মহান শিক্ষা দিবস

এ. কে. এম. আবু বকর চৌধুরী | শুক্রবার , ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:২৭ পূর্বাহ্ণ

আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে স্বাধীনতা যুদ্ধ ’৭১ পর্যন্ত দীর্ঘ দুটি যুগে সংগ্রামমুখর দিনগুলির একটি হল ১৯৬২ এর ১৭ সেপ্টেম্বর তথা মহান শিক্ষা দিবস। এই মহান দিবস উপলক্ষে আমার এই স্মৃতিচারণটি উৎসর্গ করছি শহীদ বাবুল, মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহর চিরঞ্জীব আত্মার প্রতি।
পাকিস্তানে প্রথম সংবিধান পেতে সময় লেগেছে দীর্ঘ নয় বছর (১৪ আগস্ট ’৪৭ – ২৩ মার্চ ’৫৬) আর সুষ্ঠু জাতি গঠনে মৌলিক উপাদানগুলির অন্যতম একটি শিক্ষা নীতির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে একটি যুগ (২৬ আগস্ট ’৫৯) তাও আবার বৈষম্যমূলক, বিতর্কিত ও বিদ্বেষপূর্ণ যা ইতিহাসে কুখ্যাত শরীফ শিক্ষা কমিশন ’৫৯ নামে খ্যাত। এ রিপোর্টটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, শিক্ষাক্ষেত্রে বাঙালি জাতিকে পঙ্গু করে দেয়াই ছিল এর মূল লক্ষ্য : (ক) শিক্ষাখাতে ব্যয়কে শিল্পে মূলধন বিনিয়োগের দৃষ্টিতে দেখার সুপারিশ করে কমিশন শিক্ষা সস্তায় পাওয়া সম্ভব নয় বলে অভিমত ব্যক্ত করে অবৈতনিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে সরকারী অর্থের পরিবর্তে জনগণের অর্থ বিনিয়োগের জোর দেয়া হয়, (খ) শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ভাষার প্রশ্ন জটিলতা সৃষ্টি করে পূর্বাঞ্চলে বাংলার সাথে উর্দুকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসাবে গণ্য করে উর্দু ভাষায় ব্যাপক বিস্তৃতি ও উন্নয়নের জন্য উর্দু উন্নয়ন বোর্ড গঠনসহ রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ও উর্দুর সংমিশ্রণে এক নতুন বর্ণমালা উদ্ভাবনের সুপারিশ করে। এমনকি বাংলা বর্ণমালা সংস্কারসহ উর্দু ও বাংলার জন্য একটি রোমান বর্ণমালা সৃষ্টিরত কথাও বলে, (গ) ৬ষ্ঠ শ্র্রেণি হতে ডিগ্রী পর্যন্ত ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক ভাষা, (ঘ) এস.এস.সি পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণদের জন্য পরবর্তী শিক্ষার দ্বার রুদ্ধকরণ, দু বছরের ডিগ্রি কোর্সকে তিন বছরে বৃদ্ধি করার এক অবৈজ্ঞানিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। এমনকি বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বিভাগে পাঠ্যসূচির অবৈজ্ঞানিক সুলভ ও স্কুলসমূহের কারিকুলাম অযৌক্তিকভাবে রদবদলের এক ভৌতিক সুপারিশ করে।
এই বিমাতাসুলভ শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আমাদের ছাত্র সমাজ দ্রুতগতিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে। ছাত্র সমাজ এই শিক্ষানীতি প্রত্যাখ্যান করে তা বাতিলের দাবী জানায়। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদদের দ্বারা একটি বেসরকারি বিকল্প রিপোর্ট প্রণয়ন করে সরকারের কাছে উত্থাপন করলে তা সরকার গ্রহণ করেনি। প্রতিবাদ মুখর হওয়াতে ঢাকা কলেজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
৬২-র ৮ জানুয়ারি ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীরা শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল করে অনতিবিলম্বে তা বাতিলের দাবী জানায়। পুলিশ বাধা দেয় ও লাটিচার্জ করে কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে।
রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার অভিযোগে ৬২-র ৩০ জানুয়ারি করাচি ‘লাখাম হাউজ’ হতে গণতন্ত্রের মানসপুত্র অবিভক্ত বাংলার সর্বশেষ (২৪ এপ্রিল’ ৪৬-১৪ আগস্ট ’৪৭) ও পাকিস্তানের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী (৬ সেপ্টেম্বর ৫৬-১৪ অক্টোবর ’৫৭) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধর্মঘট ও সামরিক আইন অমান্য করে রাজপথে মিছিল বের করলে পুলিশ লাটিচার্জ-টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে বহু ছাত্রকে গ্রেফতার করে। ৭ ফেব্রুয়ারি কার্জন হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী (৫৮-৬২) মনজুর কাদের (ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী ৬৮-৬৯) ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে এলে ছাত্র সমাজ কর্তৃক বাধাগ্রস্ত ও চরমভাবে লাঞ্ছিতসহ তার গায়ে থু থু ছিটিয়ে দেয় ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক মাসের জন্য বন্ধ ঘোষণা। ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২৯ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। বন্দী ছাত্রদের নিঃশর্ত মুক্তি, হুলিয়া প্রত্যাহার, পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন, বাক স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়। সকল বন্দী রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের মুক্তিদান, বাংলা হরফের রদবদলের বন্ধের দাবী জানিয়ে ছাত্র সমাজ সরকারকে ৭ দিনের চরমপত্র ৩১মে বিশ্ববিদ্যালয় পুনঃ বন্ধ ঘোষণা করে। মে’র প্রথম সপ্তাহের মধ্যে আটককৃত ছাত্রদের মুক্তি দেয়া হয়। ছাত্র সমাজের দাবী পূরণে স্বৈরাচার সরকারের অনীহার প্রতিবাদে ১৬ আগস্ট সমগ্র দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয় এবং ২৮ তারিখ পর্যন্ত ধর্মঘট ও মিছিল অব্যাহত থাকে।
দেশব্যাপী এই শিক্ষা আন্দোলনকে গতিময় করে তুলতে ৬২-র ২ আগস্ট তৎকালীন ডাকসুর সহ-সভাপতি শ্যামা প্রসাদ ঘোষ (ধলঘাট, পটিয়া, চট্টগ্রাম নিবাসী) ও জি.এস. এনায়েতুর রহমানসহ ছাত্রলীগের শেখ ফজলুল হক মনি (শহীদ ’৭৫), কে.এম ওবায়দুর রহমান (সাবেক মন্ত্রী ৭৮-৮১/প্রতিমন্ত্রী জুলাই ’৭৩ – ৭ নভেম্বর ’৭৫), সিরাজুল আলম খান (দাদা ভাই খ্যাত), অবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়নের মুহাম্মদ ফরহাদ, বেগম মতিয়া চৌধুরী (মন্ত্রী ৯৬ – ০১ ও ০৯-১৮ / বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য), কাজী জাফর আহমদ (প্রধানমন্ত্রী আগস্ট ’৮৯ – ৩ ডিসেম্বর ’৯০ / মন্ত্রী ’৭৮ ও ৮৫ – ৮৯), ও রাশেদ খান মেমন (মন্ত্রী ২০০৯-১৮) এন.এস.এফের (ব্যারিস্টার) আবুল হাসনাত (চীফ হুইপ ৭৯-৮১/মন্ত্রী ৮১-৮২), আনোয়ার আনসারী খান ও মাহবুবুল হক দুলন (৬৯-র ১১ দফা আন্দোলনে অন্যতম নেতা) এবং ছাত্রশক্তির রেজাউল হক সরকার ও মিজানুর রহমান শেলীর (মন্ত্রী ৮৪-৮৭) নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদ ১১ দফা দাবী সম্বিলিত এক চরমপত্র পেশ করে ১৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তা মেনে নেয়ার সময় বেঁধে দেয়, কিন্তু পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুল কাদের চৌধুরী (১৩ জুন ৬২ – ২৯ নভেম্বর ’৬৩) দাবী সমূহকে অযৌক্তিকবলে প্রত্যাখ্যান করে ১০ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করে এবং ১১ সেপ্টেম্বর সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে সম্মিলিত বিরোধী জোটের নেতা হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবীর প্রতি সমর্থন করে তা মেনে নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে অন্যথা এর পরিণতি কঠোর হবে বলে হুঁশিয়ারী জ্ঞাপন করেন (দৈনিক আজাদ ও দৈনিক ইত্তেফাক ১১ সেপ্টেম্বর ’৬২)।
