ভূগোলের গোল

ডা. কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ২৫ জানুয়ারি, ২০২২ at ৮:০৯ পূর্বাহ্ণ

প্রতাপ ভানু মেহতা একজন ভারতীয় একাডেমিশিয়ান। তিনি ভারতের অশোকা ভার্সিটির ভি. সি. ছিলেন। নয়াদিল্লীর থিংকট্যাংক পরিচালিত পলিসি সেন্টার এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০১৬ সালে নেহেরু মিউজিয়াম ও লাইব্রেরীতে তার পদের উপরে একজন ‘আমলা’ বসিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগ করেন। সম্প্রতি দক্ষিণ ভারতীয় পত্রিকায় তিনি ভারতের গুজরাটীকরণ ও কাশ্মীরীকরণ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেন।এমনকি মোদীঅমিতশাহ জুটি ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদ উসকে দিচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন।

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের তিনজন পুরোধা গান্ধী, জিন্নাহ ও প্যাটেল তিনজনই গুজরাটী। এই তিনজনেরই চরিত্র গুজরাটী নৃতাত্ত্বিক চরিত্রের প্রতিভু। দুর্ভাগ্যক্রমে মোদি অমিতশাহ ও গুজরাটী মনোবৃত্তির প্রতিভু। তারা কেউই সর্ব ভারতীয় বৈচিত্রের ধারণা ধারণই করে না।

জিন্নাহ ও গান্ধী গুজরাটী ব্যবসায়ী পরিবারের প্রতিনিধি। দুজনই কট্টর ধ্যান ধারণার বিশ্বাসী। নিজ স্বার্থে অনেকটা আপোষকামী। তাদের সাথে আমজনতার বিস্তর ফারাক। প্যাটেল কৃষক পরিবারের প্রতিনিধি হলেও গুজরাটী চরিত্রের একগুয়েমি ও ‘আমিত্বে’ দৃঢ় ছিলেন। গুজরাটের ‘সুরাত’ বন্দর প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই ব্যবসার কেন্দ্র ছিল। গ্রীক, রোমান, প্রাচ্য, ডাচ, পর্তুগীজ ও বৃটিশ বণিকদের সাথে স্থানীয় গুজরাটীদের ব্যবসায়িক সংযোগ বেশ প্রাচীন। সেখান থেকেই গুজরাটীদের ব্যবসায়িক মানস গড়ে ওঠে। ব্যবসা করতে গেলে বড় ‘ক্যাপিটালকে’ অবশ্যই সমীহ করতে হয়। সুরাতের গুজরাটী ব্যবসায়ীরাও বড় ক্যাপিটালের সাথে সমঝোতা করে ব্যবসা করত। নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন দুই দফা। ব্যবসায়িক প্রপাগান্ডার ও প্রচারের হাওয়া ছিল তখন। বর্তমানে ‘গুজরাটী মডেল’ এর চুলচেরা বিশ্লেষণে বের হয়ে আসছে কিছু বড় কর্পোরেট এর ব্যবসার অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। বহু কর্পোরেটকে মাত্র ১ টাকা মূল্যে বিশাল সরকারি জমি লীজ দেয়া হয়। কিন্তু মানব সম্পদ উন্নয়নের সমস্ত সূচকশিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান এ গুজরাট এর স্থান ভারতীয় রাজ্যদের মাঝেও অনেক নীচে। আম জনতার কিছুই হয়নি। গরীব আরো গরীব হয়েছে।

মোদিঅমিত গুজরাট থেকে দিল্লী এসেও সর্বভারতীয় বৈচিত্র বুঝতে সমর্থ হননি অথবা গুজরাটী অহমিকায় সর্বভারতীয় বৈচিত্রকে অবজ্ঞা করেছেন। দুজনই ভারতীয় ব্যবসায়ী স্বার্থের প্রতিভু। ভারতের সাথে প্রতিবেশীদেশসমূহ সহ আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের যেসব মেগা প্রজেক্টে চুক্তি সরকারীভাবে সম্পাদিত হয় সেসব চুক্তিতেও না হাসতে পারে সংশ্লিষ্ট সরকার না হাসতে পারে মোদি অমিত শাহ। দুধের ছানাটা ভাগে পড়ে আম্বানী টাটার ভাগে। মোদীর ডিমানিটাইজেশন (৫০০,১০০০ টাকার নোট বদল) এর পর দেখা গেল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পথে বসে গেল, কর্পোরেটদের বিশাল লাভ হল। জিএসটি নামের জটিল কর ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হবার পর দেখা গেল এটা করা হয়েছে ক্ষুদ্র দোকানীদের ব্যবসা থেকে দূরে রাখার জন্য। অলিতে গলিতে ‘মার্ট’ খুলে বড় ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছে।

