চট্টগ্রামের ফকিরের গান

শামসুল আরেফীন | শুক্রবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের ফকিরের গান নিয়ে আলোচনার আগে লোকসাহিত্য সম্পর্কে একটু ধারণা দেওয়া দরকার।

লোকসাহিত্য হলো ফোকলোর (Folklore)-এর একটি ধারা। এই Folklore শব্দটির উৎপত্তি ঘটে ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে। সেবছর ইংল্যান্ডের দি এ্যাথেনিয়াম নামক পত্রিকায় উইলিয়াম জন থম্‌স্‌ (William John Thoms) একটি পত্র লিখেন, যেখানে তিনি সর্বপ্রথম শব্দটি উপস্থাপন করেন। শব্দটির দু’টি অংশFolk এবং lore। Folk অর্থ লোক, lore অর্থ লোক বিষয়ক জ্ঞান। এককালে অংশদ্বয়ের সমন্বয়ে শব্দটি লেখা হতো Folk-lore। ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকের শেষদিকে অর্থাৎ ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত ‘Folklore Society’ এই সংস্থার একটি মুখপত্র প্রকাশ করতো, যার নাম ছিল Folklore Record। এই মুখপত্র একসময় Folk-lore নামে সমাদৃত হলেও পরবর্তীকালে তার মধ্য থেকে হাইফেন বিলুপ্ত করা হয়। ফলে তখন থেকে শব্দটি Folklore আকারে পরিচিত১।

Folklore বা ফোকলোরএর বিভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে। ড. আশরাফ সিদ্দিকী তাঁর সম্পাদিত ‘কিশোরগঞ্জের লোককাহিনী’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন: “যা কিছু লোক ঐতিহ্যের মাধ্যমে চলে এসেছে কাহিনী, পুরাণ, ছড়া, সংগীত, চারুশিল্প, কারুশিল্প ইত্যাদি লোকসংস্কৃতি বা ফোকলোর”২।

. মজহারুল ইসলাম সম্পাদিত ‘বিচিত্র দৃষ্টিতে ফোকলোর’ গ্রন্থে লেখা হয়েছে৩ :

  1. Folklore is the stimulation and forceful agent of culture.
  2. Folklore is the backbone of culture.
  3. Folklore is the pulse of the people and vehicle of social change.
  4. Culture is the essence of civilization and folklore is the mirror of culture.
  5. Folklore is the balancing force of culture.

Archer Taylor লিখেছেন৪ :

Folklore is the material that is handed on by tradition either by the word of mouth or by customs and practices. It maybe folksongs, folk tools, riddles, proverbs and other material preserved in words. It maybe traditional tools and physical object like fences or knots.

Dan-Ben-Amos লিখেছেন৫ :

Folklore is the artistic communication in small group.

১৯৮২ সালে নির্ণিত Folkloreএর বিজ্ঞানভিত্তিক সংজ্ঞা হলো৬ :

Folklore is a group oriented and based Creation or groups or indivituals reflecting the expectations of the community as an adequate expression of its cultural and social identity, its standereds and values are transmitted orraly, by initiation or by other means. It forms include, among other,language, liturature, music, fance, games, mythology, rituals, customs, handicrafts, archeteacture and other arts.’

Folklore-এর বিভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে যেমন, তেমনি Folklore শব্দটির বিভিন্ন অর্থও রয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ শব্দটির অর্থ করেছেন ‘লোকবিজ্ঞান’, . আশরাফ সিদ্দিকী অর্থ করেছেন ‘লোকসংস্কৃতি’৭। ইংলিশ ডিকশনারিতে শব্দটির অর্থ প্রদান করা হয়েছে ‘লোকাচারবিদ্যা’। তবে শব্দটির বিভিন্ন অর্থদাতা ফোকলোরবিদরা মনে করেন, Folklore বোঝাতে Folklore শব্দটি ব্যবহার করাই শ্রেয়; যেহেতু শব্দটির সঠিক অর্থ এখনও আবিষ্কার হয় নি।

বলেছি, Folklore শব্দটির উৎপত্তি ঘটে ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে। সেসময়ে শব্দটির উৎপত্তি ঘটলেও ফোকলোর বিদ্যার আবির্ভাব সম্পর্কে শামসুজ্জামান খান লিখেছেন৮ :

শিল্পবিপ্লবের পর ইউরোপে যে নতুন সমাজ ও সংস্কৃতি গঠিত হলো, তা আগেকার গ্রামীণ সমাজের সংস্কৃতি থেকে বহুলাংশে আলাদা। নবসৃষ্ট শহুরে মধ্যবিত্ত এবং নাগরিক শিল্পশ্রমিকের সংস্কৃতিতেও এল আঙ্গিক ও বিষয়গত নানা পরিবর্তন। এই সংস্কৃতি ধীরে ধীরে একটা সুস্পষ্ট রূপ নিতে শুরু করে এবং এই সংস্কৃতিই হয়ে উঠে মূলধারার সংস্কৃতি। সাধারণ শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্ত নতুন এই সংস্কৃতিকে নিজেদের আত্মস্থ করতে প্রয়াসী হন। কিন্তু তাঁদের মনে একটা প্রশ্ন তীক্ষ্ণমুখ হয়ে উঠে। প্রশ্নটি হলো, আগে তাঁদের যে সংস্কৃতি ছিল, তার সঙ্গে বিচ্ছেদ ও সম্পর্কহীনতার ফলে তাঁরা কি শিকড়বিচ্যুত হয়ে গেলেন না? তা ছাড়া প্রাচীন সংস্কৃতির প্রতি একধরনের মমত্ববোধ এবং প্রাক্তনের স্মৃতিও তাঁদের মনকে কিছু পরিমাণে পীড়িত করল। এই বোধ থেকেই শিল্পবিপ্লবপূর্ববর্তী গ্রামীণ সংস্কৃতির অনুসন্ধান এবং তা নিয়ে কাজ করার জন্য ঐতিহ্যপ্রেমী কিছু শিক্ষিত মানুষ এগিয়ে এলেন। এর ফলেই যে নতুন সামাজিক বিদ্যাটির উদ্ভব ঘটল, তারই নাম ফোকলোর”।

Folklore-এর একাধিক ধারা রয়েছে। লোকসাহিত্য হলো তার একটি ধারা, যা মৌখিকধারার সাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত। আরেকটি ধারা হলো লোকশিল্প। লোকসাহিত্যেরও আবার বিভিন্ন শাখা রয়েছে। বিশেষ করে আটটি শাখার কথা বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করা হয়: লোকসংগীত, লোকনাট্য, ছড়া, গীতিকা, লোককাহিনি, মন্ত্র, প্রবাদপ্রবচন ও ধাঁধা৯। ফকিরের গান লোকসংগীতের শাখাবিশেষ। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো চট্টগ্রামেও এই ফকিরের গান পাওয়া যায়। ফকির বলতে চট্টগ্রামে মুসলিম সুফি বা আধ্যাত্মিক সাধকদের বোঝানো হয়, যারা ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে।

চট্টগ্রাম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় এখানে ফকিরেরা নজর কাড়ে বেশি। চট্টগ্রাম শহর ও জেলার মাজারগুলোতে তাদের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। চট্টগ্রাম শহরের মাজারগুলোর মধ্যে আমানত শাহ্‌র মাজার, বায়েজিদ বোস্তামির মাজার, গরিবুল্লাহ্‌ শাহ্‌র মাজার, মিছকিন শাহ্‌র মাজার, বদনা শাহ্‌র মাজার, বদর আউলিয়ার মাজার, কাতাল পীরের মাজার অন্যতম। জেলার মাজার বা দরবারগুলোর মধ্যে ফটিকছড়িতে মাইজভাণ্ডার দরবার; পটিয়ায় আমির ভাণ্ডার দরবার, আকবর শাহ্‌র মাজার, শাহ্‌চান্দ আউলিয়ার মাজার, শাহ্‌ আকবর আউলিয়ার মাজার, ইয়াছিন আউলিয়ার মাজার, শাহ্‌গদী শাহ্‌র মাজার, শরীফ আউলিয়ার মাজার, শাহাজাহান আউলিয়ার মাজার; চন্দনাইশে আমিনুল্লাহ্‌ শাহ্‌ ওরফে বুড়া মাওলানার মাজার, মনু ফকিরের মাজার, মাওলানা রশিদ আহমদ শাহ্‌র মাজার, আবদুর রহমান শাহ্‌র মাজার, হাছান ফকির শাহ্‌র মাজার, নজু ফকিরের মাজার, শের আলী শাহ্‌র মাজার, শাহ্‌ করিম উল্লাহ্‌র মাজার, ওমর আলী শাহ্‌র মাজার, ছৈয়দ বুলার মাজার, কম্বলী শাহ্‌র মাজার, সর্বল কাজীর মাজার, শাহ্‌ হেদায়েত আলীর মাজার, শাহ্‌ মাছুম ফকিরের মাজার, মোস্তফা কামাল শাহ্‌র মাজার, জিহস ফকিরের মাজার, পুতুন শাহ্‌র মাজার, নজিবুল্লাহ শাহ্‌র মাজার, আনছুর আলীর মাজার, আবদুল লতিফ শাহ্‌র মাজার, হাফেজ ফজলুর রহমানের মাজার, জংলী পীরের মাজার; সাতকানিয়ায় মির্জারখীল দরবার, গারাংগিয়া দরবার, বারেক শাহ্‌র মাজার, শাহ্‌ শরফুদ্দিনের মাজার; রাউজানে জলিল শাহ্‌র মাজার, নাতোয়ান শাহ্‌র মাজার, ওয়ালী শাহ্‌র মাজার; হাটহাজারীতে শেরে বাংলা শাহ্‌র মাজার; লোহাগাড়ায় শাহ্‌ পীরের মাজার, শাহ্‌ সাহেবের মাজার; সীতাকুণ্ডে বাদশা ফকিরের মাজার, নুরুল আফসার প্রফেসরের মাজার, মহিবুল্লাহ শাহ্‌র মাজার, কাজী আলহাজ্ব জামাল উল্লাহ হুজুরের মাজার, আজম শাহ্‌র মাজার, ইউসুফ আলী শাহ্‌র মাজার, সাদেক মাস্তানের মাজার, বার আউলিয়ার মাজার, খাজা খালু শাহ্‌র মাজার, হজরত ডাল চালের মাজার; বাঁশখালীতে বাঘ ফকিরের মাজার, মোনায়েম শাহ্‌ আউলিয়ার মাজার, গাজী কালুশাহ্‌র মাজার, মকবুল ফকির শাহ্‌র মাজার, মাওলানা আশরফ আলীর মাজার, বড় মাওলানা শাহ্‌র মাজার, জানে আলী শাহ্‌র মাজার; আনোয়ারায় মোহছেন আউলিয়ার মাজার, আলী রজা ওরফে কানুফকিরের মাজার; বোয়ালখালীতে আবুল খায়ের নকশবন্দীর মাজার, ঈছা আহমেদ নকশবন্দীর মাজার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।১০ চট্টগ্রাম শহর ও জেলার এসব মাজারে ফকিরেরা এককভাবে বা দলবেঁধে গান গেয়ে ভিক্ষা করে। সপ্তাহের বৃহস্পতিবার মাজারগুলোতে দর্শনার্থীর ভিড় বেড়ে যায়। মনে করা হয়, বৃহস্পতিবার মাজার জেয়ারতের মাধ্যমে কিছু প্রার্থনা করলে তা পূরণ হয়। মাজারগুলোতে দর্শনার্থীর ভিড় বৃদ্ধি পাওয়ার এটাই প্রধান কারণ। সেদিন মাজারগুলোতে ফকিরদের দলবেঁধে গান গেয়ে ভিক্ষা করার চিত্র চোখে পড়ে বেশি।

তারা ‘আল্লাহ আল্লাহ্‌’ ও ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌’ জিকিরের মাধ্যমে কিংবা নিজের দুঃখের কাহিনি উপস্থাপন করেও ভিক্ষা করে থাকে। তারা যেসব গান গেয়ে ভিক্ষা করে সেসব গানের মধ্যে মাইজভাণ্ডারি গানের কথা উল্লেখনীয়। চট্টগ্রামে মাইজভাণ্ডারি গান ব্যাপক জনপ্রিয় হওয়ায় ফকিরেরা এই গান গেয়ে যে ভিক্ষা করে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার মাইজভাণ্ডার গ্রামে মাইজভাণ্ডারি তরিকাকে কেন্দ্র করে মাইজভাণ্ডারি গানের উদ্ভব ঘটে। মাইজভাণ্ডারি তরিকার প্রবর্তক হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারি (১৮২৬১৯০৬)। এই তরিকা কাদেরিয়া তরিকার শাখাবিশেষ। আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারির পীরের নাম সৈয়দ আবু শাহামা মোহাম্মদ সালেহ আলকাদেরী লাহোরী। ১২৭৫ হিজরী সনে আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারি মাইজভাণ্ডার গ্রামে ফিরে এসে আস্তানা স্থাপন করে তাঁর তরিকার প্রচারপ্রসার শুরু করেন। মাইজভাণ্ডার গ্রাম থেকে তরিকাটি প্রচারিত হওয়ায় তার নাম হয় মাইজভাণ্ডারি তরিকা। এই তরিকার শুরু থেকে এই তরিকাকে কেন্দ্র করে গান রচিত হয়ে আসছে। সাধারণত মাইজভাণ্ডারি তরিকার পীরমুরশিদের শানে মাইজভাণ্ডারি গান রচিত হয়।১১

চট্টগ্রামের ফকিরেরা যেসব মাইজভাণ্ডারি গান গেয়ে ভিক্ষা করে, সেসব গানের মধ্যে নিম্নোক্ত কয়েকটি গান উল্লেখযোগ্য :

হাওয়াতে বিমান চলে কোথা রে ইঞ্জিনের মূল,

কে তার চালক বল, বল দেখি রে সুধীকুল।

কেমন বিজ্ঞানের বল দিবানিশি চলে কল,

শুন হে ইঞ্জিন কক্ষে হু হু শব্দের হুলস্থুল॥

প্রত্যয় না হয় যদি দেখ হে দু’চক্ষু মুদি

দিয়ে দেখ আপনা দু’কর্ণ মুলে দুই আঙ্গুল॥

বিচিত্র ইঞ্জিনের চাল, উঠেছে সহস্র তাল,

বসেছেন ইঞ্জিন মূলে নবীজী হযরত রছুল॥

গুরু যারে দয়া করে সে গিয়ে বিমানে চড়ে

যাইয়া অনন্ত বনে তুলে আনে কাম্য ফুল॥

করিমে কহিছে সার ফুল তুলিবার ইচ্ছা যার,

শিরে ধর মাইজভাণ্ডারি মাওলা ধনের চরণ ধূল॥১২

… … …

কেবা ‘তুমি’ কেবা ‘আমি’ কে করে তার পরিচয়,

আমি’ নামে দীন দুঃখী, ‘তুমি’ নামে মহাশয়॥

তুমি আমি দুই কি এক সে বুঝিতে পারিবেক

তাওহিদের স্কুলে যেবা ধর্মজ্ঞানের ডিগ্রী লয়॥

একত্বে বাহুল্য ছিল, এইভাবে যুগান্ত গেল

বহুর মধ্যে একের খেলা এখন জগতে হয়॥

একেতে বহুলের মেলা, বহুর মধ্যে একের খেলা

তুমি আমি কথার কথা এক বিনা দ্বিতীয় নয়॥

মাটিতে আদম সৃষ্টি কে তাতে করিল দৃষ্টি

কে তাতে গোপনে বসি সাধারণের ছেজদা লয়॥

রব্বে আরেনি’ কে বলিল, ‘লনতরাণী’ উত্তর পেল,

কারে দেখি মুছা নবী মুর্চ্ছাত হয়ে রয়॥

নবীজী মে’রাজের রাতে জানি না গেলেন কোথাতে

তুমি বল ‘আর্শ তোমার স্থাপিত মানব হৃদয়’॥

তুমি কর্তা ইচ্ছাময়, সব তোমার ইঙ্গিতে হয়,

জানি না জগতবাসী কেন তারে দোষী কয়॥

বুঝতে হলে তত্ত্ব সার ত্বরা চল মাইজভাণ্ডার,

করিমে কয় তথা গেলে সব গোলের মীমাংসা হয়॥১৩

… … …

পূর্ববর্তী নিবন্ধগাজায় মসজিদে ইসরায়েলের হামলা, নিহত ৫০
পরবর্তী নিবন্ধভোমর কইও গিয়া