৬২-র শিক্ষা আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দাবীসমূহ হল : ১) শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিল, (২) ৩ বছরের পাস ডিগ্রি কোর্সকে ২ বছর করা, ৩) দ্বাদশ শ্রেণি প্রবর্তন বন্ধকরণ, ৪) বর্ধিত ছাত্র বেতন ও পাঠ্য পুস্তকের মূল্য হ্রাস, ৫) কলা ও বিজ্ঞান বিভাগ হতে যথাক্রমে বিজ্ঞান ও কলা বিষয় বাদ দেয়া, ৬) দ্বাদশ শ্রেণির ৭টি ইংরেজি বইয়ের স্থলে ২টি করা ৭) উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগকে ডিগ্রী কলেজের সাথে পুনঃ একত্রীভূতকরণ, ৮) জনগণের গড়পড়তা আয় অনুপাতে শিক্ষার ব্যয় হ্রাস করা, ৯) বন্দী ছাত্রদের মুক্তিসহ হুলিয়া ও বহিস্কারাদেশসহ রুজুকৃত মিথ্যা মামলাসমূহ অবিলম্বে প্রত্যাহার করা, ১০) কলেজ শিক্ষকদের মর্যাদা সি.এস.পি অফিসার পদের সমমর্যাদাকরণ ও বেতন-ভাতা বৃদ্ধিকরণ এবং ১১) পূর্ব পাকিস্তানে প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ দূর করে অবিলম্বে জনসংখ্যা ভিত্তিতে ন্যায্য অধিকার দেয়া।
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে জেলাসমূহে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, চট্টগ্রামে অবশ্য স্কুল সমূহের সমন্বয়ে সর্বদলীয় মাধ্যমিক স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদও গঠিত হয়। ১২ আগস্ট চট্টগ্রাম নৈশ কলেজের জি.এস. ছাত্রলীগ নেতা এম.এ. মান্নানের (মন্ত্রী ৯৬-০১/এমপি ৭৩-৭৫ ও ৯৬-০১) সভাপতিত্বে জে.এম. সেন হলে এক বিশাল ছাত্র কর্মী সমাবেশ হয়। এতে ছাত্রলীগের এম.এ. মান্নানকে আহ্বায়ক, ছাত্রশক্তির মুহাম্মদ হোসেন খান (অধ্যক্ষ) ও হারুন-উর-রশীদ খানকে (এমপি ৮৮-৯০) যুগ্ম আহ্বায়ক এবং ছাত্রলীগের আবদুর রউফ খালেদ, আবু সালেহ (এম.এন.এ ৭০-৭১/গণ পরিষদ সদস্য ৪ এপ্রিল – ১৬ ডিসেম্বর ’৭২), আবুল কালাম আজাদ, ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ছাত্র ইউনিয়নের কাজী জাফরুল ইসলাম, আ.ম.ম. শহীদউল্লাহ, নজরুল ইসলাম চৌধুরী, মাহবুবুল আলম তারা, এন.এস.এফের কাজী এ.কে.এম. নজরুল ইসলাম ও ডা. আবু খালেদ আকরাম এবং ছাত্র শক্তির মুহাম্মদ মহসীন (কানা মহসিন খ্যাত) ও নুরুল ইসলাম (ছ-ছ নুরুল ইসলাম খ্যাত) প্রমুখকে সদস্য করে জেলা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্র ইউনিয়নের নজরুল ইসলাম চৌধুরী বাঁশী ও ছাত্রলীগের সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সহোদর বড় ও মেজ ভাই (এরা আমার একমাত্র ফুফাত বোনের সন্তান)। এতে অবশ্য সকল কলেজের ভিপি, জি-এস-দেরও সদস্য করা হয়। তখন চট্টগ্রাম শহরে চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি বাণিজ্য কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ ও নাইট কলেজ ছিল।
১ সেপ্টেম্বর জে.এম. সেন হলে জে এম. সেন হাই স্কুলের ছাত্রলীগ নেতা নুরুন্নবী চৌধুরীর সভাপতিত্বে স্কুল সমূহের সকল ছাত্রদলের সমন্বয়ে এক বিরাট সমাবেশে নুরুন্নবী চৌধুরীকে আহ্বায়ক, কাজেম আলী হাইস্কুলের এন.এস.এফ-র এ.কে.এম. আবু বকর চৌধুরীকে সদস্য-সচিব করে মুসলিম হাইস্কুলের ছাত্রলীগ নেতা শহীদ ’৭১ আবদুর রব, কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র শক্তির নেতা শামসুল আলম চৌধুরী (নদীয়া কি-পাড় খ্যাত), মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা জাহাঙ্গীর আলম, এমই স্কুলের ছাত্রলীগ নেতা ফজলুল হকসহ সকল স্কুলের ভিপি ও জিএসদের সমন্বয়ে চট্টগ্রাম জেলা মাধ্যমিক স্কুল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
৮সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামের স্কুলসমূহের ধর্মঘট পালন এবং বিকেলে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ও মাধ্যমিক স্কুল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যৌথ উদ্যোগে জে.এম.সেন হলে এক বিরাট ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। জেলা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক এম.