ভূটানের রঙিন পোশাক

রিয়াজুল হক | বুধবার , ৩১ মে, ২০২৩ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

তোমরা কি বলতে পারো বাংলাদেশকে কোন দেশ প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিলো? ঠিকই বলেছো ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর ভূটান সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। সার্কভুক্ত আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভূটান।

২০২১ খ্রিস্টাব্দে ভূটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিংয়ের বাংলাদেশ সফরের কথা তোমাদের মনে আছে নিশ্চয়ই? তিনি কী ধরনের পোশাক পরেছিলেন তা কি তোমরা খেয়াল করেছিলে? ঠিকই বলেছো, ভূটানের জাতীয় পোশাক পরে তিনি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। সরকারি কাজে ভূটানিদের জন্য তাদের জাতীয় পোশাক পরা বাধ্যতামূলক। জাতীয় পোশাক না পরলে কিন্তু কোনো ভূটানি কোনো সরকারি অফিসে প্রবেশ করতে পারে না এবং কাজও করতে পারে না।

দেখেছো কীভাবে তারা তাদের সংস্কৃতিকে লালন করছে? আমি নিজেও ভূটানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন আমার গাড়ির ড্রাইভারকে কালো রংয়ের ঘো পোশাক পরিহিত দেখেছিলাম। ভূটানের প্রতিষ্ঠাতা জাবড্রুং নগাওয়াং নামগেল নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রাখতে ভূটানিদের জন্য ঘোএর প্রচলন করেছিলেন।

ভূটানি পুরুষ এবং নারীদের পোশাক খুবই রঙিন এবং আকর্ষণীয়। যে কারোরই নজর কাড়বে। প্রথমে তারা পরে ‘টেগো’ নামের একটি পোশাক। এটি লম্বা হাতার জ্যাকেটের মতো দেখতে একটি সাদা রংয়ের পোশাক। জানো তো ভূটানে খুব শীত। তাই তারা একাধিক পোশাক গায়ে দেয় যাতে শীত নিবারণ করা যায়। এরপর এটির উপর আলখাল্লার মতো একটি ভারী পোশাক পরে। এটি ‘ঘো’ নামে পরিচিত। মোটা কাপড়ের রঙিন পোশাক এটি। যদিও এটি পা পর্যন্ত লম্বা হয় কিন্তু কোমরে বেঁধে রাখার কারণে হাঁটু অব্দি ঝুলে থাকে। এটি বিভিন্ন রং যেমনকমলা, হলুদ ইত্যাদি বর্ণের এবং ডোরাকাটা নকশায় থাকে।

ঘো তাঁতে বোনা ‘কেরা’ নামের একটি কাপড়ের বেল্ট দিয়ে কোমরে বাঁধা থাকে। সপ্তদশ শতাব্দীতে ভূটানিরা ঘো পরা শুরু করে। মহিলারাও কিন্তু ঘো পরতে পরে। তবে তারা সাধারণত ‘কিরাই’ পরে। ঘো এবং টেগোর হাতা কিন্তু খুবই লম্বা হয়, মানুষের হাতের চেয়েও বেশি। তাই কব্জির কাছে হাতা ভাঁজ করে ২৫/৩০ সেন্টিমিটারের একটি ব্যান্ড তৈরি করে রাখে ভূটানিরা। যেহেতু টেগো সাধারণত সাদা হয় তাই ব্যান্ডটি সাদা দেখায়।

কেরা বেল্টের উপর ঘো পোশাককে এমনভাবে ভাঁজ করা হয় যাতে পেটের কাছে একটি বড় পকেটের মতো তৈরি হয়। এই পকেটে কিছু জিনিসপত্র যেমনমানিব্যাগ, মোবাইল ফোন ইত্যাদি রাখা যায়। এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পকেট। তোমাদের অবাক লাগছে তাই না? তোমরা শুনে আরো আশ্চর্য হবে যে এই পকেটে অনেক সময় শিশুদের ঘুম পাড়িয়েও রাখা হয়। পুরুষটি ঘুমন্ত শিশুটিকে নিয়েই দিব্যি কাজ চালিয়ে যেতে পারে। আমাদের দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মহিলারা যেমন শিশুদেরকে পিঠে ঝুলিয়ে রেখে কাজ করে ঠিক তেমনি।

তোমরা হয়তো ভাবতে পারো এত বড় আর মোটা কাপড় না হয় সকাল বেলা পরা যায়। রোদ উঠে গেলে গরম লেগে অস্বস্তি লাগবে না? তোমরা জেনে রাখো ঘোএর সুবিধা হলো গরম লাগলে এটিকে কাঁধ থেকে নামিয়ে কেরা বেল্টের উপর পেঁচিয়ে বেঁধে রাখা যায়। কী সুন্দর পোশাক তাই না? তোমরাও চাইলে ঘো পরতে পারো কারণ তিন মাপের ঘো পাওয়া যায়, বড়, মাঝারি ও ছোট।

ঘোএর উপর সিল্কের তৈরি ‘কাবনি’ নামের একটি শাল পরে তারা। এটি ডান কোমর পেঁচিয়ে বাম কাঁধে ঝুলে থাকে। কাবনি সাধারণত ৩০০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের এবং ৯০ সেন্টিমিটার প্রস্থের হয়ে থাকে। বিভিন্ন পেশা, মর্যাদা এবং গোষ্ঠীর কাবনি বিভিন্ন রঙ এবং নকশার হয়। যেমনরাজা বা মঠ প্রধানের কাবনি জাফরান রংয়ের, সরকারি কর্মকর্তাদের কমলা, বিচারকদের সবুজ এবং সাধারণ নাগরিকদের সাদা রংয়ের হয়। শুধু ঘো পরলেই কি চলবে? জুতো লাগবে না? হ্যাঁ, তাই ভূটানিরা ‘তশো লাম’ নামক বুট পরে। বলা হয়ে থাকে যে যখন একজন মানুষ ‘তশো লাম’ পরেন তখন তিনি সারাদেশের যেকোনো লাখাং অর্থাৎ মন্দির পরিদর্শন করতে পারেন। এটি সাধারণত চামড়ার তৈরি হাঁটু পর্যন্ত উচ্চতার। এতে সিল্কের কাজ করা থাকে। এই জুতোগুলো দেখতে খুব সুন্দর কারণ এগুলো প্রচুর পরিমাণে সূচিকর্ম এবং অন্যান্য সাজসজ্জায় অলংকৃত করা হয়। এখন অবশ্য ভূটানিরা পায়ে কালো রংয়ের জুতা এবং হাঁটু পর্যন্ত লম্বা মোজা পরে।

তোমরা জেনে আশ্চর্য হবে যে এই পোশাকগুলোর সব ক’টিই ১০০ ভাগ জৈব উপাদান, যেমনতুলা, রেশম, প্রাকৃতিক রং, চামড়া ইত্যাদি দিয়ে তৈরি। কৃত্রিম কোনো কিছু নেই। দেখেছো, প্রকৃতি সংরক্ষণের কি সুন্দর ব্যবস্থা? আর জানো তো ভূটান হচ্ছে কার্বন নেগেটিভ দেশগুলোর অন্যতম অর্থাৎ ভূটান যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করে তার চেয়েও বেশি পরিমাণ কার্বন শোষণ করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধছোট ঘর
পরবর্তী নিবন্ধসাউদার্ন ভার্সিটিতে মানবসম্পদ বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালা