ভয়ংকর কিশোর গ্যাং ব্ল্যাক ফাইটারের গল্প

পাহাড়তলীতে জোড়া খুন

ঋত্বিক নয়ন | শুক্রবার , ১২ মে, ২০২৩ at ৫:০৭ পূর্বাহ্ণ

ব্ল্যাক ফাইটার’পাহাড়তলী কেন্দ্রিক একটি কিশোর গ্যাংয়ের নাম। যাদের বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায়। বড় ভাই খ্যাত শ্রমিক লীগ পাহাড়তলী শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. ইলিয়াছ মিঠু তাদের পৃষ্ঠপোষক। আর ফয়সাল নামে একজন সেই বড় ভাইয়ের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। ব্ল্যাক ফাইটারের সদস্যদের অধিকাংশই শ্রমজীবী। তাদের বয়স ১৬ থেকে ২০। ইলিয়াছ সুকৌশলে ব্ল্যাক ফাইটার গ্রুপটির মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টি করে রেখেছিলেন নিজের স্বার্থে। গ্রুপ দুটির মধ্যে একটি পক্ষ ফয়সালকে মান্য করলেও অন্য পক্ষ সরাসরি ইলিয়াছকেই বড় ভাই মানতো। বিষয়টি নিয়ে আগে থেকেই ফয়সাল, রবিউলদের সাথে শিহাব, মাসুমদের দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, ভয়ঙ্কর অপরাধের পাশাপাশি তুচ্ছ ঘটনায় তারা বন্ধুর প্রাণ কেড়ে নিতেও দ্বিধা করেনি। কারণ অপরাধ করে কখনো পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও রাজনৈতিক তদ্বিরে তাদের রাতের আঁধারে ছেড়ে দেয় পুলিশ। গত ৮ মে ব্ল্যাক ফাইটার গ্রুপের শিহাব নামে এক সদস্য বান্ধবী নিয়ে ঘুরতে বের হলে, চোখে পড়ে একই গ্রুপের রবিউলসহ কয়েকজনের। ঠাট্টা মশকরার ছলে রবিউল বলে, ‘ন মানার, ন মানার, তোর অঙ্গে ন মানার’। এই ঘটনায় ফয়সাল ও রবিউলের সাথে শিহাবের হাতাহাতি হয়। এতে রবিউল ও ফয়সাল আঘাত পায়। রাতে শালিসী বৈঠকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী উপর্যপুরি ছুরিকাঘাতে দুইজন খুন হয়। এই ঘটনায় আহত হয় আরও দুই কিশোর। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর ৪টায় নগরীর হালিশহরের একটি বাসা থেকে শ্রমিক লীগ নেতা ইলিয়াছের সেকেন্ড ইন কমান্ড ফয়সালকে গ্রেপ্তারের পর ব্ল্যাক ফাইটার গ্রুপ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। সাথে এও জানা যায়, বিচারের নামে শালিসী বৈঠকটি ছিল ফয়সালের পূর্ব পরিকল্পিত। ফয়সালের মূল উদ্দেশ্যই ছিল, শিহাবকে ‘শিক্ষা’ দেওয়া। কারণ তার গায়ে শিহাব যে হাত তুলেছে, সেটা ততক্ষণে গ্যাংয়ের অন্যান্যরাও জেনে গিয়েছিল। ফয়সাল নোয়াখালীর কবিরহাট এলাকার মো. নূর নবীর ছেলে।

র‌্যাব, চট্টগ্রাম জোনের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মাহবুব আলম জানান, ফয়সাল কথিত সেই বড় ভাই ইলিয়াছ মিঠুর সহযোগী হিসেবে কাজ করতো। পাহাড়তলীসাগরিকা এলাকার ‘কিশোরগ্যাংয়ের’ অন্যতম নিয়ন্ত্রক মো. ফয়সাল (২৪)। সে জোড়া খুনের মূল পরিকল্পনাকারীও। তিনি বলেন, ফয়সালের আগে গ্রেপ্তার হওয়া ৮ জনের মধ্যে ৪ জনই আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছে জোড়া খুনের মূল পরিকল্পনাকারী ফয়সাল।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফয়সাল র‌্যাব কর্মকর্তাদের জানায়, ঘটনার দিন সন্ধ্যা ৭টায় নগরীর সাগরিকা জহুর আহমদ স্টেডিয়াম এলাকায় ব্ল্যাক ফাইটার গ্রুপের সদস্য সিরাজুল ইসলাম শিহাব তার বান্ধবীকে নিয়ে ঘুরতে যায়। ওই সময় শিহাবকে উদ্দেশ্য করে ফয়সাল ও রবিউল ‘দুষ্টুমি’র ছলে বলে, ওই মেয়ের সঙ্গে তোকে মানায়নি। এরপর মেয়েটির সাথে ঠাট্টা মশকারি করতে থাকে। বান্ধবীর সাথে এ ধরনের আচরণে ক্ষেপে যায় শিহাব। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে সামান্য মারামারিও হয়। এতে ফয়সাল ও রবিউল আঘাত পায়।

বিষয়টি তাদের ‘বড় ভাই’ ইলিয়াছ মিঠুকে জানায়। ইলিয়াছকে ফয়সাল বলে, শিহাবের এ ‘বেয়াদবি’র কারণে গ্রুপে সমস্যা হচ্ছে। তাকে শায়েস্তার মাধ্যমে গ্রুপের অন্যদেরকেও সতর্ক করতে হবে। রাত ৮টার দিকে শিহাবকে ফোন করে ঘটনা মীমাংসার জন্য ইলিয়াছের অফিসে আসতে বলা হয়। ইলিয়াছের কথামতো শিহাব তার বন্ধু ও একই গ্রুপের সদস্য মাসুম, সজীব, ফাহিম, রোকন, রজিন, তুহীন, মেহেদী হাসান, ইউসুফ ও প্রান্তসহ ইলিয়াছের অফিসে যায়। সেখানে আগে থেকেই ইলিয়াছের নির্দেশে ও ফয়সালের পূর্ব পরিকল্পনায় রবিউলসহ ২০/২৫ জন কিশোর দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র হাতে প্রস্তুত থাকে। শিহাব ও তার সঙ্গে থাকা বন্ধুরা সেটি জানত না। ইলিয়াছের অফিসে সবাই হাজির হলে একপর্যায়ে সেখানে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ওই সময় ‘বড় ভাই’ ইলিয়াছ মিঠু ফয়সাল ও রবিউলকে বলে, ‘শালাদের মার’। একপর্যায়ে শিহাবদের ওপর হামলা চালায় ফয়সাল, রবিউলরা। ছুরিকাঘাত করে ফয়সাল, রনি ব্রো, বাবু এবং আকাশ। মাসুম ও সজীব চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায়। আহত হয় শিহাব এবং তার ভাই।

এ ঘটনায় সজীবের বড় ভাই মনির হোসেন বাদী হয়ে ১৮ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ১০ থেকে ১২ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে পাহাড়তলী থানায় মামলা দায়ের করেন। ঘটনার পর পুলিশ অভিযান চালিয়ে সাগরিকা এলাকার ব্ল্যাক ফাইটার গ্রুপের কথিত বড় ভাই ইলিয়াছ মিঠু সহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে। ১১ মে ভোরে হালিশহরের একটি বাসায় আত্মগোপনে থাকা ফয়সালকে গ্রেপ্তার করা হয়।

জোড়া খুনের ঘটনার পর থেকে পুলিশ ও র‌্যাব পাহাড়তলী এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। সাগরিকা বিটাক মোড়ে ইলিয়াছের সেই অফিসেও অভিযান চালানো হয়েছে। ইলিয়াছের নেতৃত্বে এবং ফয়সালের পরিচালনায় ব্ল্যাক ফাইটার গ্রুপের অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছে বিটাক এলাকার আজাদ, রমজান, পারভেজ তালুকদার ওরফে বরিশাইল্লা পারভেজ, হানিফ, হারুন, সম্রাট আকবর, মারুফ, রিয়াজ, জনি, রবিউল ও নজরুল অন্যতম। এসব কিশোরের মাধ্যমে বিটাক এলাকার শিল্পকারখানাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ফয়সালের নেতৃত্বাধীন এ গ্রুপটি ছাড়াও ইলিয়াছের নির্দেশে একে খান এলাকায় পিচ্চি মারুফ, কর্নেলহাট শাহী পাড়া এলাকায় আবু তৈয়ব, উত্তর পাহাড়তলী জেলেপাড়া এলাকায় সোহেল আধিপত্য বিস্তার করে বলে জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফোনে ডেকে নিয়ে স্ত্রীর গলায় ছুরি চালিয়েছেন স্বামীই
পরবর্তী নিবন্ধছিনতাই করে ফের টাকার আশায় এসে আটক