এ মান্নানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কেন্দ্রীয়ভাবে ঘোষিত ১৭ সেপ্টেম্বর হরতালকে সাফল্যমণ্ডিত করার অঙ্গীকার করা হয় এবং এ সভায় মাধ্যমিক স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ হতে এবং আহ্বায়ন নুরুন্নবী চৌধুরী, সদস্য সচিব এ কে এম আবু বকর চৌধুরী (এই নিবন্ধকার), শহীদ ’৭১ আবদুর রব, নদীয়া কি পাড় খ্যাত সামসুল আলম চৌধুরী (বোয়ালখালী), জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে জেলা কমিটিতে সদস্য হিসেবে কো-অপট্‌্‌ করা হয়। ১১ দফার সাথে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরী কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবী সংযোজিত হয়।
১৭ সেপ্টেম্বর এই দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে সমগ্র দেশে এক ঐতিহাসিক হরতাল পালিত হয়। একে ভেঙ্গে দেয়ার হীন লক্ষ্যে সরকারের সকল পর্যায়সহ সরকারি দল কনভেনশন মুসলিম লীগ নেতা-কর্মীদের সকল প্রকারের প্রচেষ্টা চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়। স্কুল-কলেজের ক্লাসসমূহের দরজা খুলেনি, শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বদলে রাজপথ দখল করে নেয় সকল প্রকারের যানবাহন চলাচল স্বতঃস্ফূর্ত বন্ধ ছিল, আদালত-ব্যাংক কার্যক্রম ও এক প্রকার অচল ছিল। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ অন্যান্য শহরগুলিতে ছাত্র সমাজের মিছিলের পর মিছিল প্রকম্পিত হয়ে উঠে। পুলিশের গুলিতে ঢাকায় সচিবালয়ের পার্শ্ববর্তী সড়ক আবদুল গণি রোডে বাবুল-মোস্তফা-ওয়াজিউল্লাহ নিহত হয়ে মহান একুশের শহীদ, সালাম-জব্বার-বরকত সালাউদ্দিন প্রমুখদের সাথে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের দ্বিতীয় রক্তাক্ত ইতিহাস ১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবসকে মহীয়ান করে তুলে।
সরকার শেষ পর্যন্ত সংগ্রামী ছাত্র সমাজের মোকাবেলায় পুলিশের পাশাপাশি ইপিআর বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে ব্যর্থ হয়ে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামায়। লাটিচার্জ-কাঁদুনে গ্যাস-গুলির বিনিময়ে ও বিক্ষুদ্ধ ছাত্র জনতাকে রুখতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে স্বৈরাচার আইয়ুব সরকার।
এদিন চট্টগ্রামের স্টেশন রোড, কোতোয়ালী থানা এলাকা, লালদিঘির মাঠসহ পার্শ্ববর্তী সড়ক, কে.সি. দে সড়ক, রাইফেল ক্লাবের সম্মুখস্থ বক্সিরহাট পুলিশবিট, তৎকালীন চট্টগ্রাম পৌরসভার সম্মুখভাগ পর্যন্ত সড়ক ছাত্র-জনতার সাথে পুলিশ-ইপিআর বাহিনীর বারবার সংঘর্ষ হয়। লাটিচার্জ আর কাঁদুনে গ্যাসের মোকাবেলা হয় ইটপাটকেল দিয়ে প্রশাসনের মূল লক্ষ্য লালদিঘীর মাঠের যেন আমাদের দখলে না যায় এবং শেষ পর্যন্ত তাদের ঘন ঘন আক্রমণে আমরা শেষ বেলার দিকে জে.এম.সেন হল চত্বর দখল করতে সক্ষম হই এবং এম.এ. মান্নানের সভাপতি এক বিশাল ছাত্র-জনতার সমাবেশে এ.এম.এম শহীদুল্লাহ, মোহাম্মদ হোসেন খান, হারুন-উর-রশীদ খান, মাহবুবুল আলম তারা, এ.কে.এম. আবু বকর চৌধুরী প্রমখুরা বক্ততা করি এবং কেন্দ্রের নির্দেশানুযায়ী পরবর্তী তিনদিনব্যাপী শোক দিবস পালনের কর্মসূচি ঘোষণা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর এক অবর্ণনীয় শোক মিছিল বের হয়। মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, এম.ই. স্কুল, কাজেম আলী হাইস্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বিশাল মিছিল ডাঃ খাস্তগীর সরকারি বালিকা স্কুলের মূল ফটকের সামনে এলে পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুল কাদের চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ কন্যা জোবায়দা মুনওয়ার বেবী ফটক দিয়ে বের হয়ে মিছিলে মিশে যায় (সে তখন এই বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল)। আমরা হতবাক হলেও আনন্দিত হয়েছি। মিছিল যখন সিটি কলেজে পৌঁছে তখন সিটি কলেজ, মুসলিম হাই স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল, নন্দনকানন অপর্ণা চরণ বালিকা বিদ্যালয়, মিউনিসিপ্যাল স্কুল ও জেএমসেন স্কুলের শিক্ষার্থীতে পূর্ণ হয়ে যায়। এম.