ভোমর কইও গিয়া

এস ডি সুব্রত | শুক্রবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:৪৬ পূর্বাহ্ণ

জলের ঘাটে দেইখা আইলাম কি সুন্দর শ্যামরায়

শ্যামরায় ভ্রমরায় ঘুইরা ঘুইরা মধু খায়।’

(বৈষ্ণব কবি রাধারমণ দত্ত)

কবি রাধারমণ দত্ত বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব । এক অনিন্দ্য সুষমার কবি রাধারমণ দত্ত পূরকায়স্থ ।

ভোমর কইও গিয়া

শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদে রাধার অঙ্গ যায় জ্বলিয়া

ও ভোমর কইও …. কৃষ্ণরে বুঝাইয়া।’

কেশবপুরের নিভৃত পল্লীতে যে ভাবুক কবির হৃদয়ের গহীন থেকে প্রেম ও ভাবের গান উৎসারিত হয়েছিল তা আজ ছড়িয়ে পড়েছে জগতময়।

রাধারমণ দত্তকে জানতে গেলে আমাদের ইতিহাসের দ্বারস্থ হতে হবে। সেন বংশের রাজাদের “মাৎস্যন্যায়” রাজত্বের ঠিক পরেই আবির্ভাব হয় শ্রীচৈতন্যের। তাঁর হাত ধরে প্রচারিত হয় বৈষ্ণববাদী সহজিয়া ধর্মের। এই সহজিয়া ধর্মের মূল তত্ত্ব বোঝাতে গেলে রাধারমণ দত্তকে নিয়ে কথা বলতে গেলে এই সহজিয়া ধর্মের কথা জানতে হবে।

. শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভারতকোষ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের বৈষ্ণব সহজিয়া সমপ্রদায় পূর্ববতী বৌদ্ধ সহজিয়া সমপ্রদায়ের যুগোচিত বিবর্তন।

বৌদ্ধ সহজিয়ার মতো বৈষ্ণব সহজিয়াগণও বলিয়াছেন যে প্রত্যেক নরনারীর দৈহিক রূপের মধ্যেই তাঁহাদের স্বরূপ লুক্কায়িত আছে। আবার গোপীনাথ কবিরাজের মতে, সহজ মানুষ হইবার সাধনা দুরূহ। সামান্য মানুষ সর্বত্রই আছে। কিন্তু সহজ মানুষ চৌদ্দভুবনের কোথাও নাই, তাহাকে গড়িয়ে নিতে হয়। সাধক অবস্থায় ভাবই আশ্রয়। এই অবস্থায় কামজয় একান্ত আবশ্যক। রাধারমণ দত্ত ছিলেন এই ভাবধর্মের অনুসারী। তাঁর গীতে বারবার শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধার প্রেমমূর্তি ফুটে উঠেছে।

কৃষ্ণপ্রেমিক এই গীতিকবি যেভাবে রাধাকৃ্‌ষ্ণ প্রেমের বিরহকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর গানগুলোর মাধ্যমে সেভাবে কেউই আজ পর্যন্ত ফুটিয়ে তুলতে পারেনি। প্রেমিকপ্রেমিকার বিরহের বেদনা যে কতটুকু বুকে আঘাত দিতে পারে তা তাঁর গান না শুনলে বুঝা যাবে না।

ভ্রমর কইয়ো গিয়া” গানে প্রতিটা বাক্যে শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়ার জন্যে রাধার আকুতি প্রকাশ পেয়েছে। গানটির মূলকথাটি এমন যে, রাধা তাঁর কৃষ্ণ হারানোর বেদনা কারো কাছেই প্রকাশ করতে পারেন না। কিন্তু কাউকে না পেয়ে ফুলের ভোমরাকেই বলতে বাধ্য হোন তাঁর বেদনার কথা। যেন ভ্রমর শ্রীকৃষ্ণকে গিয়ে বলে, তাঁর ব্যথার কথা।

হাওর কন্যা নামে পরিচিত ভাটি বাংলার অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জেলা সুনামগঞ্জ। হাওড়বাওড়, নদী নালা, পাহাড়টিলা অধ্যুষিত প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি লোক সংস্কৃতির আধার সুনামগঞ্জ। এখানে যুগে যুগে অসংখ্য মরমি কবি, বাউল, সাধক, গীতিকার, সুরকার, শিল্পী, আধ্যাত্মিক ব্যক্তির জন্ম হয়েছে। এদের মধ্যে দেওয়ান হাছন রাজা, বাউল সম্রাট শাহ্‌ আবদুল করিম, রাধারমণ দত্ত (রাধারমণ দত্ত পূরকায়স্থ) দুর্বিন শাহ, সৈয়দ শাহনুর, আছিম শাহ, কালা শাহ, আরকুম শাহ, শীতালং শাহ, কামালউদ্দীন, একলিমুর রাজা চৌধুরী, গণিউর রাজা চৌধুরী, দীননাথ বাউল, গিয়াসউদ্দীন আহমদ, মকদ্দস আলম উদাসী উল্লেখযোগ্য। তাদের দীর্ঘ সাধনায় সৃষ্ট গাজীর গান, মালজোড়া বা কবিগান, কীর্তন, ধামাইল গানগুলো বৃহত্তর সিলেট, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়সহ অনেক অঞ্চলকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি আমাদের বাংলা লোকগানের ভাণ্ডারে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। এই সাধকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার কেশবপুর গ্রামের বিখ্যাত গীতিকবি ও সাধক রাধারমণ দত্ত। পুরো নাম রাধারমণ দত্ত পূরকায়স্থ।

রাধারমণ দত্ত একাধারে ছিলেন মরমি কবি, বৈষ্ণব সহজিয়া ঘরানার সাধক ও ধামাইল গানের জনক।

এই সাধক জীবনের বড় একটা অংশ কাটিয়ে দিয়েছেন অনন্তের সন্ধানে। প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ, দেহতত্ত্ব, ভজন, ভক্তি, রাধাকৃষ্ণের আকুলতা নিয়ে বেঁধেছেন গান। তিনি নিজে কখনও সেসব গান না লিখে রাখলেও তার ভক্তরা শোনার সাথে সাথেই পুঁথিবদ্ধ করে ফেলতেন। এভাবে তিনি সৃষ্টি করে গেছেন তিন সহস্রাধিক গান, যা তাকে একজন কিংবদন্তি অমর গীতিকবি ও সুরসাধকের আসনে আসীন করেছে।

রাধারমণ দত্তের জন্ম ১৮৩৩ সালে, জগন্নাথপুরের খ্যাতিমান ও প্রভাবশালী এক পরিবারে। তার পূর্বপুরুষদের নামে সুনামগঞ্জে তিনটি এলাকার নাম আছে। এলাকাগুলো হলো জগন্নাথপুর, প্রভাকরপুর ও কেশবপুর। কেশবপুরেই তৎকালীন খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও কবি রাধামাধব দত্ত পুরকায়স্থের ঘরে জন্ম নেন রাধারমণ দত্ত। তার মায়ের নাম সুবর্ণা দেবী। বৈষ্ণবসহজিয়া দর্শনে দীক্ষিত তার বাবা ছিলেন বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার বড় মাপের পণ্ডিত। তিনি বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার কবি ও অনুবাদকও ছিলেন। মহাকবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যের স্বচ্ছন্দ টীকাভাষ্য রচনা করেন তিনি। তাছাড়াও সংস্কৃত ভাষায় তিনি কয়েকটি বই লিখেছিলেন, যার মধ্যে ‘ভারত সাবিত্রী’ ও ‘ভ্রমরগীতিকা’ উল্লেখযোগ্য। পিতার সংগীত ও সাহিত্য সাধনা শিশু রাধারমণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। রাধারমণ দত্তরা ছিলেন তিন ভাই। ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। রাধারমণ মাত্র ১০ বছর বয়সে পিতৃহারা হন। সেই থেকে মা সুবর্ণা দেবীর আদরযত্নে বেড়ে ওঠেন তিনি।

পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার আদপাশা গ্রামের নন্দকুমার সেন অধিকারীর কন্যা গুণময়ী দেবীকে। রাধারমণ দত্ত ও গুণময়ী দেবীর চার পুত্রসন্তান ছিলেন। নাম ছিল রাজবিহারী দত্ত, নদীয়াবিহারী দত্ত, রসিকবিহারী দত্ত ও বিপিনবিহারী দত্ত । কিন্তু স্ত্রী ও তিন পুত্র অকালেই মারা যান, শুধু বেঁচে থাকেন বিপিনবিহারী দত্ত। মামার বাড়ি মৌলভীবাজারের ভুজবলে গিয়ে সেখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যান বিপিনবিহারী। তিনিও রাধারমণ দত্তের জীবদ্দশায়ই মারা যান। স্ত্রী ও তিন পুত্রসন্তানের মৃত্যুর পরে সংসারে জনশূন্যতা সৃষ্টি হওয়ার বিশাল যন্ত্রণা তাকে সংসারজীবনের প্রতি উদাসীন করে তোলে।

এক সময় তিনি মৌলভীবাজার জেলার ঢেউপাশা গ্রামে স্বামী রঘুনাথ মহাশয়ের আশ্রমে চলে যান রাধারমণ দত্ত। গ্রহণ করেন তার শিষ্যত্ব। রঘুনাথ গোস্বামীর কাছ থেকেই বৈষ্ণব সহজিয়া মতবাদের দীক্ষা গ্রহণ করতে থাকেন। সাধনভজনের মাধ্যমে শুরু হয় তার বৈরাগ্য জীবন। জীবনের প্রতি অনন্ত জিজ্ঞাসা তাকে গৃহত্যাগ করতে উদ্ধুদ্ধ করে।

একপর্যায়ে গুরু রঘুনাথ গোস্বামীর দীক্ষা নিয়ে তিনি জগন্নাথপুরের অন্তর্গত নলুয়ার হাওরের পাশে একটি নির্জন কুটির নির্মাণ করে সেখানেই করতে থাকেন বৈষ্ণব সহজিয়া ধর্মের সাধনা। লোভ, হিংসা, অহঙ্কার, কাম, বাসনা, ক্রোধ, মায়া ত্যাগ করে সহজিয়া মতবাদের একের পর এক স্তর পেরিয়ে লাভ করেন সিদ্ধি। সেখানে বসেই সৃষ্টি করেন অসংখ্য গান । সে গানগুলো হল ধামাইল গান। এই ধামাইল গান তাকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। তিনি অসংখ্য ভক্তিমূলক গানও রচনা করেছেন। তিনি ধামাইল গান ছাড়াও কীর্তন, গৌরপদ, গোষ্ঠ, অভিসার, মালসী, প্রার্থনা প্রভৃতি গান রচনা করে গেছেন। তবে তার সৃষ্ট গানের মধ্যে রাধাকৃষ্ণের প্রেমবিরহ আর ধামাইল গানগুলোই পেয়েছে তুমুল জনপ্রিয়তা। ‘কলঙ্কিনী রাধা’, ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া’, ‘আমারে আসিবার কথা কইয়া’, ‘আমার বন্ধু দয়াময়’, ‘আমি রব না রব না গৃহে’, ‘শ্যাম কালিয়া প্রাণ বন্ধুরে’, ‘মনে নাই গো আমারে বন্ধুয়ার মনে নাই’, ‘বংশী বাজায় কে গো সখী’, ‘আমার গলার হার’, ‘বিনোদিনী গো তোর’, ‘দেহতরী ছাইড়া দিলাম’, ‘কার লাগিয়া গাঁথো রে সখী’ প্রভৃতি গান ছাড়াও বৃহত্তর সিলেট, আসাম, শিলিগুড়ি অঞ্চলে ধামাইল গানগুলো আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে অন্যরকম ভালবাসায়। ধামাইল গান এখন এপার বাংলা, ওপার বাংলা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ, আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে । ধামাইল গান ও নৃত্য আঞ্চলিকতা ছাড়িয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবেও এখন সমাদৃত।

তার রচিত ধামাইল গানে যেমন রয়েছে বিষয়ের বৈচিত্র্য, তেমনি রয়েছে সুর, ছন্দ, বর্ণনারও মাধুর্য। ধামাইল গানের একটি নিজস্ব গায়নরীতি আছে। এরীতি শ্রীহট্ট ও তার আশপাশের অঞ্চলের আঞ্চলিক জীবনধারা থেকে নেয়া হয়েছে। রাধারমণ দত্ত ছাড়াও আরো বেশ কয়েকজন ধামাইল গান লিখেছেন। কিন্তু ৯৫ ভাগ ধামাইল গানই রাধারমণ দত্তের লেখা। ফলে অনায়াসেই ধামাইল গানের জনক হিসেবে তাকেই অভিহিত করা হয়ে থাকে।

ধামাইল গানের শিল্পীরা তালে তালে করতালির মাধ্যমে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে এই গান পরিবেশন করে থাকেন। তাদের মুখে মুখে থাকে গানের কলি আর ছন্দে ছন্দে ফেলেন পা। হাতের মধ্যেও থাকে তাল, গতি ও মুদ্রা। ঢোল, করতাল প্রভৃতি এসব গানের বাদ্যযন্ত্র।

এক সময় ভবসাগর পার হওয়ার জন্য গুরুর কৃপা লাভের প্রার্থনা শোনা যায় দীনহীন কাঙাল রাধারমণ দত্ত।

পতিত পাবন নাম শুনিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছি কুলে

দয়াল গুরু পার করো দীনহীন কাঙালে ।’

১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ নভেম্বর পরলোকগমন করেন রাধারমণ দত্ত। তাঁকে হিন্দুধর্ম অনুযায়ী দাহ না করে সহজিয়া মতাদর্শে সমাধিস্থ করা হয়। জগন্নাথপুরের কেশবপুরে তাঁর নামে একটি সমাধিমন্দির আছে। বলতে গেলে একরকম অনাদরেই পড়ে আছে ধামাইল গানের জনক রাধারমণ দত্তের ছোট্ট এই সমাধিমন্দির ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের ফকিরের গান
পরবর্তী নিবন্ধপিসিআইইউতে টেলেন্ট হান্টের পুরস্কার বিতরণী