারের সদস্য হন। এই সময়ের মধ্যে নেলী সেনগুপ্তার সঙ্গে পরিচয়, বন্ধুত্ব গড়ে উঠা, বন্ধু থেকে প্রেম এবং প্রেম থেকে পরিণয়। উভয় পক্ষের পিতা-মাতা মেনে না নিলেও পরে মেনে নেন। ১৯০৯ সালে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে চট্টগ্রাম পৌঁছলে বরমা নিজ গ্রামে ঘটা করে বিয়ে হলে পরিবারের আদরনীয় বিদেশী বউ হিসেবে আন্তরিকতার ছোঁয়ায় মুগ্ধ হন নেলী সেনগুপ্তা।
এখানে কংগ্রেস নেতা যাত্রামোহন সেনগুপ্ত সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন মনে করি না হলে অসম্পূর্ণ থেকে যেতে পারে। পিতা ছিলেন কবিরাজ। তিনি কোলকাতায় একটি মিশন স্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন সময়ে এলএলবি করেন এবং চট্টগ্রাম জেলা বারে সদস্য হয়ে আইন পেশায় নিয়োজিত হন এবং রাজনীতিতে ভারতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। একজন স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ। যাত্রামোহন সেনগুপ্ত শ্বশুরের নামে জামালখান এলাকায় ডা. খাস্তগীর সরকারী গার্লস হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্কুল থেকেই আমার সহধর্মিনী প্রফেসর প্রীতিকণা বড়ুয়া গার্হস্থ্য বিজ্ঞানে লেটার সহ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন ১৯৫৯ সালে। যাত্রামোহন সেনগুপ্ত বরমায় পিতা-মাতার নামে বরমা ত্রাহিসেন-মেনকা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। স্ত্রী বিনোদিনীর নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি ব্রাহ্ম মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান রহমতগঞ্জে যে জে.এম সেন হল আছে তার প্রতিষ্ঠাতা তিনি নিজেই। সেটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৯৫ সালে। তিনি চট্টগ্রাম বঙ্গীয় প্রাদেশিক সাহিত্য সম্মেলনে আয়োজন করেন যার সভাপতি ছিলেন অক্ষয় চন্দ্র সরকার।
সুযোগ্য পিতার সুযোগ্য সন্তান ব্যারিস্টার যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত কোলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশা শুরুর জন্য বিদেশিনী স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তাকে নিয়ে ১৯১০ সালেই কোলকাতা চলে আসেন। ১৯১১ যতীন্দ্র মোহন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সেই সময় তিনি রিপন আইন কলেজে আইনের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত ভারতীয় কংগ্রেসের বেঙ্গল প্রদেশ কংগ্রেসের সম্মেলনে যোগ দিয়ে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। প্রদেশ কংগ্রেসের পরবর্তী সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য চট্টগ্রামের নাম প্রস্তাব করেন তিনি। ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করেন ১৯১৯ সালে। অসুস্থ পিতা যাত্রামোহন সেনগুপ্তের (সভাপতি) পক্ষে সভাপতির বক্তব্য উপস্থাপন করেন। আইনজীবি যাত্রামোহন সেনগুপ্ত ১৯১৯ সালে পরলোক গমন করেন।
এই প্রেক্ষিতে বলা প্রয়োজন সেই সময় বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন দান বাঁধতে শুরু করেছে। বৃটিশের অত্যাচারে ভারতবাসী অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। বিষয়টি নেলী সেনগুপ্তার কাছে স্পষ্ট হলেও তিনি নিজে ইংরেজ রমনী হয়েও স্বজাতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। ১৯২০ সালে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে সারা ভারতবর্ষ উত্তাল হয়ে উঠে। সে সময় খাদি কাপড় পরার আন্দোলনে নেলী সেনগুপ্তা সম্পৃক্ত হন।
১৯২১ সালটা স্বামী-স্ত্রীর জীবনে স্মরণীয় বৎসর। কোলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশা চালিয়ে যাবার সময় ব্যারিস্টার যতীন্দ্র সেনগুপ্ত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ (সি.আর.দাশ) এর সংস্পর্শে আসেন এবং প্রভাবান্বিত হন। দেশবন্ধুর স্বরাজ পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। আইন পেশা ছেড়ে দিয়ে যতীন্দ্র মোহন পরিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক জগতে প্রবেশ করেন। আসহযোগ আন্দোলনে চট্টগ্রামে নেতৃত্ব দেন। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ যোগেশ চন্দ্র দে লিখেছেন, “সাংসারিক স্বচ্ছলতা ও ঐশ্বর্যের সূচনা হতে না হতেই দেশের ডাক অন্তঃকর্ণ দিয়ে শুনতে পেলেন যতীন্দ্র মোহন। আত্মত্যাগের দুর্বার প্রেরণা যাঁর মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত এমন মানুষের কাছে সাংসারিক সমৃদ্ধি উপক্ষোর বিষয়। উপলক্ষ্য জাতীয় ঘটনা পরস্পর এর মধ্যেই তাঁর সম্ভাবনাময় জীবনের ইঙ্গিত বহন করে আনল। বার্মা অয়েল কোম্পানীর শ্রমিক ধর্মঘট, আসামে চা বাগানে অমানুষিক কুলিনির্যাতনের প্রতিক্রিয়া, আসামবঙ্গ রেলওয়ে কর্মী ধর্মঘট পরপর এই গণবিক্ষোভের ফলে সংশ্লিষ্ট অগণিত কর্মচ্যুত ও আশ্রয়চ্যুত নরনারী চাঁদপুরে এক অবর্ণনীয় অসহায় অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল। পরদুঃখ কাতর যতীন্দ্রমোহন দেশের দুর্গত মানুষের দুঃখে বিচলিত হয়ে আপনার উজ্জ্বল ভবিষ্যত পরিত্যাগ করে তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। সুদীর্ঘকাল ধরে নিজের সমস্ত অর্থ ও ভিক্ষালব্দ অর্থ, সামর্থ ও মূল্যবান সময় ব্যয় করে এই সফল ধর্মঘটের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ইনিই ভারতে সর্বপ্রথম Glorious Pioneer হিসাবে শ্রমিক-কর্মী-ধর্মঘটের সফল প্রবক্তা। তাঁরই নেতৃত্বে ভারতে সর্বপ্রথম বিদেশী শাসকের রুদ্র শাসনের বিরুদ্ধে গান্ধীজি প্রবর্তিত আইন-অমান্য-আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। তাঁর অনন্যসাধারণ নেতৃত্বের পরিচয় পেয়ে গুজরাটের হরিজন-বান্ধব মহাত্মা চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের প্রতিনিধি পুরুষ প্রবরের সেবাশক্তি ও অহিংসাশক্তিতে বিস্ময় মেনে বলেছিলেন, “ Chittagong to the fore” এবং “ Chittagong speaks”. (তথ্যসূত্র: মহাপ্রাণ নেলী সেনগুপ্তা স্মরণে চট্টগ্রাম পরিষদ স্মরণিকা, পৃষ্ঠা- ৬৬, ১৯৭৫ইং)। (চলবে)
লেখক: একুশে পদক প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, চ.বি. পদার্থবিদ্যা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকোভিড পরবর্তী ডিজেলের দাম বৃদ্ধি যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা
পরবর্তী নিবন্ধদেয়াল কেটে ব্যাংকে ঢুকে ভল্ট লুটের চেষ্টা, গ্রেপ্তার ৩