ভেজাল তেলে কমছে গাড়ির আয়ুষ্কাল

অকটেনের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে পেট্রোল, ডিজেলসহ নিম্নমানের তেল ।। অভিযান চলে, জরিমানা হয়, তবুও থামে না

হাসান আকবর | রবিবার , ১৮ জুন, ২০২৩ at ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ

ভেজাল জ্বালানি তেল দেশের মোটরযান সেক্টরের জন্য বড় ধরনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। কোটি কোটি টাকা দামের গাড়ি দেশের মোটরযান সেক্টরে যুক্ত হলেও ভেজাল জ্বালানির কারণে এসব গাড়ি নষ্ট হচ্ছে। আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে যাচ্ছে। তৈরি করছে সংকট। গ্যাসক্ষেত্রের তলানিকে অকটেন হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে বিভিন্ন পেট্রোল পাম্পে। এর বাইরেও অকটেনের সঙ্গে পেট্রোল, ডিজেলসহ নিম্নমানের বিভিন্ন তেল মিশিয়ে বাজারজাত করায় হাজার হাজার কোটি টাকার পরিবহন সেক্টর হুমকির মুখে পড়ছে।

সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের জ্বালানি তেল সেক্টরের প্রায় পুরোটাই আমদানি নির্ভর। বিশ্বের নানা দেশ থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করে দেশের চাহিদা মেটানো হয়। অবশ্য গ্যাসক্ষেত্রের তলানি হিসেবে পাওয়া কনডেনসেট বেসরকারি রিফাইনারিতে পরিশোধন করে বাজারজাত করা হয়। কিন্তু এই খাত থেকে উৎপাদিত জ্বালানি তেলের পরিমাণ খুবই সামান্য। বছরে চার লাখ টনের মতো। এর বাইরে প্রায় ১৫ লাখ টন ক্রুড অয়েলসহ ৫৫ লাখ টনের মতো জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। বিপিসির আমদানিকৃত জ্বালানি তেল পদ্মা অয়েল কোম্পানি, যমুনা অয়েল কোম্পানি এবং মেঘনা পেট্রোলিয়াম বাজারজাত করে।

বেসরকারি রিফাইনারিগুলো কনডেনসেট থেকে যে জ্বালানি তেল উৎপাদন করে তাও উক্ত তিনটি তেল বিপণন কোম্পানির মাধ্যমে বাজারজাত করে।

দেশের জ্বালানি তেলের পুরোটা সরকারি নিয়ন্ত্রণে হলেও ভেজাল তেলে বাজার সয়লাব হয়ে রয়েছে। নির্ভেজাল জ্বালানি তেল পাওয়ার মতো পেট্রোল পাম্প শহর কিংবা গ্রামে পাওয়া কঠিন। প্রায় প্রতিটি পাম্পেই ভেজাল তেল।

তেল শুধু পেট্রোল পাম্পেই ভেজাল হয় না, হয় পুরো প্রক্রিয়ার নানা ঘাটে। এরমধ্যে নৌ পথ কিংবা সড়কপথ যেখানে জ্বালানি তেল পরিবাহিত হয় সেখানেই দেয়া হয় ভেজাল। তেলের সাথে পানি মিশিয়ে দেয়া, কনডেনসেট মিশিয়ে দেয়া, অকটেনের সাথে ডিজেল মিশিয়ে দেয়াসহ নানা প্রক্রিয়ায় চলে ভেজালের মহোৎসব। বিদেশি জাহাজ থেকে চোরাপথে কেনা সংঘবদ্ধ একটি চোরাকারবারি চক্রও কোটি কোটি টাকার ভেজাল তেল বাজারজাত করে। শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের তেলও চোরাপথে নানাভাবে চলে আসে পেট্রোল পাম্পে। গ্যাস ক্ষেত্রের তলানি সরাসরি পেট্রোল পাম্পের ট্যাংকে মিশিয়ে দেয়ার ঘটনা প্রায় প্রাত্যহিক। নানা প্রক্রিয়ায় তেলে ভেজাল দেয়ার কারণে দেশের আমদানিনির্ভর মোটরযান সেক্টর পুরোপুরি হুমকির মুখে বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, দামি গাড়িগুলো ভেজাল তেলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভেজাল তেলের কারণে কমে যাচ্ছে গাড়ির আয়ুষ্কাল। কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানিকৃত গাড়ি শুধুমাত্র ভেজাল তেলে বেহাল দশায় পড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন গাড়ির মালিকেরা। দামি গাড়ি কিনেও চালিয়ে শান্তি পাচ্ছেন না বলেও মন্তব্য করেছেন মার্সিডিজ গাড়ি ব্যবহারকারী এক ব্যবসায়ী। রেঞ্জরোভার গাড়ি চালাতে গিয়ে চরম বেকায়দায় পড়েছেন বলে জানালেন অপর একজন শিল্পপতি। তিনি বলেন, শহরের বিভিন্ন পাম্প থেকে তেল কিনে দেখেছি। কোথাও শান্তি নেই। এই ধরনের গাড়িগুলো ভেজাল তেলে চালানো কঠিন, অনেক সময় চলতে চায় না। শুধু দামি গাড়িই নয়, সাধারণ মানের গাড়িগুলোও ভেজাল তেলের কবলে পড়ে নষ্ট হচ্ছে।

সংঘবদ্ধ চক্র পৃথক পৃথক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দেশের ভেজাল তেলের কারবারটি নিয়ন্ত্রণ করে। ভেজাল তেল প্রতিরোধে সরকারের বিভিন্ন দফতরের দায়িত্ব থাকলেও চোখে পড়ার মতো তৎপরতা নেই।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) এবং বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, অভিযান চালালেই ভেজাল পাওয়া যায়। জরিমানাও করা হয়। কিন্তু এদের থামানো যাচ্ছে না। উৎসে এসব বন্ধ করা না গেলে পাম্পে অভিযান চালিয়ে পুরো সফল মিলবে না বলেও মন্তব্য করেছেন জেলা প্রশাসনের একজন ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি বলেন, ভয়াবহ অবস্থা। ভেজাল জ্বালানি তেল নিয়ে আমরাও সংকটে আছি। গ্যাস ক্ষেত্রের তলানি, নদী বা সাগরের পানির পাশাপাশি চোরাপথের তেলও ভেজালের বড় উৎস বলে উল্লেখ করে বিএসটিআইর একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা প্রায়শ অভিযান চালাই। কিন্তু জরিমানা যা করা হয় তার থেকে ওদের মুনাফা ঢের বেশি। তাই তাদের থামানো যাচ্ছে না। একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম নিয়ে উৎসে ভেজাল বন্ধ করা না গেলে এই সেক্টরকে আরো অনেক মূল্য দিতে হবে বলেও যানবাহন মালিকেরা মন্তব্য করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধছয়দিন আগে নিখোঁজ স্কুলছাত্রের মরদেহ মিলল নদীর পাড়ে
পরবর্তী নিবন্ধবান্দরবানে পানি ও স্যালাইন বিতরণে গিয়ে বিস্ফোরণে সেনাসদস্য নিহত