মঈন উদ্দীন খান বাদল : বাংলার ‘রাজনীতির বিদ্রোহী কবি’

এডভোকেট সেলিম চৌধুরী | শুক্রবার , ৬ নভেম্বর, ২০২০ at ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ

গণমানুষের অধিকার আদায়ে সোচ্চার কন্ঠে স্পর্ধিত উচ্চারণ ‘আই উইল গো আউট ফ্রম দ্যা পার্লামেন্ট’। বুক ফুলিয়ে, আঙুল উঁচিয়ে মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে এ কথা গুলো বলেছিলেন চট্টগ্রাম ৮ আসনের প্রয়াত সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মঈন উদ্দীন খান বাদল। তিনি কালুরঘাট রেল কাম সড়ক সেতুর নির্মাণের দাবিতে ২০১৯ সালের শুরুতে মহান জাতীয় সংসদের একাদশ অধিবেশন চলাকালীন পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বলেন, আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে যদি কালুরঘাট সেতু নির্মাণে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি না হয় ‘আই উইল গো আউট ফ্রম দ্যা পার্লামেন্ট’।
হ্যাঁ সত্যিই তিনি তাঁর কথা রেখেছেন, ডিসেম্বরে আর তাঁকে পার্লামেন্টে যেতে হয়নি, তাঁর আগেই ৭ নভেম্বর ১৯ চলে গেলেন না ফেরার দেশে, চির বিদায় নিলেন পার্লামেন্ট থেকে, চির বিদায় নিলেন দুনিয়া থেকে। ২০০৮ সালে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় লাভ করে তিনিই সর্বপ্রথম জাতীয় সংসদে আনুষ্ঠানিক ভাবে কর্ণফুলী নদীর উপর কালুরঘাট সেতু নির্মাণের গুরুত্ব ও দাবি তুলেন মহান জাতীয় সংসদে, এরপর থেকে এ সেতু নির্মাণের দাবিতে কখনো রাজপথে, কখনো সংসদে সবখানেই সোচ্চার ছিলেন তিনি। যার প্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাদলের স্বপ্নের কালুরঘাট সেতু নির্মাণের নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন, এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ এবছরের ৭ অক্টোবর রেলপথ মন্ত্রী এডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন কালুরঘাট সেতু পরিদর্শনে এসে উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত সভায় বলেন– এ অঞ্চলের প্রয়াত সাংসদ মঈন উদ্দীন খান বাদলের প্রস্তাবিত কালুরঘাট সেতু আরো বছর দু’য়েক আগে হয়ে যেত, কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কিছু ভুল ত্রুটির কারণে হয়ে ওঠেনি যার জন্য তিনি এলাকাবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
মানুষের প্রতি ভালোবাসা, এলাকার উন্নয়ন, দেশপ্রেমই ছিল তাঁর রাজনৈতিক পুঁজি, গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর প্রদত্ত একেকটি বক্তৃতাই যেন একেকটি অনবদ্য দলিল হয়ে রয়ে গেল সংসদ আর্কাইভে, কোটি মানুষের হৃদয়ে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে কয়জন প্রবীণ রাজনীতিবিদ জাতীয় অমীমাংসিত ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করেছেন তার মধ্যে মঈন উদ্দীন খান বাদল ছিলেন অন্যতম একজন জাতীয় নেতা। তিনি শুধু একজন স্বাধীনচেতা রাজনীতিবিদ ছিলেন না, ছিলেন একজন বড় মাপের দার্শনিকও। তাঁর রাজনৈতিক পুরো চিন্তা চেতনার দিকদর্শন ছিল গণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন, দেশের সার্বিক উন্নয়ন, জাতীয় ইস্যুগুলোতে তাঁর বীরোচিত ভাবগাম্ভীর্য পূর্ণ ভূমিকা রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করত, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদীয় রীতি-নীতি পালনে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন এই বীর পুরুষ।
সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, তথ্যবহুল দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য জাতীয় সংসদ কে সমৃদ্ধ করেছে, যার প্রেক্ষিত দশম জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার আব্দুল হামিদ সংসদ অধিবেশন চলাকালীন একদিন বলে ওঠেন, মাননীয় সাংসদগণ, আপনারা মঈন উদ্দীন খান বাদলকে অনুসরণ করতে পারেন। তিনি একদিকে যেমন দেশীয় রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করছেন, তেমনি আন্তর্জাতিক বিশ্বে দেশের মর্যাদার প্রশ্নে তার ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়, বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্র/বোমা নিরস্ত্রীকরণে বাংলাদেশে সরকারের পক্ষে আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া, কোরিয়া, চীন, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন পারমাণবিক শক্তিধর দেশে শান্তির বার্তা পৌঁছে দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। যা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদাকে সমুন্নত করেছে বহুগুণ।
মায়ানমার সেনাবাহিনী যখন নিরীহ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর নির্বিচারে গণহত্যায় মেতে উঠেছিল তখন মায়ানমারের এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ বিপক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলতে ও ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন বর্ষীয়ান এ রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির ক্রান্তিলগ্নে যখন বড় দুই দল পরস্পর বিরোধী মুখোমুখি অবস্থান নেওয়া কারণে রাজনৈতিক সংকট প্রকট হয়ে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টির পাঁয়তারা হয় তখন ১৪ দল গঠন করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ঐকমত্যের সরকার গঠন করতে বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদের বীরোচিত কার্যকর ভূমিকা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে।
বঙ্গবন্ধুর অসামপ্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছাত্রলীগের রাজনীতির মাঠ থেকে উঠে আসা ছাত্রনেতা মঈন উদ্দীন খান বাদল ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহবানে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন সংগঠক হয়েও সমর যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেন, চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ- কমোডরদের সাথে নিয়ে অপারেশন জ্যাকপটের পরিকল্পনা ও সফল অপারেশনের মাধ্যমে ৭ টি পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে পাকিস্তানিদের মনোবল ভেঙে স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হয়।
পরে ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ, এ যোগদান করেন। রাজপথ থেকে সংসদ সর্বত্রই সমান বিচরণ করা এই মানুষটি তেমন বড় কোন রাজনৈতিক দলের নেতা না হলেও বিশাল কর্মী বাহিনী না থাকলেও তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, মেধা, যোগ্যতা, নেতৃত্বের প্রতিফলন ঘটিয়ে নিজেকে যোগ্য জাতীয় নেতা হিসেবে স্থান করে নিতে পেরেছেন কোটি জনতার হৃদয়ে। মঈন উদ্দীন খান বাদল এক নামেই দেশের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠে।এটিই ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা।এখনো তার শূন্যতায় কোটি হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।
লেখক :এডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত

পূর্ববর্তী নিবন্ধসামনের দিকে পথচলার জন্য
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা