ভেতর থেকে দেখা

বুদ্ধজ্যোতি চাকমা | শুক্রবার , ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কম-বেশি অনেকে লেখালেখি করেন। মূলত ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র ফিরে আসার শুরুতে লেখালেখিরও শুরু হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির পর পাহাড় সম্পর্কিত লেখালেখি আরও বেশি জোরালো হয়ে ওঠে।
এর আগে, পার্বত্য চট্টগ্রাম, এ-অঞ্চলের আদিবাসী ও তাঁদের সমস্যা-সম্ভাবনার বিষয়টি অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল। সম্ভবত সিদ্ধ-নিষিদ্ধের সীমানায় চিন্তা সংকোচনের চাপে এই যাবতকালের লেখাগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় দুটি ধারা লক্ষনীয়। একটি হচ্ছে, ওপর থেকে দেখা, আরেকটি কাছ থেকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ। ছাঁচে ঢালাইয়ের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক দারিদ্রতা থাকলে কোনো সমস্যার, বিশেষ করে জাতিগত সমস্যার ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব নয়।
এই দুই ধারা বিবেচনায় সাংবাদিক ও লেখক বিপ্লব রহমানের ‘পাহাড়ের বিপন্ন জনপদ’ গ্রন্থের পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভেতর থেকে দেখা সমস্যার আলোক প্রক্ষেপণ বলা যেতে পারে। লেখক পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার গভীরে থাকা অন্ধকারে অনেকাংশে আলোকপাত করতে সক্ষম হয়েছেন। এর প্রচ্ছদেই নামকরণের নীচে বইয়ের বিষয় সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘সাংবাদিকের জবানবন্দিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের অকথিত অধ্যায়।’
বিপ্লব রহমান পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারি সংগঠন জনসংহতি সমিতির প্রধান, জ্যোতিরিন্দ্রিয় বোধিপ্রিয়(সন্তু) লারমার প্রথম সাক্ষাৎকার নেওয়া সাংবাদিক। সেই সাক্ষাৎকারটিও গ্রন্থে সংযোজন করা হয়েছে। এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে মানুষ প্রথম জনসংহতি সমিতির মনোভাব জানতে পেরেছে।
১৯৯০-এর দশক থেকে সাংবাদিক হিসেবে বিপ্লব অভিযাত্রীর মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার গোলকে অভিযান পরিচালনা করেছেন। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের মানবিক সংকট ও সম্ভাবনাকে শুধু কাছে থেকে নয়, একেবারেই ভেতর থেকে দেখা চেষ্টা করেছেন। সেজন্য নিজের দায় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার ঘটনাপঞ্জির জবানবন্দী লিখেছেন। তার জবানবন্দিতে পার্বত্য অঞ্চলের রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জুমচাষ, মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের শাখের করাতের মতো কঠিন অবস্থসহ নানা সমস্যা, সম্ভাবনার কথা কোনো কিছুই বাদ যায়নি। সবকিছুতেই নির্মোহভাবে নিজের সাক্ষ্য দিয়েছেন।
বইটিতে উপস্থাপিত বিষয়গুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সারাংশ করলে এইটুকু বোঝা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার সমাধানে পথ দুইটি। দখল করে, নয়তো গ্রহণ করে। দখল করে সমাধানের অর্থ হলো- আদিবাসীদের আত্মপরিচয়, জনসংখ্যা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও জমিজমা সবকিছু একক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারায় অ্যাসিমিলেইশন বা মিশিয়ে নেওয়া। সেটা ছলেবলে-কৌশলে যেভাবেই হোক। দ্বিতীয়ত, গ্রহণ করে সমাধানের অর্থ হচ্ছে- আদিবাসীদের স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় স্বীকার বা গ্রহণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের আলোকে স্বশাসন মেনে নেওয়া। তার উৎকৃষ্ট বিকল্প হতে পারে- পার্বত্য শান্তিচুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা কমবেশি সবার একটি জানা বিষয়। কিন্তু সমস্যাটিকে বাইরে থেকে যারা জানেন এবং অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে বোঝেন না, বিপ্লব রহমানের গ্রন্থটি তাদের জন্য উপলব্ধি উৎসারণের দাওয়াই হতে পারে।
বইটিতে অনেক জানা-অজানা তথ্য ও প্রামাণ্য দলিল হাজির করেছেন। যেমন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পেশ করা স্মারকলিপি, প্রয়াত এমএন লারমার ছিন্নপত্র ও আরও দলিল সন্নিবেশিত হয়েছে। যারা ভেতর থেকে জানেন-বোঝেন, তাদেরও ঘটনা পরম্পরা ঝাপসা হয়ে আসা স্মৃতি ঝালিয়ে নেওয়া সহজ হবে এ-গ্রন্থ হতে।
সবশেষে এটাও মনে রাখা দরকার, বিপ্লব রহমানের ‘পাহাড়ের বিপন্ন জনপদ’ কোনো গবেষণা ও ইতিহাস গ্রন্থ নয়। এটি মূলত ঘটনাপঞ্জি, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিবরণি ও তথ্য উপস্থাপনা। একজন সাংবাদিক যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছেন, তার জানার পরিধির মধ্যে যতটুকু জেনেছেন, তাই-ই তুলে ধরেছেন। নিসন্দেহে ঘটনাবহুল পার্বত্য চট্টগ্রামের এটি খণ্ডিত একটি অংশমাত্র। ঘটনা পরম্পরা ও উপস্থাপিত বিষয় বিন্যাসেও ধারাবাহিতকা ভঙ্গ হয়েছে মনে হলে একেবারে অযৌক্তিক হবে না। বইটি পরবর্তী সংস্করণ বের হলে কিছু সময় দিয়ে আরও সমৃদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআসা-যাওয়ার পথে
পরবর্তী নিবন্ধনূর নাহার বেগম