এ. মান্নানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বিশাল সমাবেশে আমরা অনেকে বক্তৃতা করি। ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার আবদুল গণি রোডে পুলিশের গুলিতে বাবুল-মোস্তফা-ওয়াহিদুল্লাহ নিহত, আহত ২৫০জন ও ২৫৩ জনকে গ্রেফতার করে। চট্টগ্রামেও ৩০০ ছাত্র-জনতাকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং পুলিশ ইপিআর সাথে সংঘর্ষে ১২৭ জন ছাত্র আহত হয়।
১৯ সেপ্টেম্বর সরকার এক প্রেস নোটে দুঃখ প্রকাশ করে নিহতদের ক্ষতিপূরণ দেয়া, গুলি বর্ষণের কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি ও ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোন মামলা দেয়া হবে না ঘোষণা দেয়ায় ২২ তারিখ আহুত ছাত্র ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হলেও এদিন সরকার হাটে ছাত্রদের এক মিছিলেন পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে ১৮ সেপ্টেম্বর ধর্মঘটের কর্মসূচি দেয়ায় সরকার গুলি বর্ষণের তদন্তের আশ্বাস দিলে তা প্রত্যাহার করা হয়।
সরকারের স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের ফলে ৬২ তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ৬০ দিন ক্লাসসমূহ চালু ছিল, স্বৈরাচারমূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশে বেশ কয়েকবার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়ায় এবং আমাদের ধর্মঘটের কারণহেতু দশমাস বিশ্ববিদ্যালয় অচল ছিল।
শেষ পর্যন্ত বাংলার ছাত্রসমাজের আন্দোলনের চাপের কাছে নত স্বীকার করে করাচিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ফজলুল কাদের চৌধুরী শরীফ শিক্ষা কমিশনের কার্যকারিতা স্থগিত ঘোষণা করে তিন বছরের ডিগ্রি কোর্সকে ২ বছরের ফিরে দেয়ার কথা বলেন। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস যে, হামদুর রহমান (নোয়ালখালী) বাঙালি হয়েও বাঙালিদের কল্যাণ চিন্তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। অবশ্য এই ব্যর্থতার জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন। পরবর্তীতে বিচারপতি হামদুর রহমান পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি (১৯৭০-৭২) হয়েছিলেন, এমনকি তারই নেতৃত্বে ৭১-র স্বাধীনতা যুদ্ধে শক্তিশালী হানাদার বাহিনীর চরম লজ্জাস্কর পরাজয়ের জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট (২০ ডিসেম্বর ৭১-২৬ মার্চ ৭৩) ও প্রধানমন্ত্রী (২৬ মার্চ ৭৩-৭৭) জুলফিকার ভুট্টো এক ভৌতিক কমিশন গঠন করে সব দোষ বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলো।
আজকের এই মহান শিক্ষা দিবসে ছয় দশক পূর্বে যারা এই মহান দিবসটি রচনা করেছিলেন, বন্দী হয়েছিলেন, নির্যাতন ভোগ এবং জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাদেরকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করছি :তারা গেয়েছে তাদেরই গান-/ দুহাতে করে গেছে তাদেরই দান/ যুগে যুগে নাহি তার পরিমাণ।
লেখক : জীবন সদস্য, বাংলা একাডেমি, সাবেক দফতর সম্পাদক (১৯৮৪-৮৬) – চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ; সাবেক প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি (১৯৭২-৯০) –
শেখ মুজিব গণপাঠাগার (গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম), কলামিস্ট।

“আগের দিনে শিক্ষা ছিল পাকা, ভবন ছিল কাঁচা। আর এখন ভবন হলো পাকা, শিক্ষাটা কাঁচা।”
—অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধবান্দরবানে জীপের চাপায় প্রবাসীর স্ত্রীর মৃত্যু