২০১৭ সালে গুজরাটের সুরাত ও আহমদাবাদের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা মাসব্যাপী আন্দোলন করে যা গণমাধ্যমে ব্ল্যাকআউটকরা হয়। বর্ষব্যাপী কৃষক আন্দোলন চলাকালে মোদীঅমিত শাহ স্রেফ গুজরাটী কায়দায় নীরব ছিল তিনমাস। কৃষকদের দাবীগুলো সম্বন্ধে সরকারের দুই নেতার কোন ধারনাই ছিল না। বর্ষব্যাপী কৃষক আন্দোলন এর ক্ষতি মোদীঅমিতশাহ জুটিকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করে ফেলে। ৫টি রাজ্যে মোদীর দল ভাল করতে পারেনি। দক্ষিণ ভারতের রাজ্য কেরালার নির্বাচনে দিল্লী মেট্রোরেলের চীফ শ্রীধরনকে বিজেপি প্রদেশ প্রধান ও মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রজেক্ট করেছিল। শ্রীধরন পরাজিত হওয়ার পর বিজেপি থেকে ইস্তফা বিবৃতিতে বলেনবিজেপির রাজনীতি কেরালায় কখনো সফল হবে না।

কাশ্মীরীকরণ হচ্ছে ভয়ভীতির মাধ্যমে বিরোধী কন্ঠ দমন। ওটা মোদীঅমিতশাহ ২০১৪ সালের পর সারা ভারতে প্রয়োগ করছে। ২০২১ সালে কাশ্মীরে ইন্টারনেট সহ সমস্ত মোবাইল বন্ধ রাখা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এত বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বিশ্ব যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করার নজীর নাই, মোদীঅমিত শাহের পরমত অসহিষ্ণুতা পুরো ভারত, পশ্চিম বাংলা, নাগাল্যাল্ড, মেঘালয়ে কুৎসিৎভাবে দৃশ্যমান। কাশ্মীরের সমস্ত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বিশিষ্ট নাগরিকদের বৎসর জুড়ে বন্দী রাখা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। দিল্লীতে ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন নেতাকে জানে মেরে ফেলার প্রচেষ্টা করা হয়। ব্যাংগালোরের মহিলা নেত্রী ও সাংবাদিক গৌরী সাংকেরকে ঘরে ঢুকে হত্যা করা হয়। গোমাংস জনিত ‘জনতার কিলিং’ তো সবারই জানা। অনেক একাডেমিশিয়ান, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীকে বিভিন্ন অজুহাতে জেল, মামলা টুকে দেয়া হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া, এডকাস্টিং রেগুলাটরী অথরিটির মতো কার্যকর গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত আইটি আইন করে সাংবাদিকতা ও বাকস্বাধীনতাকে দমন করা হচ্ছে। ইন্ডিয়া টুডে, দৈনিক ভাস্কর, মালয়ালম মনোরমাসহ অনেক নামী সংবাদ মাধ্যম সরকারের বাকস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণকারী আইনগুলোর প্রতিবাদ করছে। এসবই হচ্ছে ভয়ভীতি, জেল জুলুম দিয়ে মানুষের কন্ঠকে বন্ধ করার প্রচেষ্টাযাকে কাশ্মীরীকরণ বলে।

নেহেরু বাজপেয়ী যে একক ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলেছিলেন এবং যার জন্য সব ভারতীয় গর্ববোধ করে তা মোদিঅমিতশাহ নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে ঐধঃব ংঢ়ববপয টুইটার ও তথ্য প্রচারণার মাধ্যমে ভারতকে জাতধর্মে ভাগ করলেও তা এখন নিজের গায়ে এসে পড়ছে। এখন হিন্দুমুসলিমখ্রীস্টান দ্বন্দ্বকে ছাপিয়ে দেখা দিয়েছে উচ্চবর্ণ, নিম্ন বর্ণ ও উপজাতীয় দাঙ্গা। এই বহুমুখী দ্বন্দ্ব এমনিতেই নাজুক অর্থনীতিকে আরো নাজুক করবে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ৪৫০ মিলিয়ন ভারতীয় দারিদ্র সীমার নীচে পতিত হয়েছে। প্রশ্ন হল তারপরেও মোদীর জনপ্রিয়তা কেন? সোজা প্রশ্ন বিকল্প বিরোধী একক নেতৃত্বের অভাব। ভারতবাসীদের তো সমস্যা রয়েই যাচ্ছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতেও ভারতের হল অবস্থার ঢেউ আছড়ে পড়ে। প্রতিবেশীদের জন্যই এটা একটা বড় শংকা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজেলা মন্ত্রী, উন্নয়ন সমন্বয় এবং প্রসঙ্গ কথা
পরবর্তী নিবন্ধভিবিডির ওরিয়েন্টেশন ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি